সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় অনুষ্ঠান শারদীয় দুর্গোৎসবের মূল আনুষ্ঠানিকতা আজ রোববার থেকে শুরু হচ্ছে। গতকাল শনিবার মন্ডপে মন্ডপে পঞ্চমীতে সায়ংকালে তথা সন্ধ্যায় বোধনের মাধ্যমে দেবী দুর্গার নিদ্রা ভাঙার জন্য বন্দনাপূজা করা হয়।
আজ মহাষষ্ঠী পূজায় দেবী দুর্গার আমন্ত্রণ ও অধিবাস অনুষ্ঠিত হবে। ভক্তের ভক্তি, নিষ্ঠা ও পূজার আনুষ্ঠানিকতায় মাতৃরূপে দেবী দুর্গা অধিষ্ঠিত হবেন মন্ডপে মন্ডপে। দেবী দুর্গার আগমনে উচ্ছ্বসিত ভক্তকুল। সারা দেশে এখন চলছে উৎসবের আমেজ। ইতিমধ্যে সারা দেশে ৩৩ হাজার ৩৫৫টি মন্ডপে পূজার প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে। শারদীয় দুর্গোৎস উপলক্ষে বাণী দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
পুরাণমতে, রাজা সুরথ প্রথম দেবী দুর্গার আরাধনা শুরু করেন। বসন্তকালে তিনি পূজার আয়োজন করেছিলেন বলে এই পূজাকে বাসন্তীপূজা বলা হয়। কিন্তু রাজা রাবণের হাত থেকে স্ত্রী সীতাকে উদ্ধারের জন্য রাজা দশরথের পুত্র রামচন্দ্র শরৎকালে দুর্গাপূজার আয়োজন করেছিলেন। তাই শরৎকালের এই পূজাকে অকালবোধনও বলা হয়। বোধন দুর্গাপূজার অন্যতম আচার। বোধন শব্দের অর্থ জাগরণ বা চৈতন্যপ্রাপ্ত। পূজা শুরুর আগে সন্ধ্যায় বেলশাখায় দেবীর বোধন দুর্গাপূজার একটি অত্যাবশ্যকীয় অঙ্গ। বাঙালির হৃদয়ে শরৎকালে দুর্গার অধিষ্ঠান কন্যারূপে। প্রতি বছর বিভিন্ন বাহনে সপরিবারে শ্বশুরবাড়ি কৈলাস থেকে কন্যারূপে দেবী মর্ত্যলোকে বাবার বাড়িতে বেড়াতে আসেন।
সনাতন বিশ্বাস ও পঞ্জিকামতে, জগতের মঙ্গল কামনায় পূজার মাধ্যমে দুর্গতিনাশিনী দেবী দুর্গাকে মর্ত্যলোকে (পৃথিবীতে) আমন্ত্রণ জানানো হয়। এবার মা দুর্গা গজে (হাতি) চড়ে স্বর্গলোক থেকে মর্ত্যলোকে আসবেন (আগমন); যার ফল হিসেবে বসুন্ধরা শস্যপূর্ণা হয়ে উঠবে। দেবী স্বর্গলোকে বিদায় (গমন) নেবেন দোলায় (পালকি) চড়ে; যার ফল হচ্ছে মড়ক। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, রোগ ও মহামারির প্রাদুর্ভাব বেড়ে যাবে।
এদিকে দুর্গাপূজা উপলক্ষে গতকাল এক বাণীতে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে বৈষম্য ও দুর্নীতিমুক্ত একটি সমৃদ্ধ দেশ গড়ার যে অগ্রযাত্রা আমরা শুরু করেছি, তার সফল বাস্তবায়নে ধর্ম-বর্ণ ভেদাভেদ ভুলে সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। তিনি বলেন, সব অশুভ, অন্যায় আর অন্ধকারকে পরাজিত করে শুভচেতনার জয় হবে, বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে কল্যাণ ও সমৃদ্ধির পথেÑ দুর্গাপূজা উপলক্ষে সৃষ্টিকর্তার কাছে এই প্রার্থনা করি। প্রধান উপদেষ্টা শারদীয় দুর্গাপূজা উপলক্ষে দেশের সনাতন ধর্মাবলম্বী সব নাগরিককে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়েছেন।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, সব ধর্ম-সম্প্রদায়ের মানুষের অপূর্ব মেলবন্ধনের অনন্য নিদর্শন বাংলাদেশ। জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে আমাদের সবার পরিচয় আমরা বাংলাদেশি। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এই ধারা সমুন্নত রেখে এবারের দুর্গাপূজাও সারা দেশে নির্বিঘেœ এবং যথাযথ উৎসাহ-উদ্দীপনা ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে উদযাপিত হবে বলে প্রধান উপদেষ্টা আশা করেন।
বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি বাসুদেব ধর রূপালী বাংলাদেশকে জানান, গত ২১ সেপ্টেম্বর মহালয়ার মধ্য দিয়ে পূজার আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়েছে। ঢাকা মহানগরে এবার ২৫৯টি পূজা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। গত বছর ঢাকা মহানগরে ২৫২টি পূজার আয়োজন হয়েছিল। সে হিসেবে মহানগরে সাতটি পূজাম-প বেড়েছে। সারা দেশে ৩৩ হাজার ৩৫৫টি মন্ডপে পূজা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। গত বছর ৩১ হাজার ৪৬১টি পূজার আয়োজন করা হয়েছিল।
তিনি বলেন, সরকারের নির্দেশনায় দুর্গাপূজা উপলক্ষে প্রতিটি পূজামন্ডপের নিরাপত্তায় পুলিশ, আনসার, বিজিবি, র্যাবসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা দায়িত্ব পালন করবেন। পুলিশ ও র্যাবের পাশাপাশি প্রতিটি ম-পে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী দায়িত্ব পালন করবে। সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে সর্বাত্মক সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন সেনাপ্রধান। ঢাকেশ্বরী মন্দির মেলাঙ্গনে মহানগর সর্বজনীন পূজা কমিটির উদ্যোগে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণকক্ষ খোলা হয়েছে।
নগরীর বিভিন্ন স্থানে ঘুরে দেখা যায়, রাজধানীর মন্দিরে মন্দিরে এখন চলছে দেবী প্রতিমার রং করার কাজ। কাদামাটির প্রলেপের ওপর রংতুলির আঁচড়ে দশভুজা দেবী ষষ্ঠীর দিন পাবেন জীবন্ত রূপ। দেবী সেজে উঠবেন অপরূপ সাজে। শঙ্খ, উলুধ্বনি আর মঙ্গলসংগীতে দেবী দুর্গাকে বরণ করে নেবেন সমানতন ধর্মাম্বলী ভক্তরা। দুর্গোৎসব ঘিরে রাজধানীর পূজাম-পগুলো সাজাতে চলছে তোড়জোড়। রং-বেরঙের ফেস্টুন, ব্যানার আর বর্ণিল তোরণ নির্মাণে পূজা কমিটির সদস্যদের ব্যস্ততারও কমতি নেই। আলোকসজ্জা থেকে শুরু করে নানা আয়োজন সম্পন্নের কাজ চলছে। পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় রাস্তার ওপরই তৈরি করা হচ্ছে ম-প।
প্রসঙ্গত, মহালয়ার মধ্য দিয়ে দুর্গাপূজার আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়েছে। আগামীকাল সোমবার মহাসপ্তমী, মঙ্গলবার মহাষ্টমী, বুধবার মহানবমী ও বৃহস্পতিবার বিজয়া দশমীতে প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে দুর্গোৎসবের সমাপ্তি ঘটবে।