বুধবার, ২০ আগস্ট, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


মো. জামাল হোসেন, বেনাপোল

প্রকাশিত: আগস্ট ২০, ২০২৫, ০১:১৯ এএম

বেনাপোল বন্দরে বাণিজ্যে ধস

মো. জামাল হোসেন, বেনাপোল

প্রকাশিত: আগস্ট ২০, ২০২৫, ০১:১৯ এএম

বেনাপোল বন্দরে বাণিজ্যে ধস

*** দুদেশের পাল্টাপাল্টি নিষেধাজ্ঞা
*** সংকটে ব্যবসায়ী, শ্রমিক ও পরিবহন খাত
** ব্যবসায়ী ও শ্রমিকদের কাজ হারানোর শঙ্কা বাড়ছে

দেশের সর্ববৃহৎ স্থলবন্দর বেনাপোল দিয়ে আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য হঠাৎ করে বড় ধরনের ধাক্কা খেয়েছে। পণ্য আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ট্রাক চলাচলের সীমাবদ্ধতার কারণে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের চেয়ে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে আমদানি কমেছে ৬ লাখ ৩১ হাজার ৩৩০ মেট্রিক টন এবং রপ্তানি কমেছে ৭৫ হাজার ২৩২ মেট্রিক টন। ফলে এ বন্দরকেন্দ্রিক ব্যবসা, শ্রমিক ও পরিবহন খাতে মারাত্মক প্রভাব পড়েছে। আগে স্বাভাবিক সময়ে প্রতিদিন ভারত থেকে প্রায় ৫৫০ থেকে ৬০০ ট্রাক পণ্য আমদানি এবং ২৫০ থেকে ৩০০ ট্রাক পণ্য রপ্তানি হতো। এখন আমদানি নেমে এসেছে ২৫০ থেকে ৩০০ ট্রাকে। একইভাবে বাংলাদেশ থেকে ভারতেও রপ্তানি প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে, দিনে ১০০ ট্রাকের নিচে। ফলে বেনাপোল ও পেট্রাপোল বন্দর এলাকায় পরিবহন, গুদাম, হ্যান্ডলিং শ্রমিক ও ব্যবসায় স্থবিরতা ব্যাপকভাবে প্রভাব পড়েছে দুদেশের বন্দর এলাকায়।

ভারত-বাংলাদেশের পাল্টাপাল্টি নিষেধাজ্ঞায় বেনাপোল স্থলবন্দরে বড় ধরনের বাণিজ্যঘাটতি ও সংকট তৈরি হয়েছে। বৈশ্বিক মন্দা আর গত ৫ আগস্টের পর একের পর এক দুদেশের পাল্টাপাল্টি নিষেধাজ্ঞায় ধস নেমেছে দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যে। ভারত থেকে যেমন কমে আসছে আমদানীকৃত পণ্যবাহী ট্রাকের সংখ্যা, তেমনি ভারতে রপ্তানির ট্রাকও কমে আসছে। এর ফলে গভীর সংকটে পড়েছেন বেনাপোলের কয়েকশ সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট মালিক, কর্মচারী ও বেনাপোল স্থলবন্দরে কর্মরত এক হাজারের বেশি শ্রমিক। ভারত-বাংলাদেশ রাজনৈতিক টানাপড়েন, একাধিক নিষেধাজ্ঞা এবং কেন্দ্রীয় নীতিগত সিদ্ধান্তের কারণে সিঅ্যান্ডএফ ব্যবসায়ীসহ শ্রমিকদের কাজ হারানোর আশঙ্কা ক্রমেই প্রবল হয়ে উঠছে।

