ঢাকা শুক্রবার, ৩০ মে, ২০২৫

নির্বাচন নিয়ে বিএনপি-সরকার মুখোমুখি

রুবেল রহমান ও এফ এ শাহেদ
প্রকাশিত: মে ৩০, ২০২৫, ১২:৪৩ এএম
ছবি-রূপালী বাংলাদেশ

গত ১৬ বছরের ক্রমবর্ধমান দুর্নীতি, অপশাসন ও কর্তৃত্ববাদী শাসকদের জনবিচ্ছিন্নতার ফলে সাধারণ মানুষের অসন্তোষ চরমে পৌঁছায়। জনরোষের কালো মেঘ কালবৈশাখী রূপে তাণ্ডব চালায় স্বৈরতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে ২৪-এর জুলাই গণঅভ্যুত্থানে। তরুণ প্রজন্মের হাত ধরে আসা এই গণঅভ্যুত্থান সুযোগ সৃষ্টি করে নতুন বাংলাদেশ গড়ার। 

তবে, কাক্সিক্ষত নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে জনগণের নির্বাচিত সরকারই একমাত্র পথ হতে পারে বলে মনে করে দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি। তারা মনে করেন, যে কারণে আগমী ডিসেম্বরই নির্বাচন হতে হবে। এ দাবিতে নতুন ক্যাম্পেইন শুরু করেছে দলটির ‘ইন্টেরিম রিমেম্বার, ইলেকশন ইন ডিসেম্বর’। 

অন্যদিকে, গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসা অন্তর্বর্তী সরকার মনে করে, নতুন বাংলাদেশ গড়তে সংস্কারবিহীন নির্বাচন দেশকে এগিয়ে নিতে পারবে না। যথাযথ সংস্কার করে ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যেই নির্বাচন হবে। ফলে জাতীয় নির্বাচন ইস্যুতে মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার এবং দেশের বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি নির্বাচন নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারকে রীতিমতো আলটিমেটাম দিয়েছে।

 গত বুধবার ঢাকার নয়াপল্টনে এক সমাবেশে  বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান বলেছেন, ডিসেম্বরের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন দিতে হবে। ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। 

বিএনপির শীর্ষ এই নেতা বলেছেন, আগামী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে মনে হয়, এরই মধ্যে টালবাহানা শুরু হয়েছে বা চলছে। কথিত অল্প সংস্কার আর বেশি সংস্কারের আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে আগামী নির্বাচনের ভবিষ্যৎ। এরই ভেতরে জনগণ বিশ্বাস করতে শুরু করেছে, সংস্কার নিয়ে সময়ক্ষেপণের আড়ালে অন্তর্বর্তী সরকারের ভেতরে এবং বাইরে কারো কারো মনে হয়, ভিন্ন উদ্দেশ্য রয়েছে। 

বিশ্লেষকরা মনে করেছেন, জাতীয় নির্বাচন প্রশ্নে অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর চাপ বাড়াতে বিএনপির শীর্ষ পর্যায় থেকে এমন বক্তব্য দেওয়া হচ্ছে। তবে নির্বাচনের জন্য যে রাজনৈতিক চাপ বাড়ানো হচ্ছে, তাতে জনগণের চাওয়া-পাওয়ার বহিঃপ্রকাশ কতটুকু সে দিকটি অবশ্যই সরকারকে গুরুত্ব দিতে হবে। 

একই সাথে, সরকারকে তার অবস্থান থেকে স্পষ্ট করা উচিত, কেন ডিসেম্বরে নির্বাচন সম্ভব নয়। তারা কোন বিষয়গুলো সংস্কার করতে চান, সেগুলোর স্পষ্ট ধারণা দিতে হবে। অন্যদিকে, বৃহত্তর রাজনৈতিক দল বিএনপির মতামতকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখতে হবে।

বিএনপি যখন ডিসেম্বরে নির্বাচনের বিষয়ে অনড় তখন, নির্বাচন আয়োজনের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের গৃহীত সংস্কার উদ্যোগগুলোকে এগিয়ে নিয়ে যেকোনো পরিস্থিতিতে আগামী বছরের জুনের মধ্যে বাংলাদেশে একটি সাধারণ নির্বাচন আয়োজন করবে। 

তিনি আরো বলেছেন, সব দল নয়- শুধু একটি দলই ডিসেম্বরে নির্বাচন চায়। আগে কখনো নির্বাচন নিয়ে এভাবে সরাসরি বিএনপিকে ইঙ্গিত করে কথা বলেননি ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এতে রাজনৈতিক মহলে তৈরি হয়েছে নতুন অস্বস্তি।

এর আগে নির্বাচন, করিডোর ও সংস্কার নিয়ে সশস্ত্র বাহিনীর সাথে দূরত্ব তৈরি হয়েছিল। তখন ডিসেম্বরেই নির্বাচন হবে- একথা বলেছিলেন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ জামান। সেনা কর্মকর্তাদের উদ্দেশ্যে অফিসার্স অ্যাড্রেসে সংস্কার ও করিডোর নিয়ে মতামত জানিয়েছিলেন তিনি। তখনই রাজনৈতিক অঙ্গনে দেখা দেয় গুমোট পরিস্থিতি।

এরপর বিএনপি-জামায়াত-এনসিপিসহ রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে বৈঠক করেন প্রধান উপদেষ্টা। দৃশ্যত নিজের পক্ষে রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থন আদায় করে নিয়েছিলেন তিনি। 

