ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও নিয়ন্ত্রক সংস্থা মিলিয়ে ১১ প্রতিষ্ঠানের করা ১০০টি মামলার বিপরীতে ৩৮ হাজার ৬৮ কোটি ৫২ লাখ টাকা আটকে আছে। এসব মামলা নিষ্পত্তি করে টাকা আদায়ের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এই বিপুল অর্থ উদ্ধারে সরকার আটটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে চলতি মাসের মধ্যে প্রতিষ্ঠানগুলোকে সব ধরনের তথ্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে পাঠাতে বলা হয়েছে।
মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির লক্ষ্যে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব নাজমা মোবারেকের সভাপতিত্বে এক সভায় এই সিদ্ধান্ত হয়। এ-সংক্রান্ত পর্যালোচনার নথির অনুলিপি রূপালী বাংলাদেশের এই প্রতিবেদকের হাতে এসেছে। এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের (এফআইডি) যুগ্ম সচিব ফরিদা ইয়াসমিন রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, আমরা দেখছি মামলাগুলোর নিষ্পত্তির বিষয়ে বিভিন্ন ব্যাংক সঠিক পদক্ষেপ নিচ্ছে কি না এবং তাদের কোথায় সহায়তা দরকার। আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ প্রতিষ্ঠানগুলোকে সেসব বিষয়ে সহায়তা করবে। উচ্চ আদালতে অনেক মামলা রয়েছেÑ সেগুলো তালিকার সামনের দিকে নিয়ে আসতে অ্যাটর্নি জেনারেলের সঙ্গে প্রয়োজনীয় যোগাযোগ করা হচ্ছে।
পর্যালোচনায় যেসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে: মামলার শুনানির সময় আদালতে ব্যাংক নিযুক্ত কর্মকর্তা উপস্থিত থাকবেন এবং মামলায় নিয়োজিত আইনজীবী সঠিকভাবে শুনানি করছেন কি না তা যথাযথভাবে তদারকি করবেন। নিলাম বিজ্ঞপ্তি এবং অর্থঋণ মামলার কার্যক্রম বিলম্ব করতে ঋণগ্রহীতারা পর্যায়ক্রমে একাধিক রিট পিটিশন দায়ের করে থাকেনÑ এ প্রবণতা রোধে অ্যাটর্নি জেনারেল এবং এ বিভাগের আওতাধীন নিয়ন্ত্রক সংস্থা, ব্যাংক, বিমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে সভা আয়োজনের উদ্যোগ নেবে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) সার্টিফিকেট মামলা নিষ্পত্তির জন্য বিবাদীদের বর্তমান ঠিকানা সংগ্রহের চেষ্টা করবে, যাতে সমন জারি নিশ্চিত করা যায়। অর্থজারি মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা তামিলের জন্য মামলাভিত্তিক তালিকা চলতি মাসের মধ্যে এ বিভাগে পাঠাতে হবে।
তালিকাপ্রাপ্তির পর আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। প্রতিষ্ঠানগুলো নিলামে বিক্রীত যেসব সম্পত্তির নাম জারি করা যাচ্ছে না, তার তালিকাও চলতি মাসের মধ্যে এ বিভাগে পাঠাতে হবে। নাম জারি মামলায় প্রধান কার্যালয়ের সঙ্গে সমন্বয় করে স্থানীয় অফিসের কর্মকর্তারা তদারকি কার্যক্রম জোরদার করবেন। প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী প্রধানরা প্রতি মাসে সভা করে মামলার অগ্রগতি প্রতিবেদন এ বিভাগে প্রেরণ করবেন। এবং এ বিভাগের আওতাধীন নিয়ন্ত্রক সংস্থা, ব্যাংক, বিমা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ আর্থিক সংশ্লেষ রয়েছেÑ এরূপ শীর্ষ ১০টি করে মামলার বিস্তারিত তথ্য এ বিভাগে প্রেরণ করতে হবে এবং মামলাগুলো নিষ্পত্তির কার্যক্রম জোরদার করতে হবে।