বিশ্বজুড়ে ডিজিটাল উৎকর্ষের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে ইলেকট্রনিক তথা ডিজিটাল পণ্যের ব্যবহার। আর সেই সঙ্গে হু হু করে বাড়ছে ইলেকট্রনিক বর্জ্য বা ই-বর্জ্যরে পরিমাণ। প্রতিবছর যে হারে ই-বর্জ্য উৎপন্ন হচ্ছে, তার তুলনায় খুব সামান্যই হচ্ছে রিসাইক্লিং। এমন সমস্যা সমাধানে নিজেদের অবস্থান থেকে অবদান রাখতে দেশের তরুণ উদ্যোক্তা আবু সাঈদ পিয়াস গড়ে তুলেছেন ‘নেক্সট হ্যান্ড ডটকম’। তার সঙ্গে আছেন আরও চার তরুণ মনিরুল আমিন অন্তু, সাজিন আহম্মেদ কৌশিক, মুস্তাফিজুর রহমান এবং এবিএম ওবায়দুল্লাহ বাদল। এই পাঁচ তরুণের নেক্সট হ্যান্ডের উদ্দেশ্য একটাই- ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য পৃথিবীকে একটি নিরাপদ আবাসস্থলে পরিণত করা।
পুরোনো এবং ব্যবহৃত ইলেকট্রনিক পণ্য ‘এক্সচেঞ্জ’
(বিনিময়) ও কেনাবেচার ব্যবসা চালুর কারণ জানিয়ে নেক্সট হ্যান্ডের প্রতিষ্ঠাতা আবু সাঈদ পিয়াস বলেন, ‘ব্যবসা তো চাইলে যেকোনো কিছুর করাই যায়। কিন্তু এমন ব্যবসা করতে চেয়েছি যা সমাজে ইতিবাচক রাখবে। প্রযুক্তি খাতে জনপ্রিয় দুইটি উদ্যোগ রয়েছে আমাদের - ‘সুমাস টেক’ এবং ‘সুমাস টেকনোলজি’। এগুলোতে স্মার্টফোন, ট্যাব, ল্যাপটপ, ডেস্কটপ, কম্পিউটারের অন্যান্য যন্ত্রাংশ, স্মার্ট টিভি, এসি, ফ্রিজ, মনিটর এবং অন্যান্য হোম অ্যাপ্লায়েন্স ও এক্সেসরিজ বিক্রি করি। বিক্রিত গ্যাজেটগুলো কিভাবে রিসাইক্লিং করা যায়; সেটা ভাবতে ভাবতেই ‘নেক্সট হ্যান্ড ডটকম’ নিয়ে কাজ শুরু করি।’
নেক্সট হ্যান্ড ডট কমে মোবাইলসহ প্রায় সব ধরনের ইলেকট্রনিক পণ্য ট্রেড করা যায়, হোক সেটি সচল বা বিকল। পিয়াস বলেন, ‘সাধারণভাবে, ব্যবহৃত মোবাইল কেনাবেচার ব্যবসা অনেকেই করছেন কারণ মোবাইলের রিসেল ভ্যালু অনেক বেশি এবং এর ট্রেডিং সহজ। কিন্তু অন্যান্য গ্যাজেট থেকেও ই-বর্জ্য তৈরি হয়, যেগুলো ট্রেড করার সুযোগ বাংলাদেশে নেই বললেই চলে। যেমন হেডফোন, ইয়ার বাড, প্লেস্টেশন, গেমিং কনসোল, সাউন্ডবক্স ইত্যাদি। আবার আমাদের অনেকের বাসায় পুরোনো বা নষ্ট মোবাইল ফোন আছে, যেগুলো কোথাও বিক্রি করা যায় না। অথচ সেগুলোরও রিসাইকেল ভ্যালু আছে। হয়তো ঐ মোবাইলের ডিসপ্লে, ক্যামেরা, কেসিং, মাদারবোর্ড বা কোনো একটা ‘আইসি’ ভালো আছে। এগুলোর আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য আছে। আবার অনেকের বাসায় হয়তো পুরনো নোকিয়া মোবাইলের চার্জারটা এখনও আছে। অনেকগুলো চার্জারের ক্যাবল থেকে যে তামার তার হবে, সেটা রিসাইকেল করে অন্যকিছু তৈরি সম্ভব।’
পিয়াস আরও বলেন, ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে নেক্সট হ্যান্ড নিয়ে কাজ শুরু করি। প্রথমে এটি অনলাইনভিত্তিক ছিল এবং একটি পর্যায়ে এসে আমার সঙ্গে সহযোগীর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি। আমার দুই বন্ধু মনিরুল আমিন অন্তু এবং সাজিন আহম্মেদ কৌশিককে কো-ফাউন্ডার হিসেবে যুক্ত করি। এরপর মুস্তাফিজুর রহমান এবং এবিএম ওবায়দুল্লাহ বাদল যুক্ত হন। তারা যথাক্রমে ফাইন্যান্স এবং আন্তর্জাতিক ব্যবসার বিষয়গুলো দেখভাল করেন। ২০২৪ সালের জুলাইতে রাজধানীর যমুনা ফিউচার পার্কে প্রথম আউটলেট চালু করি।’
