বাংলাদেশের কর্মক্ষেত্র এখন এক বিশাল পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, যার মূল চালিকাশক্তি হলো ডিজিটাল অটোমেশন। গতানুগতিক শ্রমনির্ভর প্রক্রিয়া থেকে প্রযুক্তিনির্ভর স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থায় এই উত্তরণ দেশের অর্থনীতি, বিশেষ করে প্রধান শিল্পগুলোতে, দক্ষতা ও প্রতিযোগিতামূলক সক্ষমতা বাড়াচ্ছে। বিভিন্ন খাতে ডিজিটাল অটোমেশন যেভাবে কাজ করছে, তার একটি বিস্তারিত চিত্র তুলে ধরা হলো-
প্রধান খাতগুলোতে অটোমেশনের প্রক্রিয়া
ডিজিটাল অটোমেশন বলতে কেবল রোবট ব্যবহার বোঝায় না; বরং সফটওয়্যার, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং স্মার্ট প্রযুক্তির মাধ্যমে রুটিন কাজগুলোকে স্বয়ংক্রিয় করা বোঝায়।
১. তৈরি পোশাক শিল্প:
শ্রমঘন এই খাতে অটোমেশন সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান এবং প্রভাবশালী। এই প্রক্রিয়া মূলত কিছু উপায়ে কাজ করে। যেমন-
কাটিং:
কম্পিউটার-নিয়ন্ত্রিত কাটিং মেশিনে ডিজাইনের ডেটা সরাসরি ইনপুট করা হয়। মেশিন বিপুল পরিমাণ কাপড় দ্রুত ও নির্ভুলভাবে কাটে, যা শত শত শ্রমিকের কাজকে প্রতিস্থাপন করে।
সেলাই ও সংযোজন:
স্বয়ংক্রিয় টেম্পলেট সেলাই মেশিন এবং রোবটিক ডিভাইস। পকেট লাগানো, কলার সেলাই বা হাতা সংযুক্ত করার মতো পুনরাবৃত্তিমূলক কাজগুলো একজন অপারেটরকে সহায়তা নিয়ে মেশিন নিজেই সম্পন্ন করে, নির্ভুলতা ও গতি বাড়ায়।
ইনভেন্টরি ও সাপ্লাই চেইন:
এন্টারপ্রাইজ রিসোর্স প্ল্যানিং সিস্টেম কাঁচামাল সংগ্রহ, ইনভেন্টরি গণনা ও উৎপাদন অগ্রগতি সফটওয়্যারের মাধ্যমে রিয়েল-টাইমে ট্র্যাক করা হয়। মানুষের হস্তক্ষেপ ছাড়াই তথ্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে আপডেট হয়।
২. ব্যাংকিং ও আর্থিক সেবা:
ব্যাংকিং খাত গ্রাহক সেবা, ব্যাক-অফিস অপারেশন এবং আর্থিক লেনদেনে উচ্চ স্তরের অটোমেশন ব্যবহার করছে-
রোবটিক প্রসেস অটোমেশন :
ক্রেডিট কার্ড আবেদন প্রক্রিয়াকরণ, গ্রাহকের ডেটা যাচাই করা, রিপোর্ট তৈরি করা এবং বিভিন্ন সিস্টেমে ডেটা এন্ট্রির মতো রুটিন অফিস কাজগুলো জচঅ সফটওয়্যার রোবটের মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয় করা হচ্ছে।
মোবাইল আর্থিক সেবা ও ই-কেওয়াইসি:
বিকাশ, নগদের মতো গঋঝ প্ল্যাটফর্মগুলো ২৪/৭ টাকা লেনদেন ও পরিষেবা বিল পরিশোধের সুবিধা দিয়ে ব্যাংকিং কার্যক্রমকে স্বয়ংক্রিয় করেছে। জাতীয় পরিচয়পত্র ভিত্তিক ই-কেওয়াইসি (ব-কণঈ) প্রক্রিয়া ব্যবহার করে গ্রাহকের পরিচয় স্বয়ংক্রিয়ভাবে যাচাই করা হয়।
এ.টি.এম :
নগদ টাকা উত্তোলন ও জমা দেওয়ার মতো মৌলিক ব্যাংকিং সেবাগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে এটিএম মেশিনের মাধ্যমে হয়, যা ব্যাংক কর্মীদের কাজ কমিয়েছে।