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ মূলত সোনালী ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক পিএলসি (বিডিবিএল), বেসিক ব্যাংক, সাধারণ বীমা করপোরেশন, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক (বিকেবি), রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক (রাকাব), ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) ও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের এই নির্দেশ দিয়েছে।
সূত্রগুলো জানায়, ব্যাংকের পক্ষে ও বিপক্ষে সাধারণত রিট মামলা, অর্থঋণ মামলা, সার্টিফিকেট মামলা এবং দেউলিয়া ও অন্যান্য মামলা হয়ে থাকে। এর মধ্যে সার্টিফিকেট মামলার সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি, যা ইতিমধ্যে দেড় লাখ ছাড়িয়েছে। যদিও এই সার্টিফিকেট মামলাগুলোতে জড়িত টাকার পরিমাণ তুলনামূলক কম। বর্তমানে ১১ প্রতিষ্ঠানের ১০০ মামলার বিপরীতে ৩৮ হাজার ৬৮ কোটি ৫২ লাখ টাকা জড়িত রয়েছে। এর মধ্যে খেলাপি ঋণ ও জরিমানা আদায়ের টাকা রয়েছে, আবার সংস্থাগুলোর কাছে কোনো কোনো গ্রাহকের পাওনা দাবির ঘটনাও রয়েছে।
কোন সংস্থার কত টাকা: ১০০ মামলার বিপরীতে জনতা ব্যাংক একারই ১০ মামলায় ১৫ হাজার ১৫১ কোটি ৪২ লাখ টাকা, সোনালী ব্যাংকের ৫ হাজার ৬৭৬ কোটি ৯ লাখ, অগ্রণী ব্যাংকের ৩ হাজার ৯৭৯ কোটি ৬২ লাখ, রূপালী ব্যাংকের ৩ হাজার ৭৪৭ কোটি ৫৭ লাখ, বেসিক ব্যাংকের ২ হাজার ৩৯৯ কোটি ৭০ লাখ এবং বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের (বিকেবি) ২৯৩ কোটি ৭০ লাখ টাকা।
এদিকে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক পিএলসির (বিডিবিএল) ১০ মামলায় ৮৭৫ কোটি ৬৯ লাখ, ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) ৮ মামলায় ৮৫৯ কোটি ৭৮ লাখ, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের (রাকাব) ১০ মামলায় ২৯৩ কোটি ৭০ লাখ এবং বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) ২ মামলায় ৮৩ কোটি ৮৭ লাখ টাকা জড়িত রয়েছে। এ ছাড়া সাধারণ বীমা করপোরেশনের ১০ মামলায় ৩ হাজার ৭১৯ কোটি ৪২ লাখ টাকা জড়িত।
আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের কর্মকর্তাদের তথ্য মতে, ব্যাংক খাতে শীর্ষ খেলাপি মামলার মধ্যে শীর্ষে রয়েছে মাহিন এন্টারপ্রাইজ। প্রতিষ্ঠানটির খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ হাজার ২৫১ কোটি টাকা। এ ছাড়া এফএমসি ডকইয়ার্ড লিমিটেডের খেলাপি ঋণ ১ হাজার ১৭৫ কোটি টাকা, গ্যালাক্সি সোয়েটার অ্যান্ড ইয়ার্ন ডায়িং লিমিটেডের খেলাপি ঋণ ১ হাজার ১৪৬ কোটি টাকা, রিমেক্স ফুটওয়্যার লিমিটেডের খেলাপি ঋণ ১ হাজার ৮৪ কোটি টাকা এবং প্যাসিফিক বাংলাদেশ টেলিকম লিমিটেডের ১ হাজার ৭১ কোটি ও মেরিন ভেজিটেবল অয়েল লিমিটেডের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ১ হাজার ৫৭ কোটি টাকা।
