সোমবার, ০৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


মেহেদী হাসান খাজা

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৮, ২০২৫, ০৫:৪৪ এএম

ক্যাসিনো সম্রাট থেকে অপরাধ জগতের ডন

মেহেদী হাসান খাজা

প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৮, ২০২৫, ০৫:৪৪ এএম

সেলিম প্রধান। ছবি-সংগৃহীত

সেলিম প্রধান। ছবি-সংগৃহীত

  • অনলাইনে কয়েন বিক্রি করে প্রাতারণা, কামিয়েছেন কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা
  • মাদক ও জাল টাকা সিন্ডিকেটের একক নিয়ন্ত্রণকারী

অনলাইনে অবৈধ ক্যাসিনো ব্যবসার মূল হোতা সেলিম প্রধানকে গ্রেপ্তারের পর একের পর এক চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসছে।  সব মহলে নানা গুঞ্জন ও আলোচনা চলছে তাকে নিয়ে। অনেকেই জানতে চাইছেন, কে এই সেলিম প্রধান? 

সম্প্রতি রূপালী বাংলাদেশের এক অনুসন্ধানে জানা যায়, সেলিমের প্রভাব বিস্তার শুরু হয় ১৫ বছর আগে। তিনি সাবেক এক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছের লোক ছিলেন। সেই থেকে তার উত্থান শুরু হয়। সূত্রমতে জানা গেছে, ক্যাসিনো সম্রাট সেলিম প্রধান ঢাকার অপরাধজগতের ডন হিসেবে ব্যাপক পরিচিত। এ ছাড়া দেশে-বিদেশে তাকে অনুমোদনহীন ক্যাসিনো পরিচালনার ডন হিসেবে জানেন অনেকেই।

গত শনিবার অননুমোদিত সিসা বার পরিচালনাসহ বিভিন্ন অভিযোগে সেই সেলিম মিয়া ওরফে সেলিম প্রধানসহ ৯ জনকে গ্রেপ্তার করে গুলশান থানার পুলিশ। রাজধানীর বারিধারা এলাকা থেকে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। তাকে গ্রেপ্তারের পর পুলিশ জানায়, অনলাইনভিত্তিক ক্যাসিনোর গুরু সেলিম প্রধান। ঢাকার অপরাধ জগতের ডন হিসেবে তিনি ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন। পশুর খাটালে চাঁদাবাজি, হোটেল, স্পা, ক্যাসিনো পরিচালনাসহ নানা অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। দেশে-বিদেশে অনুমোদনহীন ক্যাসিনো পরিচালনার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে।  

তার নামে রয়েছে ঋণখেলাপির অভিযোগ। সূত্র বলছে, সেলিম প্রধান রূপালী ব্যাংক থেকে ১০০ কোটি টাকা লোন নিয়েছেন। তার বাবার নাম হান্নান প্রধান। ঢাকার মোহাম্মদপুরের নূরজাহান রোডে তার বাসা। তার গ্রামের বাড়ি নারায়ণগঞ্জে।

সেলিম প্রধান অনলাইনে ক্যাসিনো পরিচালনাকারী এবং বাংলাদেশের কান্ট্রি-প্রধান।  তিনি ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের সহসভাপতি ছিলেন। এ ছাড়া এর আগে গ্রেপ্তার হওয়া বিসিবি পরিচালক লোকমান হোসেন ভূঁইয়ার ক্যাশিয়ারও ছিলেন।

গোয়েন্দা তথ্যমতে, সেলিম প্রধানের ব্যাংককের পাতায়ায় বিলাসবহুল হোটেল, ডিসকো বার, ক্যাসিনো ব্যবসাসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। সূত্র জানায়, রাজধানীর বিভিন্ন স্পা ও বিউটি পার্লার, যেখানে ভিআইপিদের আসা-যাওয়া রয়েছে, সেগুলোতে নারী সরবরাহের কাজ করতেন সেলিম। সেই মেয়েরা ভিআইপিদের বিনোদন দেওয়ার কাজ করতেন। সিলেট থেকে অবৈধভাবে পাথর নিষ্কাশনের কাজও করতেন তিনি। 

