২৪-এর জুলাই-আগস্টে কোটাবিরোধী তথা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্বের প্রথম সারিতে ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী সামান্তা শারমিন। তৎকালীন ফ্যাসিস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের রক্তচক্ষু ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর দমন-নিপীড়নের মুখেও মাঠ ছাড়েননি তিনি। সেই রক্তক্ষয়ী আন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হলেও যে উদ্দেশ্য ও স্বপ্ন নিয়ে এ আন্দোলন, জাতীয় জীবনে তা কতটা পূরণ হয়েছে? এ নিয়ে রূপালী বাংলাদেশ-এর মুখোমুখি হয়েছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন নিজস্ব প্রতিবেদক এফ এ শাহেদ।
রূপালী বাংলাদেশ: গত এক বছরে জুলাই অভ্যুত্থানের প্রাপ্তি কতটুকু?
সামান্তা শারমিন: জুলাই অভ্যুত্থান হয়েছিল বলেই আমরা পরিবর্তনের আলোচনা করতে পারছি। পরিবর্তন, সংস্কারের বিষয়ে স্বাধীনভাবে প্রশ্ন করতে পারছি। বিগত ১৫ বছরের বেশি সময় মানুষের বাকস্বাধীনতা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছিল। গণমাধ্যম থেকে পুরো সমাজ, এমনকি রাষ্ট্রব্যবস্থাও একটি ফ্যাসিস্ট-দমবন্ধ অবস্থায় ছিল। সেই অবস্থা থেকে আমরা পরিত্রাণ পেয়েছি। অভ্যুত্থানের পর মানুষ তার অধিকারের কথা স্বাধীনভাবে বলতে পারছে। গণমাধ্যম স্বাধীনভাবে কাজ করছে। যদিও গণমানুষের প্রাপ্তির যে আশা ছিল সত্যিকার অর্থে সে স্থানে পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। তবে সবগুলো দল রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় একরুমে বসে আলোচনার সুবিধা পেত না, যদি জুলাই অভ্যুত্থান না হতো। অভ্যুত্থান-পরবর্তী যে জুলাই সনদ প্রস্তাবনা করা হয়েছে সব রাজনৈতিক দল একত্রে বসে কিছু বিষয়েও যদি একমত হতে পারে সেটিই হবে জুলাই অভ্যুত্থান দ্বারা অর্জিত।
রূপালী বাংলাদেশ: স্বৈরাচারী কাঠামোর বা বৈষম্যের সংস্কার কতটুকু হয়েছে?
সামান্তা শারমিন: ফ্যাসিস্ট সরকারের সময়ের যে কাঠামো এখনো সেই কাঠামোই আছে। বিগত সময়ে গুম-খুনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছিল পুলিশ বাহিনী। সেই সেক্টরে সংস্কার জরুরি ছিল। নির্বাচনকেন্দ্রিক বিভিন্ন সংস্কার নিয়ে তোড়জোড় চললেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংস্কারে দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেই। অথচ ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে অসংখ্য মানুষ তাদের হাতে নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এ বাহিনীর কার্যকর সংস্কার না হলে আগামীতে যারা ক্ষমতায় আসবেন তারাও আগের পথ অনুসরণ করতে পারেন। সেই অর্থে বৈষ্যমের কোনো কিছুই এখনো দূর হয়নি। রাষ্ট্র কাঠামো আগেরটাই আছে, সেই কাঠামো দূর করার জন্যই আমরা অনেকগুলো সংস্কার-প্রস্তাবনা রেখেছি।
রূপালী বাংলাদেশ: জুলাই সনদ প্রকাশে কেন দেরি হচ্ছে?
সামান্তা শারমিন: স্পষ্টভাবে বললে, যারা দেশের বিদ্যমান ফ্যাসিস্ট কাঠামো বজায় রাখতে চায়, যারা বিদ্যমান কাঠামোর মধ্য দিয়ে ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে চায়, ক্ষমতা ও একচ্ছত্র আধিপত্য দিয়ে স্বৈরতন্ত্র কাঠামো ফিরে পেতে চায় তাদের জন্যই মূলত সময়টা লাগছে। লক্ষ করতে হবে, দেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দলগুলো প্রত্যেক ঘটনাকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করছে। নাগরিকবান্ধব কোনো আন্তরিক কর্মসূচি তাদের নেই। গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী কিছু হচ্ছে না। ঐকমত্য কমিশনে একটি বিষয় যখন এগিয়ে যায় দেশের একটি বৃহৎ দল সেটি আবারও পিছিয়ে দেয়।
রূপালী বাংলাদেশ: অভ্যুত্থানের স্বপ্ন পূরণে রাজনৈতিক দলগুলোকে কী আহ্বান করছেন?
সামান্তা শারমিন: মৌলিক সংস্কারের প্রশ্নে একাত্ম হতে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি আহ্বান থাকবে। জনগণের মতামতকে বুঝে জনগণের প্রত্যাশার জায়গা বুঝে এবং বাংলাদেশে যাতে আর কখনো কোনোভাবেই কোনো স্বৈরতান্ত্রিক শাসনকাঠামো প্রতিষ্ঠিত হতে না পারে, সে জন্য মৌলিক সংস্কারের পক্ষে তারা যেন একাত্ম হয় সেই আহ্বান থাকবে।
মানুষের রক্তের মধ্য দিয়ে যে নতুন বাংলাদেশ অর্জিত হয়েছে সেই দেশে আর কোনো রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় এসে যেন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোতে মর্জিমতো দলান্ধ ব্যক্তিদের নিয়োগ না দিতে পারে, ইচ্ছামতো প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যবহার করতে না পারে— এমন পরিস্থিতি যদি কেউ তৈরি করতে চায় তাদের সঙ্গে বাংলাদেশের আপামর জনতার কোনো সংযোগ থাকবে না এবং কোনোভাবে একাত্ম হতে পারে না।