মঙ্গলবার, ০৩ জুন, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


স্বপ্না চক্রবর্তী

প্রকাশিত: জুন ২, ২০২৫, ০৫:৩৬ এএম

ঢাকায় ঘরে ঘরে জ্বর, নতুন ভাইরাসের শঙ্কা 

স্বপ্না চক্রবর্তী

প্রকাশিত: জুন ২, ২০২৫, ০৫:৩৬ এএম

ছবিঃ রূপালী বাংলাদেশ

ছবিঃ রূপালী বাংলাদেশ

সংবাদকর্মী মো. মুজিবুর রহমানের ছোট ছেলে জিবরান। পাপ্পা বলেই ডাকতেন তাকে। গত ১৪ মে অন্যদিনের মতো স্কুল-কোচিং, খেলাধুলা করে কাটে। সন্ধ্যার পর আসে সামান্য জ¦র। রাত যত বাড়তে থাকে, থার্মোমিটারে তাপমাত্রার পারদ ততই বাড়তে থাকে। ভোর হতেই পার্শ্ববর্তী হাসপাতালে নিয়ে যান। কিন্তু ততক্ষণে সব শেষ। জীবনের কাছে হেরে যায় জিবরান। মাত্র এক বেলার  জ্বরে এমনভাবে কেউ মৃত্যুর কোলে ঢলে যেতে পারে দেখে নির্বাক চিকিৎসকেরাও। দিশেহারা বাবা মুজিবুর রহমানের বিলাপ, ‘আমার পাপ্পাটা আমাকে একটু সময় পর্যন্ত দিল না চিকিৎসা করানোর। এ কী রকম  জ্বর হলো তার?’

বাড্ডার বাসিন্দা ব্যাংক কর্মী সুচন্দা মিত্রের বড় ছেলে ঈশানের  জ্বর আসে গত শুক্রবার। এক রাতের ব্যবধানে  জ্বরের তীব্রতা থার্মোমিটারের পারদে ছাড়ায় ১০২ থেকে ১০৪-এর ঘর। আতঙ্কিত হয়ে তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে চিকিৎসা শুরু করতে না করতেই  জ্বরে আক্রান্ত হয় ছোট ছেলে নিশানও। তাদের নিয়ে ঘরে যখন ত্রাহি অবস্থা, এমন সময় সুচন্দার শাশুড়ি সুমনা মিত্রও আক্রান্ত হন  জ্বরে, যা এখনো নিয়ন্ত্রণে আসেনি। ডাক্তারের কাছে গেলে সাধারণ ‘ফ্লু’ বললেও নিবিড় পর্যবেক্ষণের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। অবস্থা বেগতিক দেখলে সঙ্গে সঙ্গে যেন হাসপাতালে ভর্তি করা হয়, সে বিষয়েও সতকর্তা দেন চিকিৎসক।

কিন্তু ফ্লু না কোনো নতুন ভাইরাস, তা নিয়ে খোদ ডাক্তারও দ্বিধায় রয়েছেন বলে দাবি করেছেন প্রায় এক সপ্তাহ যাবত  জ্বরে আক্রান্ত স্বামীকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকা নিফাত আরা।

তিনি বলেন, প্রথম প্রথম তো ভেবেছিলাম মৌসুমি  জ্বর। কিন্তু স্বামী আক্রান্ত হওয়ার দুই দিন পরেই মেয়েও আক্রান্ত হয়। দুজনের সেবা করতে করতে গত শনিবার থেকে আমিও  জ্বরে আক্রান্ত হয়েছি। ডাক্তাররা বলতেই পারছেন না এর কারণ কী?

শুধু মুজিবুর রহমান, সুচন্দা মিত্রের পরিবার নয়, আবহাওয়ার পারদ ওঠা-নামার সঙ্গে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় ঘরে ঘরে  জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। আপাতদৃষ্টিতে চিকিৎসকেরা এটিকে ‘ফ্লু’ হিসেবে আখ্যায়িত করলেও কেউ কেউ বলছেন, এটি নতুন কোনো ভাইরাসের আক্রমণও হতে পারে। যেহেতু ডেঙ্গু-করোনা নেগেটিভ আসছে পরীক্ষায়, তাহলে নতুন কোনো রোগের সংক্রমণ কি না, তা পরীক্ষা করে কারণ খুঁজে বের করতে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট আইইডিসিআরকে গবেষণার তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। যদি নতুন কোনো ভাইরাসের লক্ষণ পাওয়া যায়, তাহলে দ্রুত এর প্রতিষেধকের ব্যবস্থা করারও তাগিদ দিয়েছেন তারা।

