শুক্রবার, ২৪ অক্টোবর, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


মেহেদী হাসান খাজা

প্রকাশিত: অক্টোবর ২৪, ২০২৫, ১২:৫২ এএম

‘ফিটনেসবিহীন’ বিআরটিএ ঘুষে আনফিট গাড়িও ‘ফিট’

মেহেদী হাসান খাজা

প্রকাশিত: অক্টোবর ২৪, ২০২৫, ১২:৫২ এএম

‘ফিটনেসবিহীন’ বিআরটিএ  ঘুষে আনফিট গাড়িও ‘ফিট’

বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) কার্যালয়ে গাড়ির কাগজপত্র করতে গেলেই ধরতে হয় দালাল। বিআরটিএ’র কর্মকর্তাদের পছন্দের দালাল না ধরলে কোনো কাজই হয় না। তা ছাড়া চাহিদামতো টাকা না দিলে নিয়ম মেনে গাড়ির যেকোনো ধরনের কাজ করতে গেলেও পদে পদে হয়রানির শিকার হতে হয়। এতে সময়, শ্রম সবই নষ্ট হয়। কথাগুলো বলছিলেন রাজধানীর মিরপুরে বিআরটিএতে সেবা নিতে আসা আর রহমান। মি. রহমান জানান, গাড়ির ফিটনেস, রেজিস্ট্রেশন, কাগজপত্র নবায়নÑ সবকিছুই পানির মতো সহজ হয় কর্মকর্তাদের পরিচিত দালাল ধরলে। দালাল না ধরলে পড়তে হয় নানা ধরনের জটিলতায়। আবির নামের আরেক ভুক্তভোগী রূপালী বাংলাদেশকে জানান, বিআরটিএ হলো দালালদের আখড়া। তিনি অভিযোগ করে বলেন, ‘এখানে ঘুষ ছাড়া গাড়ির ফিটনেস, রেজিস্ট্রেশন, কাগজপত্র নবায়ন অসম্ভব হয়ে উঠে; এক কথায় বলা যায়, এসব ছাড়া কোনো কাজই হয় না।’ তিনি অভিযোগ করে বলেন, গাড়ির সবকিছু ঠিক থাকলেও ঘুষ ছাড়া অন্যকিছু চেনে না বিআরটিএ। গাড়ির কাগজপত্র নিয়ম মেনে করতে গেলেও ঘুষ না দিলে বিআরটিএ কর্মকর্তাদের টালবাহানা ও ফন্দিফিকিরে যেকোনো মানুষের পড়তে হয়। অন্যথায় ঘুরতে হয় এ টেবিল থেকে ওই টেবিল।

সেবাগ্রহীতাদের অভিযোগ, বিআরটিএ এখন নিজেই ফিটনেসবিহীন। তাদের নিজেদের কোনো নিয়মনীতি নেই, এখানে টাকার বিনিময়ে যেকোনো আনফিটনেস যানবাহনকে ফিটনেস হিসেবে চালিয়ে দেওয়া হয়। এই সংস্থাটি ঘুষের বিনিময়ে নিজ দায়িত্বে আনফিট গাড়িও ‘ফিট’ করে দেয়। তা ছাড়া দেখে, ক্ষমতা দেখে দেওয়া হয় ফিটনেস। যদিও এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ফিটনেস নবায়নে ঘুষ নেওয়ার ব্যাপারে অথরিটি অবগত নয়। যদি কেউ এমন করে থাকে এবং প্রমাণ পাওয়া যায়, তবে তার বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

যানবাহনের মালিকদের প্রতি বছর ছুটতে হয় বিআরটিএতে : বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী একটি বাণিজ্যিক বাসের জন্য রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট, ফিটনেস সার্টিফিকেট, ট্যাক্স টোকেন, ইন্স্যুরেন্স সার্টিফিকেট এবং রুট পারমিট থাকা বাধ্যতামূলক। এর মধ্যে রেজিস্ট্রেশন সার্টিফিকেট একবার নেওয়া হলে আজীবনের জন্য বৈধ থাকে, কিন্তু বাকিগুলো প্রতি বছর নবায়ন করতে হয়। ফলে প্রতি বছর যানবাহনের মালিকদের ছুটতে হয় নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) সার্কেল অফিসে।

ঘুষ না দিলে ফিটনেস সার্টিফিকেট দেওয়া হয় না :