আদালত ঋণখেলাপির সম্পত্তি দখলে নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন, কিন্তু সেখানে বসে আছেন অবৈধ দখলদার। আদালত সমন জারি করেছেন, অথচ পুলিশ ধরছে না আসামিদের। এদিকে এক রিট মামলা খারিজ হলে গ্রাহক অন্য আদালতে গিয়ে আরেক রিট করছেন। এমন উদাহরণও রয়েছে যে, এক মামলার রায়ের বিপরীতে ৪৪টি রিট করা হয়েছে।
জানা গেছে, যে ঘটনায় ৪৪টি রিট মামলা হয়েছিল, তার মধ্যে ৪৩টিই খারিজ হয়ে গেছে, বাকি রয়েছে ১টি। বৈঠক থেকে বিএসইসিসহ সব প্রতিষ্ঠানকে তাগিদ দেওয়া হয়েছে, সবাই যেন গ্রাহকের সঠিক ঠিকানায় চিঠি পাঠান, পরে যাতে কেউ বলতে না পারেন যে তারা চিঠি পাননি।
বৈঠকে সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, বিষয়গুলো নিষ্পত্তির ব্যাপারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বিভাগীয় কমিশনার, অ্যাটর্নি জেনারেল, জেলা প্রশাসক ও সাব-রেজিস্ট্রি কার্যালয়ের সহযোগিতা চেয়েছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ।
সূত্রগুলো জানায়, বৈঠকে আলোচনা হয়েছে যে মামলাগুলো শুনানির তালিকায় থাকে ঠিকই, তবে নম্বর থাকে তালিকার অনেক নিচের দিকে। ফলে শুনানি হতে সময় লাগে বেশি। আবার অর্থঋণ আদালত কোনো মামলার রায় দিলে দেনাদার ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান ওই রায়ের কার্যকারিতা স্থগিত করার আবেদন জানিয়ে রিট করে। চূড়ান্ত রায় না হওয়া পর্যন্ত উচ্চ আদালতে যেতে না পারার বিধান থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে তা অনুসরণ করা হচ্ছে না। এই সুযোগ নিয়ে এক মামলার রায়ের বিপরীতেই হচ্ছে একাধিক রিট।
অর্থ মন্ত্রণালয় মনে করছে, দীর্ঘসূত্রতা ও আইনি জটিলতায় হাজার হাজার কোটি টাকা খেলাপি ঋণ আটকে আছে মামলার ফাঁদে। বর্তমানে খেলাপি ঋণসংক্রান্ত মামলার সংখ্যা সাড়ে ছয় হাজার, যার মধ্যে সাড়ে চার হাজারের বেশি মামলা সরকারি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের।
এই বিষয়ে সরকারের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব নাজমা মোবারেক বলেন, আমরা বোঝার চেষ্টা করছি কেন মামলাগুলো নিষ্পত্তি হচ্ছে না, এগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য কী করতে হবে, কী করলে দ্রুত সমাধান পেতে পারিÑ এই বিষয়ে আমরা সব পক্ষের সঙ্গে কথা বলছি।
তিনি বলেন, খেলাপিদের রিট করতে কোনো অগ্রিম অর্থ জমা দিতে হয় না। এ ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা জমা দিয়ে রিটের বিধান রাখা গেলে উচ্চ আদালতে রিট করার প্রবণতা কমে আসবে এবং ঋণখেলাপিদের কাছ থেকে অগ্রিম কিছু অর্থ আদায়ও হবে। তা ছাড়া পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ব্যাংক ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে মামলা করলেও তা শুনানির জন্য তালিকাভুক্ত হচ্ছে না, মাসের পর মাস পড়ে থাকছে। তাই মামলায় গতি আনতে বাদী হিসেবে সরকারের আইনানুগ এখতিয়ার অনুযায়ী কাজ করা হবে।