এই আউটলেট পরিদর্শনে ই-বর্জ্য হ্রাস এবং গ্রিন এনার্জির প্রতি নেক্সট হ্যান্ডের সমর্থনের পরিচয় পাওয়া যায়। আউটলেটটি রাঙানো হয়েছে সবুজের আবহে। এর বিভিন্ন অংশে ই-বর্জ্য হ্রাসে এবং গ্রিন এনার্জির প্রচারে বিভিন্ন সচেতনতামূলক বার্তা দেওয়া আছে। যেমন একটি দেওয়া থাকা তথ্যচিত্র বলছে, নতুন মোবাইলের তুলনায় নেক্সট হ্যান্ডের মোবাইল কিনলে ৭৮ শতাংশ পর্যন্ত কার্বন নিঃসরণ সাশ্রয় হবে। আরেকটি তথ্য চিত্র বলছে, একটি রিসাইকেলড মোবাইল ৮৯ শতাংশ ই-বর্জ্য হ্রাসে অবদান রাখে। নেক্সট হ্যান্ডে মোবাইল কেনাকাটায় গ্রাহকদের রিসাইকেলড কাগজে তৈরি বক্স দেওয়া হয়। নেক্সট হ্যান্ডের লোগোতেও পরিষ্কারভাবে পরিবেশবান্ধব বার্তা দেওয়া হয়েছে। কালো এবং সবুজ রঙের দুইটি বিপরীতমুখী তীর নির্দেশকের অর্থ হচ্ছে, কার্বন দূষণযুক্ত ডিভাইস, নেক্সট হ্যান্ড থেকে পরিবেশবান্ধব হয়ে ইকোসিস্টেমে ফিরে আসবে।
ব্যবহৃত পণ্য কেনাবেচার এই উদ্যোগের নাম ‘নেক্সট হ্যান্ড’ হওয়ার পেছনেও আছে একটি গল্প। সেটি তুলে ধরে পিয়াস বলেন, শীঘ্রই আসছে ‘আইফোন ১৭’ কিন্তু এখনো আইফোন ৬ বা ৭ ব্যবহারকারী আছেন। ব্যবহৃত বা পুরাতন পণ্য কেনাবেচার সময় এগুলোকে ‘সেকেন্ড হ্যান্ড’ বলি কিন্তু আমরা কি আসলেই জানি যে, ঐ ডিভাইসটির কতবার হাত বদল হয়েছে? সে বিষয়ে নিশ্চিত না হয়ে গ্রাহকের কাছে ‘সেকেন্ড হ্যান্ড’ বলে বিক্রি করাকে নৈতিকভাবে সমর্থন করি না। এজন্য নামকরণ করেছি ‘নেক্সট হ্যান্ড’ কারণ প্রতিবার কেনাবেচা বা বিনিময়ের সময় ডিভাইসটি একটি নতুন হাতে যাবে। সেকেন্ড হ্যান্ড এর বদলে নেক্সট হ্যান্ড ধারণাটাকে বিশ্বে ছড়িয়ে দিতে চাই।’
এ ধরনের উদ্যোগের ব্যবসায়িক সম্ভাবনা কেমন জানতে চাইলে আবু সাঈদ পিয়াস বলেন, সারাবিশ্বে অর্থনৈতিক অবস্থা তুলনামূলকভাবে খারাপ এখন। ফলে সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমে গেছে। আবার অবস্থাসম্পন্ন প্রযুক্তিপ্রেমীরা সর্বশেষ আপডেটের ডিভাইস ব্যবহার করতে চান। তাই নিজেদের ব্যবহৃত পুরোনো ডিভাইস বিক্রি করতে চান। আমাদের কাজ হচ্ছে, এই দুই শ্রেণির মধ্যে সেতুবন্ধক হিসেবে থাকা। যিনি ডিভাইস আপডেট করতে চান, তাকে বিক্রির সুযোগ দেওয়া। আর যিনি কমে কিনতে চান, তাকে একটি ভালো ডিভাইস দেওয়া। সত্যি কথা বলতে, পৃথিবীতে দুর্ভিক্ষ হলেও এই ব্যবসা থাকবে কারণ একটা ভালো মানের ডিভাইস গড়ে ৫ বছর পর্যন্ত সার্ভিস দেয়। আজ থেকে যদি বিশ্বে স্মার্টফোন উৎপাদন বন্ধও হয়ে যায়, তাহলেও বাজারে বিদ্যমান ডিভাইসগুলো ট্রেড হতে থাকবে। একটা ডিভাইসের কেসিং থেকে মাদারবোর্ড পর্যন্ত সবকিছু রিসাইকেল করা যায়। বাংলাদেশের ২০ শতাংশ মোবাইল ফোন ব্যবহারকারী ব্যবহৃত ডিভাইস কেনেন। ফলে শুধু ব্যবসা হিসেবেও এর ব্যাপক সম্ভাবনা আছে যার উদাহরণ নেক্সট হ্যান্ড নিজেই। শুধু আমাদের শো-রুম থেকেই গত ১ বছরে অন্তত ৫ হাজার গ্রাহককে সেবা দিয়েছি।’