সেলিমের প্রধান গ্রুপ ডটকম নামের একটি ওয়েবসাইট রয়েছে। সেখানে উল্লেখ করা হয়ছে, সেলিম প্রধানের লাইভ ক্যাসিনো মার্কেট পি২৪ লিমিটেড নামের গেমিং কোম্পানি ২০১৮ সালের ৭ ডিসেম্বর প্রতিষ্ঠা করা হয়। ওয়েবসাইটে দেওয়া ঠিকানায় দেখা যায়, গুলশান-২-এর ৯৯ নম্বর রোডের ১১/এ নম্বরে রয়েছে ‘পি২৪’-এর অফিস। করপোরেট অফিসের ঠিকানা দেওয়া হয়েছে ডি-১ মমতাজ ভিশন, গুলশান-২-এর ৯৯ নম্বর রোডে ১১/এ। বিদেশের অফিসের ঠিকানা হচ্ছে ১৬৫/৯৬ মো ১০, সুরাসাক, শ্রী রাখা, চনবুন, থাইল্যান্ড, ২০১১০।

এসব বিষয়ে তদন্তকারী সংশ্লিষ্টরা জানান, শুধু অনলাইন ক্যাসিনো পরিচালনাই নয়, সেলিম প্রধান রাজশাহীসহ সীমান্ত এলাকায় ভারতীয় গবাদিপশুর সব খাটাল ও মাদক সিন্ডিকেটের হোতা। এমনকি সীমান্তে জাল টাকার মূল সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণও তার হাতে।  প্রশাসনের বিভিন্ন ব্যক্তির সঙ্গে সখ্য গড়ে তুলে তিনি খাটাল, মাদক ও জাল টাকার সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করেন। সেখান থেকে প্রতি মাসে লাখ লাখ টাকা চাঁদা নেন। দুই বছরে তিনি সীমান্ত এলাকা থেকে প্রায় ২ কোটি টাকা চাঁদা নিয়েছেন।

অবৈধ সম্পদ অর্জন ও অর্থ পাচার মামলায় চার বছরের কারাদ- পাওয়া সেলিম প্রধান গত বছর রূপগঞ্জ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন। যদিও ফৌজদারি মামলায় দণ্ডিত হওয়ায় পরে যাচাই-বাছাই শেষে রিটার্নিং কর্মকর্তা তার মনোনয়নপত্র বাতিল করেন। 

তদন্তসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ঋণের নামে রূপালী ব্যাংকের ১০০ কোটি টাকা আত্মসাতের মাধ্যমে অপরাধজগতে নাম লেখান স্পা ব্যবসায়ী সেলিম প্রধান। জাপানের অর্থায়নে শিল্প গড়ার নামে ঋণ নেওয়া হলেও পুরো টাকাই আত্মসাৎ করা হয়। একপর্যায়ে টাকা নিয়ে দেশের বাইরে চলে যান সেলিম। স্থায়ী আবাস গড়েন জাপানের রাজধানী টোকিওতে। কিন্তু টোকিওতেও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে কালো তালিকাভুক্ত হন। জাপান থেকে বহিষ্কার করা হলে চলে যান আমেরিকায়। সেখানে এক আমেরিকানকে বিয়েও করেন। আমেরিকান স্ত্রীকে কাজে লাগিয়ে তিনি ফের জাপানে ঢোকার চেষ্টা করেন। কিন্তু এ যাত্রায়ও সফল হননি। সেলিম প্রধানকে গ্রেপ্তার করে বাংলাদেশে পাঠানো হয়। তবে তাকে বেশি দিন কারাবাস করতে হয়নি। এরপর গুলশানের একটি স্পা সেন্টার ঘিরে তিনি নতুন করে নেটওয়ার্ক গোছানোর কাজ শুরু করেন।

