ঢাকা বৃহস্পতিবার, ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

১৭ বিয়ে কাণ্ডে আলোচিত  সেই বন কর্মকর্তা বরখাস্ত

বরিশাল ব্যুরো
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৭, ২০২৫, ১১:৪৬ পিএম
  • এর আগেও দুবার বরখাস্তসহ দাপ্তরিক অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িয়ে কারাগারে গিয়েছিলেন তিনি

১৭ বিয়ে কাণ্ডে আলোচিত বরিশালের বন কর্মকর্তা (ডিএফও) কবির হোসেন পাটোয়ারীর বিরুদ্ধে অবশেষে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। অভিযোগ তদন্তের মধ্যেই গত মঙ্গলবার আলোচিত এই কর্মকর্তাকে বরিশাল থেকে সরিয়ে রংপুর রেঞ্জে সংযুক্ত করা হয়। বরিশালে তার কর্মস্থলে স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন পটুয়াখালীর বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (উপ-বন সংরক্ষক) ড. মোহাম্মদ জাহিদুর রহমান মিঞা। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় থেকে আদেশ প্রাপ্তির পরে মঙ্গলবার রাতেই পটুয়াখালীর এই কর্মকর্তা আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। এই তথ্য বরিশাল বন বিভাগের একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র রূপালী বাংলাদেশকে নিশ্চিত করেছে। 

সূত্র জানিয়েছে, বহু অঘটন পটিয়সী বন কর্মকর্তা কবির হোসেন পাটোয়ারী এর আগেও দুর্নীতিসহ নানামুখী অভিযোগে দুবার বরখাস্ত হয়েছিলেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ শাসনামলে তার সঙ্গে এমপি-মন্ত্রীদের গভীর সখ্যের বদৌলতে তিনি শাস্তির খড়গ থেকে রেহাই পান। পরবর্তীতে চাকরিতে যোগ দিয়ে আগের মতোই দাপ্তরিক কাজে অনিয়ম-দুর্নীতিসহ নানা প্রলোভনে ফেলে একের পর এক বিয়ে করতে থাকেন। বিষয়টি নিয়ে বরিশালে দীর্ঘদিন কানাঘুষা চললেও গত ১১ সেপ্টেম্বর ১২ নারী তার স্ত্রী দাবি করে মানববন্ধন করলে তা সংবাদমাধ্যমে মোটা দাগে ফলাও করে প্রকাশ পেলে নানা আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেয় এবং এই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে স্বপ্রণোদিত হয়ে মঙ্গলবার বরিশালের আদালতে একটি মামলা করেন বিএনপি নেতা আইনজীবী হাফিজ উদ্দিন বাবলু। 

বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, মঙ্গলবার মামলার পরপরই সন্ধ্যার দিকে খবর আসে বরিশালের বিতর্কিত বন কর্মকর্তা কবির হোসেনের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। তৃতীয়বারের মতো এই কর্মকর্তা বরখাস্ত হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করেন বরিশাল বিভাগীয় উপকূলীয় অঞ্চলের বন সংরক্ষক মিহির কুমার দো। তিনি জানান, মঙ্গলবার সন্ধ্যায় মন্ত্রণালয় থেকে এ-সংক্রান্ত একটি ই-মেইল পেয়েছেন।

সূত্রগুলো জানায়, রাজধানী ঢাকা, খুলনা, সিরাজগঞ্জ, বাগেরহাটসহ বিভিন্ন জেলায় কর্মরত থাকাকালে কবির হোসেন সর্বমোট ১৭টি বিয়ে করেন। সর্বশেষ চলতি বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি বিয়ে করেছেন খুলনার খাদিজা আক্তার নামের তরুণীকে। এই নারীকে বিয়ের দ্বিতীয় দিন তার বাবার সম্পত্তি নিজের নামে লিখে দেওয়ার প্রস্তাব দেন কবির হোসেন। এতে খাদিজা সম্মত না হওয়ায় তাকে বরিশালের বাসা থেকে মারধর করে বের করে দেন। ক্ষুব্ধ এই নারী সাবেক ১৭ স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে গত ১১ সেপ্টেম্বর কাশিপুরস্থ বন বিভাগের সম্মুখে মানববন্ধন করেন এবং কর্মকর্তা কবির হোসেনের শাস্তি দাবি করেন। মানববন্ধন চলাকালে কবির হোসেন অফিসের অভ্যন্তরে অবস্থান করছিলেন। 