প্রধান উপদেষ্টার সাথে রাজনৈতিক দলের বৈঠকের পর দৃশ্যত সশস্ত্র বাহিনীর সাথে সরকারের সমন্বয়হীনতা কেটে যায়। তবে  নির্বাচন নিয়ে সরাসরি মুখোমুখি অবস্থানে চলে গেছে সরকার ও বিএনপি। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকের দুদিন পর নির্বাচন নিয়ে নিজেদের হতাশার কথা জানায় বিএনপির সিনিয়র নেতারা। 

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, সরকারের ভেতর-বাইরে ভিন্ন কোনো মতলব আছে। সংস্কারের দোহাই দিয়ে নির্বাচন নিয়ে তারা কোন ষড়যন্ত্র করছে কী না তা নিয়ে সন্দেহ বাড়ছে মানুষের মাঝে। সরকার বলেছিল অল্প সংস্কার চাইলে ডিসেম্বের নির্বাচন সম্ভব। দেশে এমন কি ঘটলো তারা জুন চলে গেলো। 

আগামী ১ মাসের মধ্যেই সংস্কার শেষ করা সম্ভব। রাজনৈতিক দলগুলো যে সব বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে, নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে যেসব সংস্কার কেন করছে না। যাই বলুক নির্বাচন ডিসেম্বরেই হওয়া ভালো। যদি সরকার টালবাহানা করে তবে আমরা রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে বসে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করব। ভোটের দাবিতে গত দেড় দশকতো রাজপথেই ছিলাম নাকি? এখনো যদি ভোটের জন্য আন্দোলন করতে হয় সেটি হবে দুঃখজনক। 

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা আশঙ্কা করছেন, বিএনপি  নির্বাচনের দাবিতে মাঠে নামার হুমকি দিলেও এখন পর্যন্ত কোন কর্মসূচি দেয়নি। নির্বাচন আদায়ে বিএনপি আন্দোলন শুরু করলে ফের উত্তপ্ত হয়ে উঠবে দেশের রাজনীতি। আর তেমন পরিস্থিতিতে ঘটে যেতে পারে ভিন্ন রকম কিছু। 

নির্বাচন নিয়ে সরকার ও বিএনপির মুখোমুখি অবস্থান নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কাজী মাহবুবুর রহমান রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, দেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণের জন্য দ্রুত নির্বাচনের বিকল্প নেই। একই সাথে, অন্তর্বর্তী সরকারের স্বচ্ছতার জন্য রাজনৈতিক দল ও জনগণের চাওয়াকে প্রাধান্য দিয়ে দ্রুত সময়ে নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা উচিত। জনগণের ভোটাধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার দায় সরকারের, ফলে তাদের দায়মুক্ত হতে হবে। 

তিনি বলেন, বাংলাদেশে সব থেকে বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি, তারা যদি শক্ত অবস্থান নেয় এবং সরকারকে সহযোগিতা না করে তবে সরকারকে দুর্বল করবে। সেই স্থান থেকে সরকার এবং বিএনপির উচিত একে অন্যের সঙ্গে আলাপের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করা। একইভাবে সরকার যদি বিএনপির দাবির যথার্থ মূল্যায়ন করতে না পারে তবে এটিও তাদের ব্যর্থতা। যদি নির্বাচন ইস্যুতে সুষ্ঠু সমাধান না আসে তবে সরকারই দায়ী থাকবে। 

তিনি আরো বলেন, মহাসংকটের পরও ৩ মাসের মধ্যে নির্বাচনের ইতিহাস আছে। একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের উদ্যোগ নিলে ৩ মাসই পর্যাপ্ত সময়। দেশে যত ভালো নির্বাচন হয়েছে তার জন্য তিন মাসের সময় পর্যাপ্ত ছিল। সরকারকে নাগরিকদের মনোভাব বুঝতে হবে। 

এদিকে, চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই সংসদ নির্বাচনের দাবিতে নতুন ক্যাম্পেইন শুরু করেছে বিএনপি। ‘ইন্টেরিম রিমেম্বার, ইলেকশন ইন ডিসেম্বর’ শিরোনামে ক্যাম্পেইন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে তাদের ভেরিফায়েড পেজ থেকে শুরু করা হয়েছে। গত বুধবার ঢাকায় অনুষ্ঠিত তারুণ্যের সমাবেশে বক্তব্য দেওয়ার সময় বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান পরিষ্কার করে দেন, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে হবে। এর পরই নতুন ক্যাম্পেইন শুরু করে দলটি। 

উল্লেখ্য, প্রধান উপদেষ্টার পদত্যাগের খবর ছড়িয়ে পড়লে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বৈঠক হয়। যেখানে প্রধান উপদেষ্টার প্রতি বিএনপির সমর্থনের যে আশা করেছিল অন্তর্বর্তী সরকার তা পূরণ করে বিএনপি। বিএনপি জানায়, তারা প্রধান উপদেষ্টার পদত্যাগ চায় না। ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের রোডম্যাপ চায়। 

তবে রোডম্যাপের বিষয়ে যথার্থ কোনো উত্তর সরকারের পক্ষ থেকে না আসায় বিএনপির তারুণ্যের সমাবেশে অন্তর্বর্তী সরকারের মনোভাব নিয়ে প্রশ্ন তোলেন বিএনপির সিনিয়র নেতারা। নির্বাচনের রোডম্যাপ না দেওয়াকে ক্ষমতা ধরে রাখার লোভ বলে বর্ণনা করেন তারা। সংস্কার নিয়ে সরকারের কার্যক্রমকে নির্বাচন পেছানোর কৌশল বলেও আখ্যা দেন বিএনপি নেতারা। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও পরোক্ষভাবে সেই ইঙ্গিত দিয়েছেন।