৩. ই-কমার্স ও গ্রাহক সম্পর্ক
ই-কমার্স কোম্পানি এবং ডিজিটাল পরিষেবা প্রদানকারীরা গ্রাহকের অভিজ্ঞতা উন্নত করতে অটোমেশন ব্যবহার করছে:
চ্যাটবট ও এআই:
গ্রাহক সহায়তার জন্য ওয়েবসাইট এবং অ্যাপে এআই-চালিত চ্যাটবট ব্যবহার করা হয়। এই চ্যাটবটগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে সাধারণ প্রশ্নের উত্তর দেয়, অর্ডারের তথ্য সরবরাহ করে এবং সমস্যার সমাধান করে, যা মানব এজেন্টের কাজের চাপ কমায়।
লজিস্টিকস ট্র্যাকিং:
অর্ডারের স্থান, ডেলিভারির সময় এবং ইনভেন্টরি ম্যানেজমেন্ট স্বয়ংক্রিয় ট্র্যাকিং সিস্টেমের মাধ্যমে গ্রাহক ও ব্যবস্থাপককে রিয়েল-টাইম তথ্য দেয়।
৪. সরকারি পরিষেবা:
সরকারের ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ এবং ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ উদ্যোগের আওতায় অনেক পরিষেবা স্বয়ংক্রিয় হয়েছে:
অনলাইন পোর্টাল:
পাসপোর্ট আবেদন, কর পরিশোধ, ট্রেড লাইসেন্স বা বিভিন্ন সরকারি প্রত্যয়নপত্রের জন্য এখন অনলাইন পোর্টাল ব্যবহার করা হয়। আবেদনপত্র জমা থেকে শুরু করে ফি পরিশোধের প্রক্রিয়া পর্যন্ত স্বয়ংক্রিয়ভাবে সম্পন্ন হয়।
অভিবাসন প্রক্রিয়া:
‘আমি প্রবাসী’-এর মতো ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে বিদেশে কর্মী পাঠানোর প্রক্রিয়া সহজ ও স্বচ্ছ করা হয়েছে। এটি মধ্যস্বত্বভোগীদের হস্তক্ষেপ কমিয়ে কর্মীদের জন্য ভিসা ও অন্যান্য নথিপত্র প্রক্রিয়া স্বয়ংক্রিয়ভাবে সম্পন্ন করতে সাহায্য করে।
সুযোগ ও চ্যালেঞ্জ
অটোমেশন কর্মক্ষেত্রে দক্ষতা বাড়ালেও, এটি একই সঙ্গে একটি বড় সামাজিক ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে:
সুযোগ চ্যালেঞ্জ
ব্যাপক কর্মচ্যুতি:
বিশেষ করে জগএ-এর মতো শ্রমঘন শিল্পে অদক্ষ শ্রমিকরা (প্রধানত নারী) কাজ হারাচ্ছেন।
দক্ষতা ও প্রশিক্ষণের ঘাটতি:
নতুন স্বয়ংক্রিয় মেশিন চালানো এবং এআই সিস্টেম পরিচালনার জন্য দক্ষ কর্মীর অভাব রয়েছে।
সাইবার নিরাপত্তা ঝুঁকি:
অটোমেটেড সিস্টেমগুলোতে সাইবার হামলার ঝুঁকি বাড়ছে।
পরিশেষে বলা যায়, বাংলাদেশের কর্মক্ষেত্রে ডিজিটাল অটোমেশন একটি অনিবার্য বাস্তবতা। দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বজায় রাখতে এটি সহায়ক হলেও, সরকারের উচিত হবে মানবসম্পদ উন্নয়নে বিনিয়োগ বাড়ানো এবং প্রযুক্তি পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে শ্রমিকদের জন্য ন্যায্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে ‘ন্যায়সঙ্গত রূপান্তর’ নিশ্চিত করা।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন