ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১৫ মে, ২০২৫

ভারত ও চীনের মধ্যে ‘নামসংঘাত’

আরিয়ান স্ট্যালিন
প্রকাশিত: মে ১৫, ২০২৫, ০৬:০৪ এএম
ছবি: রূপালী বাংলাদেশ

১৯৬২ সালের ঘটনা। পুরো এশিয়াকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল চীন ও ভারত যুদ্ধ। বিতর্কিত হিমালয় সীমান্তই ছিল যুদ্ধের মূল কারণ। ১৯৫৯ সালের তিব্বত বিদ্রোহের পর ভারত যখন দালাই লামাকে আশ্রয় দিয়েছিল, তখন দু’দেশের মধ্যে বেশ কয়েক দফা সীমান্ত সংঘর্ষ ঘটে। ১৯৬০ থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত ভারত চীনের প্রস্তাবিত কূটনৈতিক বন্দোবস্ত লাগাতারভাবে প্রত্যাখ্যান করার পর চীন ক্রমেই কঠোর হতে শুরু করে এবং ১৯৬২ সালের ৩০ এপ্রিল থেকে ভারত লাদাখে পূর্বে নিষিদ্ধ ঘোষিত ‘ফরোয়ার্ড টহল’ পুনরায় শুরু করে। চীন অবশেষে ১৯৬২ সালের ২০ অক্টোবর শান্তিপূর্ণ সমাধানের সমস্ত প্রচেষ্টা ত্যাগ করে লাদাখের ৩ হাজার ২২২ কিলোমিটার দীর্ঘ লম্বা হিমালয় সীমান্ত এবং ম্যাকমাহন লাইন পেরিয়ে বিতর্কিত অঞ্চল আক্রমণ করে। যুদ্ধের মূল কারণ ছিল আকসাই চীন এবং অরুণাচলের সার্বভৌমত্ব নিয়ে পারস্পরিক বিবাদ। ভারতের কাশ্মীর অংশের দাবি করা এবং চীনের ছিঞ্ছিয়াং অংশের দাবি করা আকসাই চিনের মধ্যে তিব্বত এবং ছিঞ্ছিয়াংকে সংযোগীকারী একটি পথ আছে। চীন এই পথ নির্মাণ করার প্রয়াস চালালে যুদ্ধের আরম্ভ হয় বলে মনে করা হয়। চীন ও ভারতের মধ্যে কোনো সশস্ত্র সংঘাত না হলেও, একধরনের ঠান্ডা লড়াই যে অব্যাহত রয়েছে, তা আবারও বোঝা গেল গতকাল বুধবার। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্য অরুণাচল প্রদেশের কিছু অংশের নতুন করে চীনা নাম রাখার বেইজিংয়ের বিরোধিতা করে একটি বিবৃতি দিয়েছে। চীনের পশ্চিম ও দক্ষিণ অংশে অবস্থিত তিব্বতের নিচের রাজ্য অরুণাচল প্রদেশকে চীন ইতিহাসগতভাবে তাদের প্রদেশ বলে মনে করে। সেই কারণে তারা মাঝেমধ্যেই এককভাবে অরুণাচল প্রদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের নামকরণ নিজেদের মতো করে। সম্প্রতি এ ঘটনা ঘটেছে আবার, যার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে ভারত।

মঙ্গলবার (১২ মে) রাজধানী নয়াদিল্লিতে ভারতের কেন্দ্রীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কার্যালয়ে আয়োজিত এক ব্রিফিংয়ে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল বলেছেন, ‘আমরা লক্ষ করেছি যে, চীন ভারতের অরুণাচল প্রদেশ রাজ্যের বিভিন্ন স্থানের নামকরণের নিরর্থক এবং অযৌক্তিক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। নীতিগত সিদ্ধান্তের সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রেখে আমরা এ ধরনের চেষ্টা সুস্পষ্টভাবে প্রত্যাখ্যান করছি। হঠাৎ নামকরণের মধ্য দিয়ে এই অনস্বীকার্য বাস্তবতাকে পরিবর্তন করা যাবে নাÑ অরুণাচল প্রদেশ ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল, আছে এবং থাকবে।’

চীন সম্প্রতি ভারতের সীমান্তবর্তী অরুণাচল প্রদেশের বেশ কিছু জায়গার নাম এককভাবে প্রকাশ করেছে। যে অঞ্চলগুলোর নামকরণ চীন করেছে, তার অধিকাংশই ভারতের মধ্যে। দক্ষিণ এশীয় প্রতিবেশীর সঙ্গে চীন কিছু বছর ধরে কূটনৈতিক সম্পর্ক উন্নত করার চেষ্টা চালাচ্ছে। তা সত্ত্বেও চীনের বেসামরিক নাগরিকবিষয়ক মন্ত্রণালয় অরুণাচল প্রদেশের স্থানগুলোর সর্বশেষ নাম প্রকাশ করে বলেছে, অরুণাচল প্রদেশ বা তাদের ভাষায় ‘জাংনান’ তিব্বতের স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের অংশ। মোট ২৭টি স্থানের নাম এবারে চীন তাদের মতো করে পরিবর্তন করেছে। এর মধ্যে রয়েছে ১৫টি পাহাড়, ৫টি আবাসিক এলাকা, ৪টি পাহাড়ের গিরিপথ, ২টি নদী ও ১টি হ্রদ। প্রতিটি স্থানের নাম চীনা অক্ষর, তিব্বতি ও পিনয়িন (মান্দারিন চীনার রোমান হরফে লেখা বানান) ভাষায় প্রকাশ করার পাশাপাশি মানচিত্রে স্থানগুলোর অক্ষাংশ এবং দ্রাঘিমাংশের স্থানাঙ্ক এবং একটি উচ্চ রেজল্যুশনের মানচিত্রসহ দেওয়া হয়েছে।

চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র লিন জিয়ান নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, চীনের সার্বভৌম অঞ্চলের আওতাভুক্ত এলাকায় অরুণাচলের কিছু অংশে নতুন করে নামকরণ করেছে বেইজিং। তাদের দাবি, ঝ্যাংন্যান (অরুণাচলকে এই নামে অভিহিত করে বেইজিং) মূলত দক্ষিণ তিব্বতের অংশ। তাদের এই দাবি প্রত্যাখ্যান করে ভারত বলেছে, কেবল নামকরণে সৃজনশীলতা দেখিয়ে বাস্তবতা পাল্টানো যাবে না। অরুণাচল সবসময়ই ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল, আছে ও ভবিষ্যতেও থাকবে। পূর্বেও অরুণাচলে একাধিক স্থানে নতুন নামকরণ করার প্রচেষ্টা করেছে চীন। এই নিয়ে দুই দেশের সম্পর্কে মাঝেমধ্যেই উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে ২০২০ সালে চীন-ভারত সীমান্তে এক প্রাণঘাতী সংঘর্ষের পর সম্পর্কের অবনতি আরও বাজে দিকে মোড় নেয়। তারও আগে ২০১৭ সালে বেইজিং অরুণাচল প্রদেশের ছয়টি স্থানের জন্য নামের প্রাথমিক তালিকা প্রকাশ করেছিল। এরপর ২০২১ সালে ১৫টি স্থানের একটি দ্বিতীয় তালিকা প্রকাশ করা হয়, ২০২৩ সালে আরও ১১টি। এদিকে, ভারত অরুণাচল প্রদেশে চীনের ভূখণ্ড দাবি করার প্রচেষ্টা প্রত্যাখ্যানে অটল। দেশটি দাবি করে আসছে, রাজ্যটি দেশের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং নতুন করে নামকরণ এই বাস্তবতাকে পরিবর্তন করবে না।