এরই মধ্যে অনেক সিঅ্যান্ডএফ অফিস বন্ধ হয়ে গেছে। সিঅ্যান্ডএফ কর্মচারী ও শ্রমিকরা বাধ্য হয়ে অন্য পেশায় চলে যেতে বাধ্য হচ্ছে। একই অবস্থা ওপারের পেট্রাপোল বন্দরে। ওপারের সরকারের বিরুদ্ধে ওপারের শ্রমিক-কর্মজীবী মানুষ প্রায়দিন মিছিল-মিটিং করছে। তাদের দাবি, স্থলপথে যেসব পণ্য আমদানি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, সেগুলো আবার চালু করা হোক। ভারত সরকার কী কারণে একের পর এক এ পথে আমদানি-রপ্তানি বন্ধ করে দিয়ে ভারতীয়দের অসহনীয় দুর্ভোগের মধ্যে ফেলেছে।

বাংলাদেশ স্থলবন্দরের পরিসংখ্যান বলছে, পণ্যে আমদানি নিষেধাজ্ঞা, রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ট্রাক চলাচলের সীমাবদ্ধতার কারণে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বেনাপোল বন্দর দিয়ে ভারত থেকে আমদানির পরিমাণ ছিল ২১ লাখ ৩০ হাজার ২২৮ মেট্রিক টন বিভিন্ন ধরনের পণ্য। অন্যদিকে কাস্টমসের পরিসংখ্যান বলছে, গেল ২০২৪-২৫ অর্থবছরে আমদানি হয়েছে ১৪ লাখ ৯৮ হাজার ৮৯৮ মেট্রিক টন পণ্য। এতে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের চেয়ে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে আমদানি বাণিজ্য ঘাটতির মুখে পড়েছে ৬ লাখ ৩১ হাজার ৩৩০ মেট্রিক টন। অপরদিকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বেনাপোল বন্দর দিয়ে বাংলাদেশি পণ্য ভারতে রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৪ লাখ ৫৬ হাজার ৬৭২ মেট্রিক টন বিভিন্ন ধরনের পণ্য। অন্যদিকে গেল ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ভারতে রপ্তানি হয়েছে ৩ লাখ ৮১ হাজার ৪৪০ মেট্রিক টন পণ্য। এতে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের চেয়ে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এসে রপ্তানি কমেছে ৭৫ হাজার ২৩২ মেট্রিক টন।

গত জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত চ্যাচিস বাদে আমদানি-রপ্তানিতে ধস নেমেছে। এ সময়ে আমদানি হয়েছে ৫৫ হাজার ৩৯০ ট্রাক পণ্য ও রপ্তানি হয়েছে ২১ হাজার ৭৩৮ ট্রাক পণ্য। চলতি আগস্ট মাসে আমদানি-রপ্তানিতে ব্যাপক ধস নামতে শুরু করেছে। গত ২ থেকে ১৭ আগস্ট পর্যন্ত ছুটি বাদে ১১ দিনে মাত্র ৩২০৬ ট্রাক পণ্য ভারত থেকে আমদানি হয়েছে আর ভারতে রপ্তানি হয়েছে মাত্র ৫৯৩ ট্রাক পণ্য। যা গড়ে আমদানির ক্ষেত্রে প্রতিদিন ২৯০ ট্রাক ও রপ্তানির ক্ষেত্রে ৫৩ ট্রাক। 

আমদানি পণ্যের মধ্যে ছিলÑ শিল্প-কারখানার কাঁচামাল, তৈরি পোশাক, গার্মেন্টস, শিশুখাদ্য, মাছ, কেমিক্যাল, মোটরপার্টস, কসমেটিকসসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য। এর মধ্যে উচ্চশুল্ক আরোপকৃত পণ্যের আমদানি কমে গেছে। অপরদিকে রপ্তানি পণ্যের মধ্যে ছিল পাট, পাটের তৈরি পণ্য, তৈরি পোশাক, কেমিক্যাল, বসুন্ধরা টিস্যু, মেলামাইন, মাছ উল্লেখযোগ্য। কিন্তু দুদেশের সরকারের বিধি-নিষেধের কারণে আগের তুলনায় বর্তমানে তা শূন্যের কোটায় নেমে এসেছে।

