ঢাকা বুধবার, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

এক সালমানেই শেষ নজরুলের  সারা জীবনের অর্জন

রূপালী প্রতিবেদক
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২৩, ২০২৫, ১১:৫২ পিএম

আওয়ামী লীগ সরকারের দোসর ও ক্ষমতাধর ব্যক্তিরা শুধু রাষ্ট্রক্ষমতা অবৈধ দখলেই রাখেনি, বরং চরদখলের মতো দখল করেছে শত শত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থান থাকা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দখল করে মতের বিরোধী বহু কর্মকর্তা-কর্মচারীকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে দেওয়া হয়েছে ডজন ডজন মিথ্যা মামলা। নেওয়া হয়েছে আয়নাঘরে। মূলত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দখল করে টাকা লুটই ছিল তাদের উদ্দেশ্য। কোনো কোরনা ক্ষেত্রে দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) ব্যবহার করেও মামলা দেওয়া হয়। বিভিন্ন ব্যবসায়ীকে কারাগারে পাঠিয়ে লুট করা হয় তাদের প্রতিষ্ঠাগুলো। 

তেমনি আওয়ামী ফ্যাসিস্টদের ভয়ানক দুশমনির শিকার একজন ব্যবসায়ীর নাম নজরুল ইসলাম। শুধু ব্যবসায়ী মহল নয়, দেশের গ-ি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও ছিল যার সুনাম ও সুখ্যাতি। তিনি ছিলেন ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স, ফারইস্ট সিকিউরিটিজ লিমিটেড ও প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয় ট্রাস্টি বোর্ডের মতো বড় বড় সফল প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান। তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো দখল করে নেওয়ার নেপথ্যে ছিলেন পতিত শেখ হাসিনার বেসরকারি বিনিয়োগ ও শিল্পবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান। সরকারের বিভিন্ন এজেন্সিকে ব্যবহার করে নজরুল ইসলামের নামে একের পর এক মামলা দেওয়া হয়। দুদককে ব্যবহার করেও কয়েকটি মামলা দেওয়া হয় তার বিরুদ্ধে। একপর্যায়ে সপরিবারে নজরুল ইসলামকে দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়। 

জুলাই বিপ্লবের পর চরম ক্ষতির শিকার নজরুল ইসলাম বাদী হয়ে সালমান এফ রহমানের বিরুদ্ধে গুলশান থানায় তিনটি মামলা করেছেন। ওই সব মামলার বিবরণ অনুযায়ী, আওয়ামী লীগ সরকারের সময় বাদীকে (নজরুল ইসলাম) অফিসে ডেকে নিয়ে প্রধান আসামি সালমান এফ রহমানের ফরমায়েশ অনুযায়ী বাদীর ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চালাতে চাপ দিতে থাকেন। নজরুল ইসলাম তার কথায় রাজি না হওয়ায় পুলিশ দিয়ে অপহরণ, গুম ও খুন করার হুমকি দেন।

উল্লেখ্য, ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের সাবেক প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক এম এ খালেক কোম্পানি থেকে বিভিন্ন সময় প্রতারণা করে ৪৫১ কোটি ৩৭ লাখ ৬৮ হাজার ১৬৬ টাকা আত্মসাৎ করেন। পরবর্তী সময়ে কোম্পানির তৎকালীন চেয়ারম্যান নজরুল ইসলামের হস্তক্ষেপে ৩৬৯ কোটি ৬০ লাখ টাকা উদ্ধার করা হয়। বাকি ৮১ কোটি ৭৭ লাখ ৬৮ হাজার ১৬৬ টাকার জন্য মামলা করা হয়। এতে এম এ খালেক ক্ষিপ্ত হয়ে ওই সময়কার শেখ হাসিনার বিনিয়োগবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান ফজলুর রহমানের যোগসাজশে চক্রান্ত করে নজরুল ইসলামকে ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি থেকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করেন, যা পরবর্তী সময়ে বাস্তবায়ন করে অন্যায়ভাবে তাকে ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির চেয়ারম্যান পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। 

পুলিশের এক তদন্ত  রিপোর্টে বলা হয়েছে, পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি বিনিয়োগ ও শিল্পবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে স্বীকার করেছেন, নজরুল ইসলামকে আপহরণ করে, প্রতিষ্ঠান থেকে পদচ্যুত করে তাকে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করা হয়েছে। বাদীকে জিম্মি করে তার অর্থ আত্মসাৎ করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্রে স্বাক্ষর করিয়ে নেন সালমান এফ রহমান। বেশ কয়েকটি মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা দিয়ে নজরুল ইসলামকে জেলহাজতে পাঠান।