বাসমালিকদের অভিযোগ, নির্ধারিত ফি দেওয়ার পরও ঘুষ ছাড়া ফিটনেস সার্টিফিকেট পাওয়া যায় না। তাদের ভাষায়, ‘গাড়ির সবকিছু ঠিক থাকলেও অতিরিক্ত টাকা না দিলে ফিটনেস সার্টিফিকেট দেওয়া হয় না।’ তাদের হিসাবে, এই ঘুষের পরিমাণ ন্যূনতম ৫-৭ হাজার থেকে সর্বোচ্চ ১৫-২০ হাজার টাকা পর্যন্ত। যেসব বাসে কোনো ত্রুটি থাকে না, তাদের ক্ষেত্রে অন্তত ৫-৭ হাজার টাকা দিতে হয় কর্মকর্তাদের দালালদের মাধ্যমে। আর যেসব বাসে প্রকৃত সমস্যা থাকে, সেগুলোর ক্ষেত্রে সমস্যার ধরন অনুযায়ী ১৫-২০ হাজার টাকা পর্যন্ত ঘুষ গুনতে হয় বলে অভিযোগ।

বিআরটিএ’র নিজেরই ফিটনেস আছে কি না, সেটাই প্রশ্ন : যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আসলে বিআরটিএ’র নিজেরই ফিটনেস আছে কি নাÑ সেটাই এখন প্রশ্ন। তারা মনে করেন, বিদেশে যেখানে ফিটনেস পরীক্ষায় ব্যর্থ যানবাহন সরাসরি বাতিল করে দেওয়া হয়, সেখানে আমাদের দেশে ঘুষের বিনিময়ে ফিটনেস সনদ দেওয়া হয়। ফলে যাত্রীদের নিরাপত্তা মারাত্মকভাবে ঝুঁকির মুখে পড়ছে। বিষয়টি নিয়ে কর্তৃপক্ষ বলছে, ঘুষের বিনিময়ে ফিটনেস সনদ দেওয়ার বিষয়ে তারা অবগত নন। যদি প্রমাণ পাওয়া যায়, তাহলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সম্প্রতি রূপালী বাংলাদেশের সঙ্গে পাঁচটি বাস কোম্পানির মালিকের কথা হয় ফিটনেস নবায়ন নিয়ে। তবে তারা কেউই নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি। পাঁচজনই এক বাক্যে বলেছেন, ‘ঘুষ ছাড়া বিআরটিএ থেকে বাসের ফিটনেস নেওয়া অসম্ভব।’ আন্তঃজেলা রুটে চলাচলকারী বাসমালিক মোহাম্মদ আহমেদ রাজু বলেন, ‘আগে গাড়ি বিআরটিএ অফিসে না নিয়ে গিয়েও ফিটনেস সার্টিফিকেট পাওয়া যেত। কিন্তু এখন গাড়ি নিয়ে যেতে হয়। সেখানে নানা ধরনের টেস্ট করা হয়। ইন্ডিকেটর লাইট, ব্রেক, গ্লাস, এমনকি বাহ্যিক রং চকচকে অবস্থাও দেখা হয়। কিন্তু যত ফিট গাড়িই হোক না কেন, টাকা না দিলে টেস্টে ফেল করানো হয়।’ ‘গাড়ি নিয়ে গেলেও কিছু টাকা দিতেই হবে। যদি আমি টাকা না দিই, তাহলে তারা একটা না একটা ভুল বের করবেই। এটা তো আর বিদেশ না যে গাড়ি ফিট থাকলে সার্টিফিকেট দিবেই। সব ঠিক থাকলেও অন্তত পাঁচ হাজার টাকা দিতে হয়। আর যদি কোনো সমস্যা থাকে, তাহলে তার ভিত্তিতে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত দিতে হয়। টাকা দিতে হয় দালালের হাতে। না দিলে ইন্সপেক্টর ভুল ধরবেই।’

নিয়মের শেষ নেই :

বাসমালিক ফয়সাল জানান, গাড়ির সামনের গ্লাসে সামান্য ফাটা থাকলে সেটাও ধরে ফেলেন ইন্সপেক্টর। অথচ ওই দাগ নিয়ে দীর্ঘ সময় গাড়ি চালানো সম্ভব। এখন যদি গ্লাসটা পুরোপুরি পাল্টাতে যাই, তাহলে অন্তত ৪০ হাজার টাকা খরচ হয়। তাই মালিকরা ঘুষ দিয়ে ফিটনেস নিতে বাধ্য হন। না দিলে বিশাল ক্ষতি। এসব কষ্ট গাড়ির মালিকরাই বুঝবে। তার অভিযোগ, ঢাকা শহরে গাড়ি ঢুকলে বাসের রং ঠিক থাকে না। কেউ না কেউ ঘষা দেবেই। ফলে রং উঠে যায়। অথচ নতুন করে রং করাতে এক লাখ টাকার বেশি খরচ হয়। এত খরচের পরও যদি সামান্য রং ওঠে, সেটার জন্যও তারা গাড়িকে ফেল করিয়ে দেন। একাধিক বাসমালিক জানান, রেজিস্ট্রেশন করাতে কখনো কখনো ৩৫ হাজার টাকার বেশি ঘুষ দিতে হয়। একটি গাড়ির বডি বানাতে অন্তত ১৮-২০ লাখ টাকা খরচ হয়। সব কাগজ ঠিক থাকার পরও ইন্সপেক্টর বলবেন, সিট কাভার ময়লা, তাই গাড়িটা পুরোনো মনে হচ্ছেÑ রেজিস্ট্রেশন হবে না। পরে বাধ্য হয়ে ৩০-৩৫ হাজার টাকা ঘুষ দিয়ে রেজিস্ট্রেশন নিতে হয়েছে।’ এতে বোঝা যায়, সরকার নিজেই যাত্রীদের ঝুঁকিপূর্ণ গাড়িতে ওঠার সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছে। ফলে যাত্রীদের নিরাপত্তা এখন পুরোপুরি প্রশাসনিক অনিয়মের হাতে জিম্মি।