অনেক সময় পুরাতন বা ব্যবহৃত ডিভাইস ব্যবহারে
নিরাপত্তা ঝুঁকি থাকে। এই সমস্যা সমাধানে নেওয়া উদ্যোগের বিষয়ে পিয়াস বলেন, ‘পুরাতন বা ব্যবহৃত পণ্য কেনার সময় বিক্রয়কারীর নিরাপত্তা দিকগুলো যাচাই করি যেমন তার জাতীয় পরিচয়পত্র যাচাই, ডিভাইস ক্রয়ের আসল রশিদ, ডিভাইসের সিরিয়াল নম্বরের সঙ্গে মিল থাকা বক্স ইত্যাদি। অনেক সময় বিশ্বস্ত সূত্র থেকে না আসলে, ডিভাইস কিনি না। তারপর নতুন গ্রাহককে বিক্রয়ের ক্ষেত্রে সকল দায়িত্ব আমরা নেই। আমাদের থেকে ডিভাইস কেনা গ্রাহক যদি পরবর্তীতে কোনো সমস্যায় পড়েন, তার দায়দায়িত্ব আমাদের।’
অনেক সময় রিফারবিশড (পুরোনোকে পুনরায় নতুন করা) পণ্যে ব্যবহারকারীদের আস্থা থাকে না। কিন্তু ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় রিফারবিশড পণ্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এ বিষয়ে পিয়াস বলেন, রিফারবিশড পণ্য নিয়ে আমাদের দেশের মানুষের মাঝে ভ্রান্ত ধারণা আছে। অনেকে এটাকে কপি বা নকল পণ্য ভাবেন কিন্তু বিষয়টি এমন না। রিফারবিশড পণ্য কিন্তু খারাপ না বা এর গুণগত মান খারাপ; বিষয়টি এমনও না। অ্যাপল বা স্যামসাং এর অফিসিয়াল স্টোর বা ওয়েবসাইটেও কিন্তু রিফারবিশড পণ্য বিক্রি হয়। ব্র্যান্ড নিউ ডিভাইসের তুলনায় প্রায় ২০ শতাংশ কমে পাওয়া যায় বলে, আন্তর্জাতিক বাজারের গ্রাহকেরা সেগুলো কেনেন। ব্র্যান্ডগুলোর কাছে ব্যবহৃত ডিভাইস আসলে, গুণগত মানে আপস না করেই সেগুলোকে নতুনের মতো অবস্থায় নিয়ে আসে। ধরুন, একটা ডিভাইসের ডিসপ্লে নষ্ট, কোম্পানি সেই ডিভাইসে নতুন ডিসপ্লে যুক্ত করে ডিভাইসটিকে নতুনের পর্যায়ে এনে বাজারে বিক্রি করে। আমাদের দেশে যে সমস্যা হয় সেটা হলো, রিফারবিশড পণ্যকে রিফারবিশড ঘোষণা না দিয়ে, একদম নতুন বলে বিক্রি করেন কেউ কেউ। এটা প্রতারণা। তবে বিশ্বের বড় বড় ব্র্যান্ডগুলো রিফারবিশড ডিভাইসকে আরও উৎসাহিত করে। এতে ই-বর্জ্য যেমন রিসাইকেল হয়, তেমনি ডিভাইস সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকে। এজন্য আমরা বলছি- রিফার্ব, রিডিউস, রিইউজ।’

 
                            -20250830121032.jpg) 
                                     সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন 
                                     
                                     
                                     
                                                                                    -20251031020255.webp) 
                                                                                     
                             
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
        
       -20251025002118.webp) 
        
        
        
        
        
       
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন