ঢাকা মঙ্গলবার, ২২ জুলাই, ২০২৫

জুলাই ২৪-মে ২৫ ধীরে চলছে শিক্ষার ৬০ প্রকল্প

উৎপল দাশগুপ্ত
প্রকাশিত: জুলাই ২২, ২০২৫, ০২:৩১ এএম

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের আওতাধীন ৬০ উন্নয়ন প্রকল্প চলছে ধীরগতিতে। এতে চলতি অর্থবছরে অর্থাৎ ২০২৪ সালের জুলাই থেকে চলতি বছরের মে পর্যন্ত ১১ মাসে প্রকল্পগুলো শতভাগ কাক্সিক্ষত লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে পারেনি। ৬২টি প্রকল্পের মধ্যে মাত্র দুটি প্রকল্প লক্ষ্যমাত্রার ৯৯ শতাংশ অর্জন করতে পেরেছে। কিছু প্রকল্পের অগ্রগতি সর্বোচ্চ ৭০ শতাংশ হলেও লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেকও পূরণ করতে পারেনি অনেক প্রকল্প। অন্যদিকে ৮টি প্রকল্পের অগ্রগতি একেবারে শূন্য। মূল বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) বাজেট অর্ধেক করার পরও চলতি অর্থবছরে সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (আরএডিপি) বাজেট শতভাগ খরচ করতে না পারায় প্রকল্প বাস্তবায়নে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।

এতে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের কর্মক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। বিষয়টি নিয়ে ক্ষুব্ধ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ও। বাস্তবায়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে না পারার কারণ অনুসন্ধান চলছে। ব্যর্থতার জন্য ইতিমধ্যে কয়েকটি প্রকল্পের পরিচালককে বাদ দেওয়ার চিন্তাও করা হচ্ছে। এ মাসের শেষে চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (আরএডিপি) বাস্তবায়ন অগ্রগতি নিয়ে চলতি অর্থবছরের সভা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। সেই সভাতেই প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যর্থতার কারণ চূড়ান্ত শনাক্ত করে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হতে পারে। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের গত জুন মাসের আরএডিপি বাস্তবায়ন অগ্রগতি পর্যালোচনা সভার কার্যবিবরণী ও প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত আরএডিপির ওই সভায় সভাপতিত্ব করেন শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. চৌধুরী রফিকুল আবরার। সভায় মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সিনিয়র সচিব সিদ্দিক জোবায়ের, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন শাখার অতিরিক্ত সচিব, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মহাপরিচালক, পরিকল্পনা কমিশনের প্রতিনিধি, বিশ^বিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) প্রতিনিধি, প্রকল্প পরিচালক ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। 

সভার কার্যবিবরণী থেকে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরে আরএডিপিতে ৬২টি প্রকল্পের বিপরীতে ৫ হাজার ৪১৩ কোটি ৮০ লাখ টাকা বরাদ্দ ছিল। এই বরাদ্দের বিপরীতে চলতি বছরের মে পর্যন্ত খরচ হয়েছে ৩ হাজার ৪৪৯ কোটি ৮২ লাখ টাকা। এই খরচ মোট বরাদ্দের ৬৩.৭২ শতাংশ। অর্থাৎ খরচ কম হয়েছে ৩৬.২৮ শতাংশ। যা আরডিপিতে মোট বরাদ্দ থেকে ৫০০ কোটি টাকা কম। একই সময়ে জাতীয় অগ্রগতি হয়েছে ৪৯ দশমিক ৮ শতাংশ।

কার্যবিবরণীতে প্রকল্পওয়ারী অগ্রগতির তথ্য থেকে জানা গেছে, জুলাই ২০২৪ থেকে মে ২০২৫ পর্যন্ত ৬২টি প্রকল্পের মধ্যে ২৪টি প্রকল্পের অগ্রগতি ৭০ শতাংশের ওপরে। ৬টি প্রকল্পের অগ্রগতি ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ। ৭টি প্রকল্পের অগ্রগতি ৪০ থেকে ৬০ শতাংশ। ১০টি প্রকল্পের অগ্রগতি ২০ থেকে ৪০ শতাংশ। ৭টি প্রকল্পের অগ্রগতি ২০ শতাংশ। আর ৮টি প্রকল্পের অগ্রগতি শূন্য শতাংশ। এসব প্রকল্পের মধ্যে ‘ঢাকা শহর সন্নিকটবর্তী এলাকায় দশটি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপন প্রকল্প (২য় সংশোধিত)’ ও ‘৯টি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় স্থাপন (২য় সংশোধিত)’ প্রকল্প দুটি লক্ষ্যমাত্রার ৯৯ শতাংশ অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।  