বন্দরসংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা জানান, গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে দেশের সর্ববৃহৎ বেনাপোল স্থলবন্দরে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বাণিজ্য টানাপোড়েন চলছেই। বাণিজ্য কমে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন তারা, বাণিজ্য কমে যাওয়ায় কমে গেছে কাজকর্ম। ফলে আয়ও কমে গেছে। দুদেশের মধ্যে বিধি-নিষেধ আরোপ বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন ক্ষতির মুখে থাকা ব্যবসায়ীরা। গণআন্দোলনের জেরে শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতা হারিয়ে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ভারতে আশ্রয় নেন। তার পর থেকেই দুদেশের মধ্যে বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করে, যা এখনো অব্যাহত রয়েছে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং বাণিজ্যবান্ধব নীতিই পারে এ অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটাতে।

বন্দরের ব্যবসায়ীরা মনে করছেন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা ও আমদানি বিধি-নিষেধ শিথিল না করলে বেনাপোল বন্দরের বাণিজ্য আরও তলানিতে পৌঁছবে। এ অবস্থায় সরকার ও বেসরকারি খাতের সম্মিলিত উদ্যোগ ছাড়া এ সংকট কাটিয়ে ওঠা কঠিন হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

বাণিজ্যিক সংশ্লিষ্টরা জানান, বর্তমানে ভারত সরকারের নিষেধাজ্ঞায় গত ৮ এপ্রিল থেকে ভারতের আকাশপথ ব্যবহার করে বাইরের দেশে বাংলাদেশি পণ্য স্থলপথে রপ্তানি বন্ধ রয়েছে। অপরদিকে বাংলাদেশ টেক্সাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের দাবিতে দেশীয় শিল্প রক্ষার কারণ দেখিয়ে বাংলাদেশ সরকার স্থলপথে ভারত থেকে সুতা আমদানি নিষিদ্ধ করেছে। পরবর্তী ১৭ মে ভারত সরকার আরেকটি নিষেধাজ্ঞায় গার্মেন্টস, তৈরি পোশাক, তুলা, সুতির বর্জ্য, প্লাস্টিক, কাঠের তৈরি আসবাবপত্র ও ফলজাতীয় পণ্য স্থলপথে রপ্তানি বন্ধ করে দেয়। এ ছাড়া গত ২৬ জুন পাট ও পাটের তৈরি পণ্য স্থলপথে রপ্তানি বন্ধ করে ভারত।

সর্বশেষ ১১ আগস্ট সোমবার নতুন করে বস্ত্র ও পাটজাত চার ধরনের পণ্য স্থলবন্দর ব্যবহার করে আমদানিতে না করেছে ভারত। এগুলো হলোÑ পাট কিংবা অন্য কোনো ধরনের উদ্ভিজ্জ তন্তু থেকে উৎপাদিত কাপড়, পাট দিয়ে তৈরি দড়ি, রশি, সুতলি ইত্যাদি, অন্য তন্তু দিয়ে তৈরি দড়ি, রশি, সুতলি এবং পাটের বস্তা ও ব্যাগ।

ভারতের পেট্রাপোল ক্লিয়ারিং এজেন্টস স্টাফ ওয়েল ফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক কার্তিক চক্রবর্তীর মতে, দুই দেশের পক্ষ থেকে একাধিক বিধি-নিষেধ এ সংকটের মূলে। ভারত বাংলাদেশকে দেওয়া ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করেছে ৮ এপ্রিল আর ১৩ এপ্রিল বাংলাদেশ ভারত থেকে স্থলপথে সুতা আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। পাশাপাশি ভারতও কিছু পণ্যের আমদানিতে কড়াকড়ি আরোপ করেছে। এসব নিষেধাজ্ঞার ফলে ব্যবসায়ী, শ্রমিক, পরিবহন সংস্থা সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং হচ্ছে।

