ঢাকা শনিবার, ০২ আগস্ট, ২০২৫

জুলাই গণঅভ্যুত্থান ফিরে দেখা

সারা দেশে বিক্ষোভ ‘সর্বাত্মক অসহযোগ’ আন্দোলনের ঘোষণা

রূপালী প্রতিবেদক
প্রকাশিত: আগস্ট ২, ২০২৫, ০২:২৭ এএম

চব্বিশের এদিনে রংপুরসহ সারা দেশে কোটা সংস্কার ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এক নতুন মোড় নেয়। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে একাত্মতা জানান শিক্ষক ও অভিভাবকরা। এতে চাপে পড়ে সরকার। আইনশৃঙ্খলা রক্ষকারী বাহিনীর মনোবল ভেঙে পড়ে। পিছু হটে গণগ্রেপ্তার অভিযান। আদালত থেকে একে একে জামিনে মুক্তি পান আটক শিক্ষার্থীরা।


এদিন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা ৩ আগস্ট সারা দেশে বিক্ষোভ মিছিল এবং ৪ আগস্ট থেকে ‘সর্বাত্মক অসহযোগ’ আন্দোলনের ঘোষণা দেন। সারা দেশে সংঘটিত হত্যাকা-ের প্রতিবাদ এবং  তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ক্ষমা চাওয়াসহ ৯ দফা দাবিতে এ কর্মসূচি ঘোষণা করা হয়।


কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীদের প্ল্যাটফর্ম বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক মাহিন সরকার এদিন রাতে হোয়াটসঅ্যাপে এক বার্তায় এ ঘোষণা দেন। তিনি সর্বস্তরের জনগণকে এ কর্মসূচিতে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানান। আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়াও একই বার্তা শেয়ার করেন। অন্যদিকে, আরেক সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসউদ ফেসবুক লাইভে এসে ৩ আগস্ট দেশব্যাপী বিক্ষোভের ঘোষণা দেন। 


হান্নান বলেন, ৪ আগস্ট থেকে সর্বাত্মক অসহযোগ আন্দোলন পালন করা হবে। কেউ ট্যাক্স এবং গ্যাস, পানি ও বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করবে না। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ সচিবালয়সহ সব সরকারি ও বেসরকারি অফিস বন্ধ থাকবে এবং শেখ হাসিনার সরকারি বাসভবন গণভবন ও রাষ্ট্রপতির বাসভবন বঙ্গভবনে কোনো যানবাহন প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না।


সরকারকে কেউ যাতে কোনো সহযোগিতা না করে এই আহ্বান জানিয়ে হান্নান বলেন, দেশের জনগণকে এমনভাবে কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে হবে, যাতে সরকার স্বাভাবিক কাজ চালিয়ে যেতে না পারে। এর আগে ১ আগস্ট আন্দোলনের ছয় সমন্বয়ক নাহিদ ইসলাম, সারজিস আলম, হাসনাত আব্দুল্লাহ, আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া, নুসরাত তাবাসসুম ও আবু বকর মজুমদার ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) হেফাজত থেকে মুক্তি পান।


মুক্তি পাওয়ার পর তারা এক যৌথ বিবৃতিতে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করেন এবং আন্দোলনে হত্যাকা-ের ন্যায়বিচার দাবি করেন। পুলিশ দাবি করে, নিরাপত্তার স্বার্থে ছাত্রনেতাদের ডিবি হেফাজতে নেওয়া হয়েছিল। তবে আন্দোলনকারীরা বলেন, তারা পুলিশের কাছে কোনো নিরাপত্তা চাননি। তাদের আটকে রাখা ছিল ‘অসাংবিধানিক ও বেআইনি’।


ডিবি হেফাজত থেকে মুক্ত হওয়া সমন্বয়করা জানান, ৩০ জুলাই থেকে ডিবি হেফাজতে থাকা অবস্থায় তারা অনশন শুরু করেন। কিন্তু বিষয়টি পরিবারের কাছে গোপন রাখা হয় এবং তাদের জোর করে গোয়েন্দা কার্যালয়ের খাবার টেবিলে বসানো হয়। ডিবি কার্যালয় থেকে দেওয়া আন্দোলন প্রত্যাহারের বিবৃতি প্রসঙ্গে তারা বলেন, ওই বিবৃতি তারা স্বেচ্ছায় দেননি।