আরও জানা গেছে, ৬২ প্রকল্পের মধ্যে ১০ প্রকল্প সংশোধনের জন্য প্রস্তাব করা হয়েছে। এই ১০ প্রকল্পের মধ্যে ২টি প্রকল্প মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগে প্রক্রিয়াধীন, ৫টি পরিকল্পনা কমিশনে, ২টি প্রকল্পের প্রশাসনিক আদেশ জারি করা হয়েছে, ১টি প্রকল্প সংস্থায় প্রক্রিয়াধীন। এ ছাড়া ১টি প্রকল্পের মেয়াদ বৃদ্ধির প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে।

সভাপতির বক্তব্যে শিক্ষা উপদেষ্টা বলেন, প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রকল্প পরিচালকের যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা যাচাইয়ের অন্যতম সূচক হলো বছর শেষে আরএডিপিতে বরাদ্দকৃত অর্থ শতভাগ ব্যয় করা। এটি না হলে প্রকল্প পরিচালকের দক্ষতার অভাবসহ প্রকল্প বাস্তবায়নে ব্যর্থতা প্রমাণিত হয়। এতে মন্ত্রণালয়ের সামগ্রিক কর্মক্ষমতা প্রশ্নের মুখে পড়ে।  
সভায় সিনিয়র সচিব বলেন, অর্থবছর শেষে সকল প্রকল্প পরিচালকের কার্যক্রম মূল্যায়ন করা হবে। যে সব প্রকল্প পরিচালকের পারফরম্যান্স সন্তোষজনক নয় এমন প্রকল্প পরিচালকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। প্রকল্প পরিচালকদের গাফিলতির কারণে মন্ত্রণালয়ের সুনাম ক্ষুণœ হলে তাদের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হবে।
অতিরিক্ত সচিব (পরিকল্পনা) বলেন, একটু সচেতন হলেই প্রকল্প পরিচালকদের খোঁড়া যুক্তি উত্তরণ করে সফলভাবে প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব ছিল।

সভায় উপস্থিত সূত্র জানিয়েছে, ৬২ প্রকল্পের মধ্যে ৩১টি প্রকল্প বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) আওতাধীনে বাস্তবায়িত হচ্ছে। সভায় এসব প্রকল্পের অগ্রগতি না হওয়া নিয়েই বেশি আলোচনা হয়। বৈশি^ক করোনা মহামারি, গত বছরের ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে বিশ^বিদ্যালয়ে অচলাবস্থা, প্রশাসনে পরিবর্তন ইত্যাদি নানা কারণে ইউজিসি প্রকল্পগুলোর লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি বলে সভায় উল্লেখ করা হয়।  এ ছাড়া চলমান থাকা অবস্থায় প্রকল্পের নীতিগত সিদ্ধান্তে পরিবর্তন, কমপোনেন্টে (প্রকল্পের অঙ্গ) পরিবর্তন ইত্যাদি কারণে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তরের আওতাধীন কয়েকটি প্রকল্প ভালো চলেনি বলে দাবি করেছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।

 
আলোচনার পর সভায় বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সিদ্ধান্তগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোÑ আগামী অর্থবছরে বাস্তবায়ন শতভাগ নিশ্চিত করতে দ্রুত প্রকল্পের কর্মপরিকল্পনা ও ক্রয় পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। যেসব প্রকল্পের অগ্রগতি হতাশাজনক, সেসব প্রকল্পের পরিচালকদের বিরুদ্ধে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। প্রয়োজনে প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হবে। বাস্তবায়নাধীন প্রকল্পের ঘটনা-উত্তর অনুমোদন দেওয়া যাবে না। 

অন্যদিকে প্রকল্পভিত্তিক সিদ্ধান্তের মধ্যে রয়েছে ইউজিসির দুটি প্রকল্পের ১. ‘ইমপ্রুভিং কম্পিউটার অ্যান্ড সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং টারশিয়ারি এডুকেশন প্রজেক্ট (আইসিএসইটিইপি)’ ও ‘হায়ার এডুকেশন এক্সিরারেশন এবং ট্রান্সফরমেশন (হিট)’ হতাশাজনক অগ্রগতি মূল্যায়ন করে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা। এ ছাড়া ‘শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ের অধিকতর উন্নয়ন (২য় পর্যায়)’ প্রকল্প পরিচালকের ওপর নিবিড় তদারকি করে