ভারতের অরুণাচলকে দক্ষিণ তিব্বত হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে নাম ঘোষণা করার চীনের এই চেষ্টা আজকের নয়। দীর্ঘ সময় ধরেই তারা এটা করছে এবং বস্তুত প্রতিবছরই করে। ২০২৪ সালের এপ্রিল মাসে চীন অরুণাচল প্রদেশের ৩০টি জায়গার নাম পরিবর্তন করে তাদের ভাষায় রেখে দিয়েছিল। ২০২৪ সালের এপ্রিলে চীন তার নিজস্ব ভাষায় অরুণাচল প্রদেশের ৩০টি স্থানের নাম পরিবর্তন করে। এর আগে ২০১৭ সালে অরুণাচল প্রদেশে ৬টি স্থানের নাম পরিবর্তন করে। এরপর ২০২১ সালে ১৫টি এবং ২০২৩ সালে ১১টি স্থানের নাম পরিবর্তন করে চীন। বর্তমানে চীন আবার অরুণাচল প্রদেশের অনেক জায়গার নাম পরিবর্তন করার চেষ্টা করছে। চীনের এই নামকরণের প্রক্রিয়ার পাল্টা প্রতিক্রিয়া হিসেবে ভারতও চীনের একাধিক জায়গার নামকরণ সংস্কৃত ভাষায় করেছে বা করছে। সেনাবাহিনীর যুদ্ধতথ্য বিভাগ কর্তৃক নাম পরিবর্তনের তালিকা চূড়ান্ত করা হয়েছে এবং শিগগিরই তা প্রকাশ করা হবে বলে জানানো হয়েছে। এর জন্য ভারত সরকার পশ্চিমবঙ্গে ১৭৮৪ সালে স্থাপিত এশিয়াটিক সোসাইটিকে তিব্বত স্বশাসিত অঞ্চলের বিভিন্ন জায়গার সাংস্কৃতিক ও বৌদ্ধিক নাম নিয়ে খুঁজে বের করার তাগাদা দিয়েছে বলেও ভারতের প্রচার মাধ্যম সূত্রে জানা গেছে।

প্রসঙ্গত, ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে ভারতের স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই উত্তরপূর্ব ভারতের সাত রাজ্য ‘সেভেন সিস্টার্স’-এর অন্যতম সদস্য অরুণাচলকে নিজেদের ভূখণ্ড বলে দাবি করে আসছে চীন। অরুণাচল সীমান্তের অপর পাশেই তিব্বত। চীনের দাবি, যে অরুণাচলকে ভারত নিজেদের বলে দাবি করছে, তা আসলে তিব্বতের দক্ষিণ অংশ। অরুণাচল প্রদেশের একটি নতুন নাম দিয়েছে চীন-জাংনান।

ভারতের দীর্ঘতম নদী ব্রহ্মপুত্রের উৎপত্তি হিমালয়ের পার্বত্য অঞ্চলের মানস সরোবরে। ভৌগোলিকভাবে এই সরোবরটি পড়েছে তিব্বতে। তারপর তিব্বত ও অরুণাচল, আসাম ও বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে ব্রহ্মপুত্র পড়েছে বঙ্গোপসাগরে। ব্রহ্মপুত্রের তিব্বত অংশের নাম ইয়ারলাং সাংপো এবং অরুণাচল অংশের নাম সিয়াং। ভারতকে চাপে রাখতে সম্প্রতি ব্রহ্মপুত্রের তিব্বত অংশে বিশ্বের সবচেয়ে বড় জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছে তিব্বত। যদি এই প্রকল্পের কাজ চীন শুরু করে, তাহলে ভারতের নদনদীগুলোতে তার গুরুতর প্রভাব পড়বে। বিজেপির অরুণাচল শাখার প্রেসিডেন্ট এবং লোকসভার এমপি তাপির গাও চীনের এই প্রকল্পকে ‘ওয়াটার বোম্ব’ বলে উল্লেখ করেছেন।