বৈশাখের শুরুতে তাপপ্রবাহ বাড়লেও চৈত্রের শুরুতেই ঝড়-বৃষ্টিতে তাপমাত্রায় একটা শিথিলতা বিরাজ করছে। এটা স্বাভাবিক হলেও হঠাৎ করেই আবার বেড়ে যাচ্ছে তাপমাত্রা। এমন অবস্থায় হাসপাতালগুলোতে মৌসুমি রোগী বাড়ছে প্রতিদিন। ডায়রিয়া, হাঁপানিসহ নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশুরাই বেশি ভর্তি হচ্ছে হাসপাতালে। এর মধ্যে নতুন করে ঘরে ঘরে মানুষের জ¦রে আক্রান্ত হওয়াকে অস্বাভাবিক হিসেবেই দেখছেন বিশেষজ্ঞরা।

এমন পরিস্থিতিতে অন্যান্য রোগের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে  জ্বরের রোগী বাড়ছে স্বীকার করে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেনিন চৌধুরী রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, এই সময়টায় আমরা কয়েক রকমের  জ্বরের রোগী পাচ্ছি। এর মধ্যে ভাইরাল ফ্লু, শ্বাসতন্ত্রে সংক্রমণ, ডেঙ্গু, করোনা, চিকুনগুনিয়া, পানিবাহিত রোগ, টাইফয়েডের রোগী রয়েছে। যখন জলবায়ু পরিবর্তন হয়, তখন নতুন কতগুলো ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব হয়, যা নিষ্ক্রিয় ভাইরাসকে সক্রিয় করে তোলে। আমার মনে হয়, যে বাচ্চাটা মারা গেল বা যেসব বাচ্চার শরীর খুব খারাপ হয়ে গেছে, খুবই মর্মান্তিক হলেও তাদের যথাযথ পরীক্ষা-নিরীক্ষার আওতায় নিয়ে আসতে হবে। ডেঙ্গু, করোনা, চিকুনগুনিয়া বা ভাইরাল ফ্লু যদি না হয়, তাহলে সেটি কী একমাত্র আইইডিসি’আরই তা বলতে পারে। তাই আমার আহ্বান থাকবে, তারা যেনো কাজটি তাদের অন্য স্টেকহোল্ডারদের নিয়ে করে। 

এ বিষয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডা. তুষার মাহমুদ রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘আমাদের কাছে প্রতিদিনই এমন রোগী আসছে, যাদের পুরো পরিবারই  জ্বরে আক্রান্ত। এর একটি কারণ হতে পারে হঠাৎ করে তীব্র গরমের পরে বৃষ্টির শীতল বাতাস। কিন্তু এমন  জ্বরের কারণ খুঁজে বের করার জন্য অবশ্যই গবেষণার প্রয়োজন। অনেকে এটিকে এডিনো ভাইরাস বলছেন। কিন্তু কোনো গবেষণা ছাড়া এটি জোর দিয়ে বলা মুশকিল। যদি নতুন করে কোনো ভাইরাসেরও আক্রমণ হয় এটি, তাহলে আমাদের ভাবতে হবে। যেহেতু ডেঙ্গুর তীব্রতাও শুরু হয়ে গেছে। সে ক্ষেত্রে  জ্বরে পড়লে অনেকে এটিকে ডেঙ্গু মনে করেও চিকিৎসা নিতে পারেন। কিন্তু ডেঙ্গু শনাক্তে নির্দিষ্ট পরীক্ষা আছে। তাই সবাইকে এ সময়টায় সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে হবে। এই সময়ে অ্যাজমা রোগীদের ২৪ ঘণ্টায় অন্তত দুই থেকে আড়াই লিটার পানি পান করতে হবে। ইলেকট্রোলাইট ইমব্যালেন্স বা শরীরে লবণের ভারসাম্য কমে যেতে পারে। এতে স্থূল, কিডনি বিকল রোগী ও বয়স্কদের বেশি ঝুঁকি হতে পারে। ডায়াবেটিস, হাঁপানি, ব্রংকাইটিস, কেমোথেরাপি চলা ক্যানসার রোগী ও স্টেরয়েড ওষুধ সেবনকারীদের তাপপ্রবাহ এড়িয়ে চলতে হবে। হাঁপানি, অ্যালার্জি, রাইনাইটিস, গলাব্যথা, গলার প্রদাহ থাকলে অতিরিক্ত ঠান্ডা পানি পান থেকে বিরত থাকতে হবে। 