সেলিম প্রধানের মোট পাঁচজন স্ত্রী আছেন বলে জানিয়েছে গোয়েন্দা সূত্র। এর মধ্যে একজন রাশিয়ান, একজন আমেরিকান, একজন জাপানি এবং দুজন বাংলাদেশি। সেলিমের ছোট বউ বা ৫ নম্বর স্ত্রী সহকারী কাস্টমস কমিশনার। বর্তমানে কর্মরত আছেন চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে।

সূত্রমতে এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) তথ্যমতে, অনলাইন জুয়ার কারবারি সেলিম প্রধানের নামে থাইল্যান্ডে সাতটি কোম্পানি রয়েছে। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র ও থাইল্যান্ডে চারটি ব্যাংকে ‘কয়েক কোটি’ টাকার অস্বাভাবিক লেনদেন করেছেন তিনি।

এ বিষয়ে দুদক কমিশনার (অনুসন্ধান) মোজাম্মেল হক খান জানান, ‘তদন্তের স্বার্থে সেলিম প্রধানের সব স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ জব্দ করা হয়েছে। তার অর্ধশত ব্যাংক হিসাবও ফ্রিজ করা হয়েছে।’

সেলিমের ক্যাসিনো ব্যবসা সম্পর্কে র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপস) কর্নেল তোফায়েল মোস্তফা সারওয়ার বলেন, অনলাইনে কয়েন বিক্রি করে ক্যাসিনো খেলায় জুয়াড়িদের উদ্বুদ্ধ করতেন সেলিম প্রধান। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় খুলেছিলেন তার গোপন ক্যাসিনো। ক্যাসিনো থেকে অর্জিত বিপুল পরিমাণ অর্থ তিনি বিভিন্নভাবে বিদেশে পাচার করেছেন। 

‘অনলাইন ক্যাসিনো থেকে আয়ের অর্থ সেলিম জাপানসহ বিভিন্ন দেশে পাচার করতেন। গুলশানে তার একটি স্পা সেন্টার রয়েছে। সেখানেও অনৈতিক কর্মকা- চলত।’

এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশের গুলশান বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার মো. আল আমিন হোসাইন রূপালী বাংলাদেশকে জানান, সেলিম প্রধান গ্রেপ্তার হওয়ার পর তার অপরাধ সম্পর্কে নানা চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসছে। থাইল্যান্ড থেকে বাংলাদেশে অনলাইনের মাধ্যমে ক্যাসিনো ব্যবসা চালাতেন সেলিম। অনলাইনে কয়েন বিক্রি করে এই ক্যাসিনো চালানো হতো। এসব করে কামিয়েছেন কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা। 

কে এই সেলিম প্রধান?

রূপগঞ্জ উপজেলার ভুলতা ইউনিয়ন পরিষদের পাশেই মর্তুজাবাদ গ্রাম। প্রায় ৩০ বছর আগের জরাজীর্ণ ‘চাঁন মিয়া ও স্ত্রী সফুরা খাতুন মঞ্জিল’। চাঁন মিয়ার তিন ছেলের মধ্যে বড় ছেলে আব্দুল হান্নান ওরফে নান্নু মিয়া। আর নান্নু মিয়ার ৩ ছেলে ও ৩ মেয়ে। এর মধ্যে সেলিম মিয়া মেজ। বড় ছেলের নাম আলম মিয়া ও ছোট ছেলের নাম নাদিম মিয়া। এখনো ‘চাঁন মিয়া ও স্ত্রী সফুরা খাতুন মঞ্জিল’ দেখে বোঝার উপায় নেই বাড়ির মালিক চাঁন মিয়ার নাতির মাসিক আয় ৯ কোটি টাকা। বর্তমানে সেলিম মিয়া ক্যাসিনোর মাধ্যমে ওপরে উঠেছেন, নাম পরিবর্তন করে হয়েছেন সেলিম প্রধান ওরফে ‘থাই ডন’। গ্রেপ্তারের পর টিভি পর্দায় সেলিম মিয়া এবং তার বাসা থেকে উদ্ধার করা টাকা-ডলার ইত্যাদি দেখে স্থানীয়দের কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা।