ঘুষের বিনিময়ে আনফিট গাড়িও ‘ফিট’ :

এ বিষয়ে যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান বলেন, ‘ফিটনেস প্রদানের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা বিআরটিএ’র অবস্থাও প্রশ্নবিদ্ধ। এটি আসলে একটি উচ্চমাত্রার টেকনিক্যাল কাজ, যেখানে গাড়ির যান্ত্রিক ও কাঠামোগত সক্ষমতা বিশ্লেষণ করতে হয়। কিন্তু সংস্থাটির নিজস্ব টেকনিক্যাল সক্ষমতা দুর্বল। অনেক ক্ষেত্রেই চোখে দেখে ফিটনেস সার্টিফিকেট দেওয়া হয়, আবার ঘুষের বিনিময়ে আনফিট গাড়িকেও ‘ফিট’ ঘোষণা করা হয়। তাই এখন প্রশ্ন উঠেছেÑ যানবাহনের ফিটনেস দেখার আগে বিআরটিএ’র নিজের ফিটনেস আছে কি না, সেটাই আগে দেখা দরকার।’

ঘুষের ব্যাপারে অবগত নই, ধরা পড়লেই ব্যবস্থা :

সার্বিক বিষয় নিয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) চেয়ারম্যান আবু মমতাজ সাদ উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, ‘ফিটনেস নবায়নে ঘুষ নেওয়ার ব্যাপারে আমি অবগত নই। যদি কেউ এমন করে থাকে এবং প্রমাণ পাওয়া যায়, তবে তার বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ধরা পড়লে কোনোভাবে ছাড় দেওয়া হবে না।

এদিকে অভিযোগ আছে, কার্যালয়ে গাড়ির কাগজপত্রের কাজ নিয়ম মেনে করতে গেলেই বিপদে পড়তে হয়। সরকারি ফি মেটানোর পর বাড়তি টাকা দিলেই মেলে ‘ওয়ান স্টপ সার্ভিস’। গ্রাহকের পকেট কাটতে ঘাটে ঘাটে প্রস্তুত দালাল। কাজের ধরন বুঝে দরকষাকষি। প্যাকেজ হিসেবে চুক্তিতে কাজ করা হয়। এসব অনিয়মের সমাধান হবে কবেÑ এমন প্রশ্নের জবাবে সংস্থাটির চেয়ারম্যান আবু মমতাজ সাদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, পরিবহন খাতের দীর্ঘদিনের অব্যবস্থাপনা আর জনভোগান্তির কেন্দ্রে থাকা বিআরটিএ এখন আধুনিকায়নের পথে হাঁটছে। লাইসেন্সবিহীন চালক, ফিটনেসবিহীন লক্কড়ঝক্কড় বাস আর ঘুষের চক্রÑ এমন নানা অভিযোগের বেড়াজাল অতিক্রম করে আগামীতে বিআরটিএকে ঢেলে সাজানো সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আশা করি, এমন পদক্ষেপগুলো সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে পারলে সংস্থাটি আধুনিকায়ন হয়ে উঠবে। পাশাপাশি গ্রাহকদের ভোগান্তিও কমবে বলে আশা করেন বিআরটিএ’র চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, এই সংস্থাটিকে ঠিক করতে কাঠামোগত চ্যালেঞ্জ ও সীমাবদ্ধতা রয়েছে। সেই সঙ্গে দক্ষ চালক তৈরি, ডিজিটাল সেবা চালু এবং সড়ক দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের আর্থিক সহায়তা প্রদানে সময়সীমা বৃদ্ধির মতো বাস্তবিক বেশকিছু পদক্ষেপও নেওয়া হচ্ছে যাতে বিআরটিএ দেশের মানুষের কাছে একটি সেবামুখি প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠে।

রূপালী বাংলাদেশ

Link copied!