ঢাকা রবিবার, ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

ফসলের ন্যায্যমূল্য পাচ্ছেন না কৃষক

রেজাউল করিম, রংপুর
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ২৮, ২০২৫, ০১:১৪ এএম

শস্য বহুমুখী ও কৃষি যান্ত্রিকীকরণ, উন্নত বীজ, সার-কীটনাশক সরবরাহ, সেচব্যবস্থার উন্নয়নসহ নানা উদ্যোগে গত দেড় দশকে বদলে গেছে রংপুর তথা উত্তরাঞ্চলের কৃষি। একদিকে ফসলের নিবিড়তা বেড়েছে, অন্যদিকে আলু, ধান, ভুট্টা, শাক-সবজি, ফলমূলসহ নতুন ফসল উৎপাদনের দিকে কৃষকেরা আগ্রহী হওয়ায় মজবুত হয়ে উঠছে অঞ্চলটির কৃষিনির্ভর অর্থনীতি। তবে যাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে এ অর্জন, সেই কৃষকের ভাগ্যই পরিবর্তন হচ্ছে না। ঋণ করে ফসল উৎপাদন বাড়ালেও কাক্সিক্ষত মূল্য পাচ্ছেন না তারা।

বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, অপরিকল্পিত উৎপাদন ও বাজার ব্যবস্থাপনার কারণেই উৎপাদিত ফসলের কাক্সিক্ষত মূল্য পাচ্ছেন না কৃষক। কৃষকেরা ফসল উৎপাদনে পণ্যের চাহিদা নিরূপণ করছেন না। এতে বাজারে পণ্যের আধিক্য বাড়ায় দামও কমে যাচ্ছে। তা ছাড়া উদ্বৃত্ত ফসল সংরক্ষণেরও তেমন কোনো ব্যবস্থাপনা গড়ে ওঠেনি। ফলে বাধ্য হয়ে কৃষক উৎপাদন ব্যয়ের তুলনায় কম দামে ফসল বিক্রি করছেন।

রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ২০২৪-২৫ মৌসুমে জেলায় ৬৬ হাজার ২৮০ হেক্টর জমিতে আলু আবাদ হয়েছিল। এ থেকে উৎপাদন হয় ১৯ লাখ ৫৫ হাজার টন। অথচ আলুর বার্ষিক চাহিদা রয়েছে ১ লাখ ১৮ হাজার ৬৬৫ টন। অর্থাৎ ১৮ লাখ ৩৭ হাজার ৬৫৫ টন আলু বেশি উৎপাদন হয়েছে। জেলায় চালের বার্ষিক চাহিদা ৫ লাখ ১০ হাজার ২০৫ টন। এর বিপরীতে ২০২৪-২৫ মৌসুমে উৎপাদন হয়েছে ১২ লাখ ৩২ হাজার ৭০১ টন। ৭ লাখ ২২ হাজার ৪৯৬ টন বেশি উৎপাদন হয়েছে। শাক-সবজির চাহিদা রয়েছে বছরে ১ লাখ ১৮ হাজার ৬৬৬ টন। সেখানে ২০২৪-২৫ মৌসুমে উৎপাদন হয়েছে ৭ লাখ ৫৫ হাজার ১৪ টন। ৬ লাখ ৩৬ হাজার ৩৪৮ টন বেশি উৎপাদন হয়েছে। এ ছাড়া ২০২৪-২৫ মৌসুমে জেলায় ভুট্টা উৎপাদন হয়েছে ৩ লাখ ৯১ হাজার ২১ টন।

পীরগাছা উপজেলার তাম্বলপুর ইউনিয়নের রহমত চরের বাসিন্দা মো. সুলেমান আলী। দীর্ঘদিন ধরে কৃষিপণ্য উৎপাদন করছেন তিনি। আমন ধান চাষ করলেও প্রত্যাশিত দাম পান না। তিনি বলেন, ‘আমন ধান যখন ওঠে তখন বর্ষাকাল। আর এ সুযোগ কাজে লাগায় মধ্যস্বত্বভোগীরা। ধান ভেজা থাকার অজুহাতে কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য করা হয়। ধার-দেনা করে প্রান্তিক কৃষকেরা আবাদ করেন। ধান কাটার সময় হলে ধারের টাকা পরিশোধের চাপ থাকে। বাধ্য হয়ে অর্ধেক দামে ধান বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। মৌসুমভিত্তিক বিভিন্ন সবজিও আবাদ করেন তিনি। তবে যোগাযোগব্যবস্থা ভালো না হওয়ায় কাছাকাছি বাজারে অল্প দামে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন।’

