লকডাউন আর আপনজনের মৃত্যু। কাছের মানুষের থেকে দূরে থাকা। সঙ্গে আইসোলেশন। কোভিড বললেই মানুষের মনে প্রথম এসে ভিড় করে এসব ছবি। মহামারির বছরপাঁচেক পর ফের বিশ্বে করোনার উপসর্গ। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র, চিন, হংকং, সিঙ্গাপুর টপকে যা এখন ছড়িয়ে পড়ছে দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে। আবারও দেখা দিয়েছে সেই একই আতঙ্ক। পাশের দেশ ভারতেও হু হু করে বাড়ছে করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। দুটো ভ্যাক্সিন আর বুস্টার ডোজ নেওয়ার পরও শরীরে মিলছে করোনার উপসর্গ। বিগত কয়েক দিনে দেশটিতে এক হাজারের বেশি মানুষ এই ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে, যা নিয়ে উদ্বেগ বাড়ছে। ভারতের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে বুধবার (২৮ মে) টাইমস অব ইন্ডিয়া এই তথ্য জানিয়েছে।
ভারতের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত কয়েকদিনে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে মোট এক হাজার ৯ জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তি শনাক্ত হয়েছেন। নতুন সংক্রমণের এই ঢেউয়ে সবচেয়ে বেশি ভুগছে কেরালা, যেখানে ৪৩০ জন আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হয়েছেন। মহারাষ্ট্রে শনাক্ত হয়েছেন ২০৯ জন। এ ছাড়া দিল্লিতে ১০৪, গুজরাটে ৮৩, কর্ণাটকে ৪৭, উত্তর প্রদেশে ১৫ এবং পশ্চিমবঙ্গে ১২ জন করোনা রোগী শনাক্ত হয়েছে। এদের বেশির ভাগের শরীরেই করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্ট এনবি.১.৮.১-এর উপস্থিতি পাওয়া গেছে। সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি দেশটিতে করোনায় বেশকিছু মৃত্যুও দেখতে হয়েছে। ভারতের বিভিন্ন গণমাধ্যম জানিয়েছে, মহারাষ্ট্রে অন্তত চারজন, কেরালায় দুজন এবং কর্ণাটকে একজনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করা হয়েছে।
কোভিড ১৯ বলে ভাইরাসের যে ভ্যারিয়েন্ট ২০২০ সাল থেকে ২০২২ শেষ অবধি দাপট চালিয়েছিল গোটা বিশ্বে। আর তারপর আরও একটি ভ্যারিয়েন্ট আসে। চিকিৎসকরা তার নাম দেয় ওমিক্রন। চিকিৎসকরা জানান, এই ভ্যারিয়েন্ট কোভিড-১৯ এর থেকে কয়েকগুণ বেশি সংক্রমক হলেও একটাই সুবিধা। এই ভাইরাসের দৌড় আপনার গলা অবধিই। মানে কোভিডের মতো ফুসফুসে কোনো মারণ সংক্রমণ ঘটায় না। নতুন যে ভ্যারিয়েন্ট এনবি.১.৮.১-এ এখন মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে তাও ওমিক্রনেরই আরেকটি আপডেটেড ভার্সন।
সংবাদদাতারা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি সপ্তাহে অন্তত করোনায় ৩০০-এর বেশি মানুষ প্রাণ হারাচ্ছেন। আর ভারতেও এই রোগের প্রকোপ দ্রুত বাড়ছে। ভারতজুড়ে অন্তত ১০০০-এর বেশি মানুষ করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্টে আক্রান্ত হয়েছেন। ধারণা করা হয়ে থাকে, চীন থেকে প্রথম করোনা ভাইরাসের উৎপত্তি হয়েছিল। বাংলাদেশে কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত ব্যক্তির কথা প্রথম জানা যায় ৮ মার্চ, ২০২০ সালে। প্রথম মৃত্যুটি ঘটে ১৮ মার্চ, ২০২০ সালে। এরপরের দুই মাস দৈনিক শনাক্তের সংখ্যা ৩ অঙ্কের মধ্যে ছিল, যা বাড়তে বাড়তে জুলাই মাসে সর্বোচ্চে পৌঁছেছিল। ২ জুলাই সর্বোচ্চ ৪০১৯ জনের মধ্যে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয়েছিল। পরে ধীরে ধীরে করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে বাংলাদেশেও।