এদিন হাজার হাজার মানুষ রাজধানীসহ সারা দেশে বৃষ্টি উপেক্ষা করে বিক্ষোভে অংশ নেন। এ সময় তারা হত্যাকা-ের বিচার ও গ্রেপ্তারদের মুক্তির দাবি জানান। এদিন হবিগঞ্জ ও খুলনায় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে অন্তত দুজন নিহত হন, যাদের মধ্যে একজন পুলিশ সদস্য ছিলেন। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় পুলিশ এবং আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের সঙ্গে সংঘর্ষে এদিন কমপক্ষে ১৫০ জন আহত হন। হবিগঞ্জে বিক্ষোভ চলাকালে সংঘর্ষে এক শ্রমিক নিহত হন। অন্যদিকে, পুলিশের দাবি, খুলনায় আন্দোলনকারীদের হামলায় এক কনস্টেবল মারা গেছেন।


এ ছাড়া ঢাকার উত্তরা, সিলেট, খুলনা, নরসিংদী, চট্টগ্রাম ও নোয়াখালীতেও বিক্ষোভ চলাকালে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। রাজধানীর উত্তরা-১১ নম্বর সেক্টরে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশ ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষে অন্তত তিনজন রাবার বুলেটের আঘাতে আহত হন। গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়, তৎকালীন শাসকদলের কর্মীরা আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালালে সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়।


এদিন রাজধানীর সায়েন্সল্যাব, মিরপুর-১০, আফতাবনগর ও শাহবাগে সড়ক অবরোধ করেন আন্দোলনকারীরা। টাঙ্গাইল শহরে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক অবরোধ করেন কয়েক হাজার আন্দোলনকারী, যাদের বেশির ভাগই ছিলেন শিক্ষার্থী। রাজধানীতে ছাত্র, শিক্ষক, সাংস্কৃতিক কর্মী, অভিভাবক এবং নাগরিক সমাজের সদস্যরা বিকেল ৩টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে থেকে  ‘দ্রোহযাত্রা’ নামে  একটি গণমিছিল বের করেন।  মিছিলটি শহিদ মিনারে গিয়ে শেষ হয়। পথে আরও অনেকে এতে যোগ দেন।


হাজারো বিক্ষোভকারী এ দ্রোহযাত্রায় অংশ নেন। তাদের হাতে ছিল ‘স্টেপ ডাউন হাসিনা’, ‘ছাত্র হত্যার বিচার চাই’ এবং ‘গুলিতে মরতে পারি, পিছু হটবো না’ লেখা প্ল্যাকার্ড। তারা গণগ্রেপ্তার বন্ধ, জুলাই হত্যাযজ্ঞের বিচার, গ্রেপ্তার শিক্ষার্থীদের মুক্তি, কারফিউ প্রত্যাহার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়া এবং তৎকালীন সরকারের পদত্যাগের দাবি জানান। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ এ ‘দ্রোহযাত্রা’ শুরুর আগে একটি সমাবেশে বক্তব্য দেন। দ্রোহযাত্রা শেষে শহিদ মিনারে এক সমাবেশে বক্তারা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের পদত্যাগ দাবিতে ৩ আগস্ট বিকেল ৩টায় আরেকটি গণমিছিলের ডাক দেন।


এদিন ‘পোয়েটস অ্যান্ড রাইটারস অ্যাগেইনস্ট কান্ট্রিওয়াইড অ্যারেস্টস অ্যান্ড অপ্রেশন’ ব্যানারে শহরের নগর পরিকল্পনাবিদ, লেখক, কবি ও প্রকাশক এবং ‘প্রতিবাদ মঞ্চ’ ব্যানারে কিছু শিক্ষক ও অধিকারকর্মী, চিকিৎসক ও মেডিকেল শিক্ষার্থীও রাজধানীতে আলাদা বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করেন। এ ছাড়া এদিন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট ৬২৬ জন শিক্ষক চলমান আন্দোলনের প্রতি সংহতি প্রকাশ করেন।