এলাকাবাসীর কাছে অবশ্য দুই যুগ আগেও সেলিম প্রধানের পরিচিতি ছিল আব্দুল হান্নান ওরফে নান্নু মিয়ার ছেলে সেলিম মিয়া। ক্যাসিনোর মাধ্যমে কয়েকশ কোটি টাকার মালিক হওয়ায় উঠে যান হাই সোসাইটিতে। বিলাসী জীবনযাপনে সেলিম মিয়া হয়ে যান সেলিম প্রধান। তবে বিশাল বিত্তবৈভব আর রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রভাবে সেলিম প্রধান ও তার পরিবারের ব্যাপারে এলাকার মানুষ কথা বলতে এখনো সাহস পাচ্ছেন না। এদিকে পৈতৃক বাড়ি এমন জরাজীর্ণ থাকলেও গাউছিয়া থেকে অল্প দূরেই ভুলতা ফ্লাইওভারের শেষ মাথায় সাওঘাট এলাকায় সেলিম প্রধানের রয়েছে আলোচিত ‘জাপান বাংলাদেশ সিকিউরিটি প্রিন্টিং অ্যান্ড পেপারস’ নামের বহুতল ভবন ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। সেখানে ছাপানো হয় বাংলাদেশের সব ব্যাংকের চেক বই, এফডিআরের মতো গুরুত্বপূর্ণ দলিলাদি।

যেভাবে সেলিম প্রধানের উত্থান? 

সরেজমিন রূপগঞ্জের মর্তুজাবাদ এলাকা ঘুরে এবং স্থানীয় সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আব্দুল হান্নান ওরফে নান্নু মিয়া পরিবার নিয়ে অনেক কষ্টে দিন কাটাতেন। সংসারে ছিল অনটন, নুন আনতে পান্তা ফুরোয় অবস্থা। ওই সময় সেলিম প্রধান স্থানীয় মানুষকে সঙ্গে নিয়ে একটি সমিতি গঠন করেন।

ওই সমিতির বেশ কিছু টাকা মেরে সবার অজান্তে চলে যান জাপানে। জাপানে থাকা অবস্থায় তার প্রিন্টিং প্রেসের ব্যবসার গোড়াপত্তন হয়। কিন্তু জাপানের টোকিওতেও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে কালো তালিকাভুক্ত হন তিনি। জাপান থেকে বহিষ্কার করা হলে তিনি সেখান থেকে আমেরিকায় চলে যান। সেখানে এক আমেরিকানকে বিয়েও করেন। আমেরিকান স্ত্রীকে কাজে লাগিয়ে ফের জাপানে ঢোকার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। একপর্যায়ে বাংলাদেশে ফিরে সেলিম প্রধান ওরফে সেলিম মিয়া আলোচিত ব্যবসায়ী গিয়াস উদ্দিন আল মামুনের সঙ্গে সম্পর্ক করে হয়ে যান তার ব্যাবসায়িক পার্টনার।

এলাকাবাসী জানান, তারা সেলিম প্রধানকে বিএনপির স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা হিসেবে জানলেও তিনি কোনো পদে ছিলেন না। সেলিম প্রধানের আপন চাচাতো ভাই আনোয়ার সাদাত সায়েম নারায়ণগঞ্জ জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের শীর্ষ পদে আসীন হয়েছেন সেলিম প্রধানের বদান্যতায়। সায়েম নিজেও জাপান-বাংলাদেশ সিকিউরিটি প্রিন্টিংয়ের পরিচালক ছিলেন। ক্যাসিনো সম্রাট সেলিম প্রধানের বিভিন্ন অবৈধ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হয়ে সায়েম কোটি কোটি টাকার সম্পদ গড়ে তোলেন। ১৫ বছর আগেও সায়েমের তেমন কোনো সম্পদ ছিল না।
 

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!