বর্তমানে সবচেয়ে ভয়াবহ যুক্তরাষ্ট্রের করোনা পরিস্থিতি। দেশটির রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্রের (সিডিসি) তথ্য অনুয়ায়ী, গত মাসের প্রতি সপ্তাহে সেখানে ৩৫০ জনের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন করোনায়। তবে দেশটির পরিস্থিতি কয়েক বছর আগের চেয়ে অনেক ভালো। এবিসি নিউজ করোনার বর্তমান পরিস্থিতিকে ‘উচ্চ ঝুঁকির পর্যায়ে’ বলে উল্লেখ করেছে। ডিউক ইউনিভার্সিটির সংক্রামক রোগ বিভাগের অধ্যাপক ডা. টনি মোডি এবিসি নিউজকে বলেন, ‘আমরা প্রতিদিনই মৃত্যু দেখছি। করোনা ছড়িয়ে পড়ছে। মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে।’ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভ্যাকসিনের স্বল্প প্রয়োগ, রোগ প্রতিরোধ শক্তির হ্রাস এবং এই চিকিৎসার অপ্রতুলতা মৃত্যু ডেকে আনছে। সিডিসি সংক্রমণের জন্য নতুন ভ্যারিয়্যান্ট এনবি.১.৮.১.কে দায়ী করেছে। চীন থেকে ছড়িয়ে পড়া এই ভ্যারিয়েন্টটি যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, মূলত স্পাইক প্রোটিনে থাকা নতুন ভাইরাস সংক্রমণতাকে বাড়ালেও মৃত্যু হার কমই থাকবে। বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, করোনার নতুন ভ্যারিয়েন্টের উপসর্গ সাধারণ ভাইরাল ফিভারের মতোই। গলা ব্যথা, সর্দি, জ্বর, কাশি, বমি বমি ভাব, মাথার যন্ত্রণা, মাথা ভার হয়ে থাকা, পেশীতে ব্যথা, শারীরিক দুর্বলতার মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে। তবে ফুসফুসে কোনো সংক্রমণ হওয়ার সুযোগ কম। যদিও চিকিৎসকদের মতে কোনো ব্যক্তির কোমর্বিডিটি বেশি হলে সাবধান থাকাটা গুরুত্বপূর্ণ। কারও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হলে তাঁকে আরও বেশি করে সতর্ক হতে হবে।
মার্কিন সংস্থা রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র (সিডিসি) জানাচ্ছে, এবার করোনা সংক্রমণের নেপথ্যে থাকা এই এনবি.১.৮.১ অত্যন্ত সংক্রামক। একসময় কোভিডের এই ভ্যারিয়েন্টই চীনে ছড়িয়ে পড়েছিল বিদ্যুৎগতিতে। আক্রান্ত হয়ে বহু মানুষকে ভর্তি হতে হয়েছিল হাসপাতালে। এখন সেই ভ্যারিয়েন্টটিরই দেখা মিলেছে নিউইয়র্ক সিটিসহ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন জায়গায়। এনবি.১.৮.১ স্ট্রেনটি প্রথম মার্চের শেষের দিকে এবং এপ্রিলের শুরুতে মার্কিন মুলুকের ক্যালিফোর্নিয়া, ওয়াশিংটন স্টেট, ভার্জিনিয়া এবং নিউইয়র্কের বিমানবন্দরে আগত আন্তর্জাতিক ভ্রমণকারীদের মধ্যে দেখা দেয়। এরপর থেকে ওহিও, রোড আইল্যান্ড এবং হাওয়াইতে আরও কিছু রোগী দেখা যেতে শুরু করে। যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তরফে নিশ্চিত করা হয়েছে যে, আক্রান্তের সংখ্যা কম। তবে মার্কিন বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, চীন এবং এশিয়ার আরও কয়েকটি দেশে যে ফের কোভিডের বাড়বাড়ন্ত হচ্ছে, তার কারণ এই এনবি.১.৮.১। মার্কিন বিশেষজ্ঞদের মতে, এই এনবি.১.৮.১ খুবই দ্রুত ছড়ায়। নিউইয়র্ক পোস্টে প্রকাশ, ইতিমধ্যেই বেশ সংক্রমণ ছড়াচ্ছে। বিশেষ করে বয়স্কদের মধ্যে এই স্ট্রেনের সংক্রমণ বেশি।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা হু এই উপপ্রজাতিকে ভ্যারিয়েন্ট আন্ডার মনিটরিং বলে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে। অর্থাৎ, এই উপপ্রজাতির সম্পর্কিত সবকিছু হু-র নিবিড় পর্যবেক্ষণে রয়েছে। নিউইয়র্ক পোস্টের একটি প্রতিবেদনে প্রকাশ, হকংয়ে মাত্র চার সপ্তাহে ৮১ জনের করোনা ধরা পড়েছে গুরুতর অবস্থায়। ৩০ জন করোনা আক্রান্তের মৃত্যুর খবরও পাওয়া গেছে। এদের বেশির ভাগেরই বয়স ৬৫ বছর বা তার বেশি।