ভারতীয় মজদুর সঙ্ঘের উত্তর ২৪ পরগনা জেলা সভাপতি অরুণাভ পোদ্দার (দেবু) বলেন, সরকারের সিদ্ধান্ত আমাদের মেনে নিতে হবে। তবে এ ক্ষেত্রে শ্রমিকদের কথাও সরকারের ভাবা উচিত। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের পেট্রাপোল এবং তৎসংলগ্ন এলাকার বহু মানুষের রুটি-রুজির একমাত্র ঠিকানা পেট্রাপোল বন্দর। যে হারে আমদানি কমছে, তাতে আমাদের লোড-আনলোডের কাজও বন্ধ হতে বসেছে। যা শ্রমিকদের রোজগারে বড়সড় প্রভাব ফেলছে। বর্তমানে কেউ কেউ দৈনিক ১০০ টাকাও উপার্জন করতে পারছেন না। অনেকেই রাজমিস্ত্রির জোগালি কিংবা মাঠের কাজ করছেন। তবে বর্ষার কারণে তা-ও জোটে না। পরিবারের মুখে দুবেলা খাবার তুলে দেওয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। পণ্য লোডিং-আনলোডিং, গোডাউন সংরক্ষণ, ক্লিয়ারিং প্রক্রিয়াসহ নানা স্তরে কাজ করে আসছিলেন কয়েক হাজার মুটে-মজদুর ও সাধারণ শ্রমিক। আজ অনেকে বেকার হয়ে বসে আছে।

বেনাপোল ল্যান্ডপোর্ট ইমপোর্টার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক জিয়াউর রহমান জানান, এ বন্দর দিয়ে ভারত-বাংলাদেশের সিংহভাগ বাণিজ্য সম্পন্ন হলেও ৫ আগস্ট দেশের রাজনৈতিক পালাবদলের পর কমেছে পণ্যবাহী ট্রাক আসা-যাওয়া। স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় বাণিজ্য কমে গেছে। বাণিজ্যের পরিমাণ কমে আসায় বন্দর দিয়ে সরকারের রাজস্ব আয়েও প্রভাব পড়েছে। এতে শুধু বাংলাদেশের নয়, ভারতেরও ক্ষতি হচ্ছে। তিনি আরও জানান, দুদেশের পক্ষ থেকে আরোপিত নানা বিধি-নিষেধই বাণিজ্যে ধসের মূল কারণ। দ্রুত এ নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের দাবি জানাচ্ছি।

বেনাপোল সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট ব্যবসায়ীরা জানান, বেনাপোল বন্দরে বাণিজ্য স্বাভাবিক করতে হলে ভিসানীতি সহজ করতে হবে। আগে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা বাণিজ্যিক ভিসায় ভারতে গিয়ে সরাসরি পণ্য দেখে, বেছে নিয়ে আমদানি করত। বর্তমানে দুদেশের রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্কের অবনতি হওয়ায় বাণিজ্য ভিসা বন্ধ রয়েছে। ফলে আমদানি-রপ্তানি কমে যাচ্ছে। ভারতে যেতে না পেরে ব্যবসায়ীদের মধ্যে অনিশ্চয়তা কাজ করছে। নতুন করে উদ্যোক্তা ও আমদানিকারকরা ঝুঁকি নিতে চাইছেন না।

বেনাপোল বন্দরের পরিচালক মো. শামিম হোসেন বলেন, বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে বেশ কিছু পণ্য আমদানি-রপ্তানিতে দুদেশের সরকার নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। যার অধিকাংশ উৎপাদন হয় দেশেই। এসব পণ্য আমদানি না করায় স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় বাণিজ্য অনেক কমে গেছে। স্বাভাবিক সময়ে প্রতিদিন ভারত থেকে প্রায় ৫৫০ ট্রাক পণ্য আমদানি এবং ২৫০ থেকে ৩০০ ট্রাক পণ্য রপ্তানি হতো। এখন আমদানি নেমে এসেছে ২৫০ ট্রাক ও রপ্তানি ১০০ ট্রাকের নিচে। গত সোমবার আমদানি হয়েছে ২৯১ ট্রাক ও রপ্তানি হয়েছে মাত্র ৫০ ট্রাক পণ্য।
 

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!