হাসপাতালে বাড়ছে রোগী: এদিকে ঠান্ডা রোগীর সঙ্গে সঙ্গে  জ্বরের রোগীরও ভিড় বাড়ছে রাজধানীর হাসপাতালগুলোতে। রাজধানীর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, মুগদা জেনারেল হাসপাতালসহ বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে বেড়েছে রোগীর পরিমাণ।

চিকিৎসকেরা বলছেন, দাবদাহে শিশু, বয়স্ক ও কোমরবিডিটি (বিভিন্ন ধরনের রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি) রোগীরা বেশি বিপাকে পড়ছেন। শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. শাফিউর রহমান রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, দেশে কয়েক দিন ধরে তাপমাত্রা বিচিত্র আচরণ করছে। অতিরিক্ত গরমে অসুস্থ হয়ে মানুষ হাসপাতালে আসছে। আবার বৃষ্টিতে ভিজেও অসুস্থ হয়ে অনেকে হাসপাতালে আসছে। তারা  জ্বর, হাইপারটেনশন বা উচ্চ রক্তচাপ, মাথাব্যথা, হিটস্ট্রোক, বমি, ডায়রিয়া, অ্যাজমা ও শ্বাসকষ্টের কথা বলছে। গলাব্যথা, কাশি, সর্দি ও ঘুমের সমস্যা বেড়ে যাওয়ার কথাও বলছে অনেকে। আমরা আমাদের সাধ্যমতো চিকিৎসা দিচ্ছি।

তবে সবচেয়ে বেশি রোগী ভিড় করছে রাজধানীর শিশু হাসপাতালে। হাসপাতালটিতে প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে শিশুদের ভর্তি করাতে নিয়ে আসছেন অভিভাবকেরা। রাজধানীর কামরাঙ্গীর চর থেকে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত শিশুসন্তানকে ভর্তি করাতে নিয়ে আসা রোগীর মা ইফফাত আরা বলেন, বৃষ্টিতে ভিজে ৪ বছরের বাচ্চার  জ্বর ওঠে প্রথমে। পরে জন্মের সময় হওয়া নিউমোনিয়া ফের বেড়ে যায়। তীব্র শ্বাসকষ্ট হওয়ায় সকাল সকালই হাসপাতালে নিয়ে এসেছি। ডাক্তাররা ভর্তি করাতে বলেছেন।

এ সময় শিশুদের প্রতি বিশেষ যত্ন নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে শিশু হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মাহবুবুল আলম রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, আবহাওয়ার যে অবস্থা, তাতে করে প্রাপ্তবয়স্করাই কাহিল হয়ে পড়ছেন। এমন অবস্থায় শিশুদের তো কষ্ট বেশিই হবে। যাদের অ্যাজমা বা নিউমোনিয়ার সমস্যা রয়েছে, তা আবারও বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

বিশেষজ্ঞদের সতর্কতা: এ সময়ে বাড়তি সতর্কতার প্রয়োজন জানিয়ে ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এ বি এম আবদুল্লাহ রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, এই সময়ে যারা দীর্ঘক্ষণ বাইরে কাজ করে, তাদের রোদ-বৃষ্টিতে নানান রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।  যদি রোদে কাজ করে, তাহলে দুই ঘণ্টা পর পর কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেবে। কৃষক ও রিকশাচালকদের মতো যারা রোদ-বৃষ্টিতে পরিশ্রম করেন, তাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি সবচেয়ে বেশি। পাশাপাশি ডায়াবেটিস ও কিডনি বিকলসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত, বয়স্ক ও শিশুরাও ঝুঁকিতে রয়েছে। এ সময় ঘরের বাইরে যতটা কম যাওয়া যায়, ততই ভালো। যারা প্রয়োজনে বাইরে যাচ্ছে, তারা পানির সঙ্গে একটু লবণ মিশিয়ে স্যালাইনের মতো করে খেতে পারে।

তবে  জ্বর হলে অবশ্যই আগে ডেঙ্গু টেস্ট করানোর পরামর্শ দিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবু জাফর। রূপালী বাংলাদেশকে তিনি বলেন, ‘আমরা বিভিন্ন এলাকা থেকে খবর পাচ্ছি, লোকজন  জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছে। এটি ডেঙ্গু, করোনা, নাকি অন্য কোনো ভাইরাস, তা গবেষণা না হওয়া পর্যন্ত রোগীর পরিবারকে সচেতন থাকতে হবে।  জ্বরে আক্রান্ত হলে অবশ্যই সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। ডেঙ্গু ও করোনা উভয় টেস্ট করিয়ে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা নিতে হবে। অন্যথায় যে কোনো ধরনের বিপদ ঘটতে পারে।

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!