ফারইস্ট ইসলামী সিকিউরিটিজ লিমিটিডের চেয়ারম্যান ও প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান পদসহ সব ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ করে দিয়ে জোরপূর্বক দখল করে নেওয়ার কথাও স্বীকার করেছেন সালমান এফ রহমান। পুলিশের বিশেষ শাখার আরও একাধিক তদন্ত প্রতিবেদনে বেরিয়ে আসে নজরুল ইসলামকে ষড়যন্ত্রমূলক বিভিন্ন মামলায় জড়ানো ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান দখল করে নেওয়ার তথ্য।  

পুলিশ প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ২০২২ সালের ১০ সেপ্টেম্বর বাদী নজরুল ইসলামকে ডিবি পুলিশ দিয়ে বাসা থেকে তুলে নেওয়া হয় সালমান এফ রহমানের নির্দেশে। বিভিন্ন মামলায় তাকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। পরে চাপ দিয়ে সালমান এফ রহমান অপরাপর আসামিদের যোগসাজশে নজরুল ইসলামের নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিষ্ঠানসমূহের বোর্ড ভেঙে দিয়ে তড়িঘড়ি করে আলাদা বোর্ড গঠন করেন। সালমান এফ রহমানের নির্দেশে বাংলাদেশ সিকিউরিটি অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মো. শিবলী রুবায়েত উল ইসলাম (বর্তমানে দুদকের মামলায় জেলহাজতে আছেন) এবং বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রক কর্তৃপক্ষ নীতিবহির্ভূতভাবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমতি না নিয়ে ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের পরিচালনা পর্ষদ ভেঙে দেন।

কোনো কারণ ছাড়াই ২০২১ সালের ১ সেপ্টেম্বর বোর্ড ভেঙে দিয়ে একটি অন্তর্বর্তী পরিচালনা পর্ষদ গঠন করে। পরে সালমান এফ রহমানের বেক্সিমকো গ্রুপের মালিকানাধীন বেক্সিমকো গ্রুপের দুটি প্রতিষ্ঠানের নামে এবং প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থার (ডিজিএফআই) সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব.) মামুন খালেদ, একাত্তর টিভির সাবেক সিইও ও প্রধান সম্পাদক মোজাম্মেল বাবুকে পরিচালক করেন। একই সময় পতিত সরকারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চাচা শেখ কবির আহম্মেদকে চেয়ারম্যান ও সাবেক সচিব শেখ হাসিনার দোসর মো. ইব্রাহিমকে ভাইস চেয়ারম্যান করে একটি অবৈধ বোর্ড কমিটি গঠন করা হয়। 

যাদের মাধ্যমে সালমান এফ রহমান তার অসৎ উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করেন। ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ অবৈধভাবে গঠন করে নজরুল ইসলামকে অন্যায়ভাবে পরিচালনা পর্ষদ থেকে সরিয়ে দেয়। নজরুল ইসলামের নামে থাকা ফারইস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির শেয়ারগুলো কেড়ে নিতে সালমান এফ রহমান নিজে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তা নেন।

ওই সময় ঢাকা মহানগর পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত কমিশনার মো. হারুন উর রশীদ কোনো অভিযোগ না থাকা সত্ত্বেও নজরুল ইসলামের বিরুদ্ধে একের পর এক সাজানো মামলা দেন। ডিবির হারুনের নির্দেশে ডিবি পুলিশ নজরুল ইসলামকে বাসা থেকে তুলে মিন্টো রোডের ডিবি কার্যালয়ে নিয়ে যায়। সেখানে নজরুল ইসলামের কোম্পানির শেয়ারসহ সব ব্যবসার শেয়ার লিখে দেওয়ার জন্য শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতন করা হয়। নজরুল ইসলাম তাদের প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় পর পর ৬টি মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়। এসব মামলার নেপথ্যে ছিলেন সালমান এফ রহমান।

নজরুল ইসলাম ফারইস্ট লাইফ ইন্স্যুরেন্স লিমিটেড, ফারইস্ট ইসলামী সিকিউরিটিজ লিমিটেড, ফারইস্ট ইসলামী প্রোপার্টিজ লিমিটেডের সাবেক চেয়ারম্যান। এ ছাড়া তিনি প্রাইম এশিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান। তিনি মেঘনা ব্যাংক পিএলসির ও বেঙ্গল কমার্শিয়াল ব্যাংক লিমিটেডের অংশীদার।