মানববন্ধনে অংশ নেওয়া নারীদের অভিযোগ, বিদেশে পড়াশোনা করানো, সরকারি চাকরি দেওয়া, বিমানবালা হিসেবে সুযোগ কিংবা সম্পত্তি দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে কবির হোসেন ১৭ তরুণীকে ফাঁদে ফেলেছেন এবং তিনি বরিশালে ১৮ নম্বর বিয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। মূলত এই খবর পেয়েই সব স্ত্রী একত্র হয়ে তার বিরুদ্ধে মাঠে নেমেছেন। 

১৭ নম্বর স্ত্রী খুলনার খাদিজা আক্তারের অভিযোগ, অত্যন্ত প্রভাবশালী কবির হোসেনের আওয়ামী লীগের এমপি-মন্ত্রীদের সাথে গভীর যোগাযোগ ছিল। এই কারণে তার বিরুদ্ধে থানা পুলিশ করেও কোনো সুফল মেলেনি। বরং আরও হয়রানি হতে হয়েছে। তবে তিনি একবার দুর্নীতি মামলায় কারাগারে গেলেও বেশিদিন আটকে রাখা যায়নি, জামিনে মুক্ত হয়ে আগের মতো বিয়ে অব্যাহত রাখেন।

বরিশাল বন কর্মকর্তার ১৭ বিবাহ করার আলোচিত এই ঘটনাটি ১৪ সেপ্টেম্বর ফলাও করে প্রকাশ করে ‘দৈনিক রূপালী বাংলাদেশ’ পত্রিকা। পরবর্তীতে পর্যায়ক্রমে সংবাদটি স্থানীয় ও জাতীয় একাধিক দৈনিকে প্রচার-প্রকাশ হয়। রূপালী বাংলাদেশ পত্রিকার সংবাদটি বিএনপিপন্থি আইনজীবী হাফিজ উদ্দিন বাবলুর নজরে আসার পরে তিনি একটি মামলা করার সিদ্ধান্ত নেন এবং করেছেনও তাই। 

এই আইনজীবী জানান, ১৭ বিয়েকা-ে সমালোচিত চাঁদপুরের মতলবের বাসিন্দা কবির হোসেন পাটোয়ারী বিয়ের নামে প্রতারণা করেছেন। প্রতিটি বিয়ের বিষয়ে মুসলিম ফ্যামিলি আইনের ধারায় অপরাধ সংঘটিত করেছেন তিনি। এ ছাড়া প্রথম বিবাহের পর তা গোপন রেখে এক এক করে ১৭টি বিয়ে ধর্মীয় মূল্যবোধ ও দেশীয় সংস্কৃতি এবং আমাদের সমাজব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করে গুরুতর অপরাধ সংঘটিত করেছেন। পত্রিকার খবর দেখে স্বপ্রণোদিত হয়ে মামলা করেছি। 

মঙ্গলবার মামলার খবর প্রকাশ হওয়ার কিছুক্ষণ পরেই আলোচনায় আসে বন কর্মকর্তা কবির হোসেনের সাময়িক বরখাস্তের বিষয়টি, যা ভুক্তভোগী নারীদের জন্য স্বস্তিদায়ক। তবে এই শাস্তিকে সাময়িক এবং অপরাধের তুলনায় অতি নগণ্য বলে তার বিরুদ্ধে আরও কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের আর্জি জানানো হয়েছে। 

এ বিষয়ে জানতে বন কর্মকর্তা কবির হোসেনের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও অপর প্রান্ত থেকে কোনো সাড়া মেলেনি। বরিশাল বন বিভাগের একটি সূত্র জানিয়েছে, কবির হোসেনকে যে বরখাস্ত করা হবে তিনি তা দুদিন আগেই মোটামুটি নিশ্চিত ছিলেন। মঙ্গলবার বিকেলে বরখাস্তের আদেশ আসছে এবং তাকে রংপুরে যেতে হচ্ছে এই তথ্য কোনো মাধ্যম জানতে পেরেই সেখানে যাওয়ার প্রস্তুতি নেন এবং ওই আদেশের কপি বরিশালে পৌঁছানোর আগেই তিনি রংপুরের উদ্দেশে রওনা হন।