অদক্ষতা প্রমাণিত হলে উপযুক্ত প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ দিতে হবে।
বাস্তবায়ন লক্ষ্যমাত্রার ৯৯ শতাংশ অর্জন করা ১০ স্কুল প্রকল্পের পরিচালক ড. মীর জাহিদা নাজনীন আশা প্রকাশ করেন, ২০২৭ সালের নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই প্রকল্পের কাজ শেষ করা যাবে। তিনি জানান, আগামী বছরের এপ্রিলের মধ্যে ধামরাই, নবীনগর ও হেমায়েতপুরের তিনটি স্কুল সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে বুঝিয়ে দেওয়া হবে।  

বৈশ্বিক করোনা পরিস্থিতি ও রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের কারণে ইউজিসির প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন কাক্সিক্ষত পর্যায়ে হয়নি বলে রূপালী বাংলাদেশকে জানিয়েছেন ইউজিসির পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ মাকছুদুর রহমান ভূঁইয়া। হিট প্রজেক্ট ভালো চললেও টারশিয়ারি প্রজেক্টটির অবস্থা খারাপ বলেও তিনি মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, ২০১৮ সালে প্রকল্প শুরু হওয়ার পর বৈশি^ক করোনা মহামারির কারণে প্রকল্পের অগ্রগতি কমে যায়, যা এখনো পূরণ করা সম্ভব হয়নি। এ ছাড়া আমার বিবেচনায় হিট প্রকল্পটি মোটামুটি ঠিকই আছে। এই প্রকল্পের ১২০০ কোটি টাকার মধ্যে ৬০০ কোটি টাকা দ্রুতই খরচ হবে। এতে বাস্তবায়নের হারও বাড়বে। তবে টারশিয়ারি প্রকল্পে ঢাকা, বুয়েট ও যশোর বিশ^বিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। এই তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিকল্পনা অনুযায়ী ভবন না হওয়ায় বাস্তবায়ন হার কমে গেছে। সবাই আন্তরিক হলে হয়তো সম্ভব হতো। 

উজিসির আইসিএসইটিইপি বা টারশিয়ারি প্রকল্পের দায়িত্বে ছিলেন খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. আমিনুল হক। সম্প্রতি এই পদে আরেকজনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। রূপালী বাংলাদেশকে তিনি বলেন, এটি একটি বিশেষ ধরনের প্রকল্প। বুয়েট, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় ও যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ে বড় তিনটি ভবনসহ কম্পিউটার সংক্রান্ত নানা বিষয় ছিল এই প্রকল্পে। ভবন নির্মাণের জন্য টেন্ডার হয়েছে। তবে কিছু জটিলতার কারণে কাক্সিক্ষত অগ্রগতি হয়নি। এসব ভবন নির্মাণের জন্য ৭৫ শতাংশ কাজে সংশ্লিষ্টতা বিশ^বিদালয় কর্তৃপক্ষের। কিন্তু নানা সমস্যায় এটি হয়নি। ফলে আরএডিপি বাস্তবায়নও আশানুরূপ হয়নি। 

ইউজিসির হিট প্রকল্পের দায়িত্বে রয়েছেন প্রফেসর ড. আসাদুজ্জামান। আরএডিপি বাস্তবায়নের বিষয়ে রূপালী বাংলাদেশকে তিনি বলেন, কাগজপত্র না দেখে কতটা বাস্তবায়ন হয়েছে তা বলতে পারব না, তবে শতভাগ হয়নি। অন্যদিকে চট্টগ্রামের ভেটিরিনারি অ্যান্ড অ্যানিম্যাল সায়েন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ঢাকার পূর্বাচলে টিচিং ও ট্রেনিং পেট  (পোষা প্রাণী) হাসপাতাল ও কক্সবাজারে এ-সংক্রান্ত গবেষণা কার্যক্রম শক্তিশালীকরণের জন্য একটি প্রকল্প চলছে। ২০১৮ সালে এই প্রকল্প শুরু হয়। তবে সাত বছর পার হলেও ঢাকার পূর্বাচলে পেট (পোষা প্রাণী) হাসপাতালের কাজ হয়নি।