মিঠাপুকুরের রানীপুকুর ইউনিয়নের এলুয়াচড়া পানবাড়ি এলাকার কৃষক হাজি মো. হাফিজুর রহমান এ বছর ২২ বিঘা (৩৩ শতকে বিঘা) জমিতে আলু আবাদ করেছিলেন। কিছু আলু মৌসুমের শুরুতে ১২ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেছেন। কিছুটা বেশি লাভের আশায় হিমাগারে রেখেছেন। কিন্তু এখন প্রতি কেজি আলু ১২-১৫ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে। হিমাগারে ভাড়া প্রতি কেজিতে ৬ টাকা। অন্যান্য খরচ পরিশোধ করলে প্রতি কেজি আলুর দাম পড়ে ৫ টাকা।

তিনি বলেন, ‘সরকার প্রতি কেজি আলুর দাম হিমাগার গেটে ২২ টাকা নির্ধারণ করলেও তা কোথাও মানা হচ্ছে না। অথচ খুচরা বাজারে ওই আলু ১৮-২০ টাকা কিনে খেতে হচ্ছে।’

প্রতিবছর সবজির কাক্সিক্ষত মূল্য না পেলেও তার মতো কৃষকরা চাষাবাদ অব্যাহত রেখেছেন বলেও জানান হাফিজুর রহমান। কিছু দিন আগে লাউ ও বেগুন আবাদ করেছিলেন। ফলনও ভালো হয়েছিল। কিন্তু পাইকার না আসায় স্থানীয় বাজারে অল্প দামে বিক্রি করতে হয়েছে।

তিনি অভিযোগ করেন, যদি এলাকায় সবজি হিমাগার থাকত তাহলে কৃষক উদ্বৃত্ত শস্য সংরক্ষণ করতে পারতেন। যখন ভালো দাম পাওয়া যেত তখন বিক্রি করতেন।

উৎপাদিত ফসলের কাক্সিক্ষত মূল্য না পাওয়া প্রসঙ্গে রংপুর আঞ্চলিক কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (অবসরপ্রাপ্ত) উদ্যান বিশেষজ্ঞ মো. মেসবাহুল ইসলাম বলেন, ‘এলাকাভিত্তিক উপযোগী শস্য উৎপাদন (ক্রপ জনিং) ব্যবস্থা দ্রুত বাস্তবায়ন জরুরি। যদি এটি কার্যকর থাকত তাহলে এবার আলুর মূল্য বিপর্যয় হতো না। কারণ তখন কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর আলুর চাহিদা নিরূপণ করে কৃষকদের নির্দিষ্ট জমিতে আবাদের জন্য উৎসাহিত করত। কৃষকও উৎপাদিত আলুর প্রত্যাশিত দাম পেতেন।’

ফসলের কাক্সিক্ষত মূল্য না পাওয়ার বেশ কিছু কারণও উল্লেখ করেছেন মেসবাহুল ইসলাম। তার মতে, মুক্তবাজার অর্থনীতির নিয়ম-কানুন যেভাবে চলার কথা সেভাবে চলছে না, বীজনীতি সঠিকভাবে প্রয়োগের অভাব রয়েছে। হাইব্রিড বীজের ক্ষেত্রে যেভাবে মনিটরিং হওয়া দরকার সেভাবে হচ্ছে না, চর থেকে মূল ভূখ-ের অনুন্নত যোগাযোগব্যবস্থার সুযোগ নিচ্ছে মধ্যস্বত্বভোগীরা। ফলে প্রতারিত হচ্ছেন কৃষক। এ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের উপযোগী বীজ এবং দুর্যোগ সহনশীল জাত প্রান্তিক পর্যায়ে ব্যবহার নেই বললেই চলে।

মেসবাহুল ইসলাম বলেন, ‘কৃষি বিমা চালুর প্রতিবন্ধকতা দূর করে দ্রুত বিমার আওতায় আনতে হবে প্রান্তিক কৃষকদের। কৃষিপণ্য ব্যাপকভাবে বিদেশে রপ্তানিযোগ্য করতে প্রান্তিক কৃষকদের উত্তম কৃষিচর্চার আওতায় আনতে হবে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ঢাকায় কৃষিপণ্য আনতে পরিবহন সহজীকরণের উদ্যোগও নিতে হবে।’