জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সদস্যসচিব আখতার হোসেন বলেছেন, আওয়ামী লীগকে ফ্যাসিবাদী দলে পরিণত করেছে জাতীয় পার্টি (জাপা)। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ দলটির আওয়ামী লীগ হয়ে ওঠার পেছনে সবচেয়ে বেশি দায়ি জাতীয় পার্টি। এই জাতীয় পার্টি আসলে জাতীয় পার্টি নয়, জাতীয় পার্টি মানেই আওয়ামী লীগ। আখতার হোসেন আরও বলেন, আওয়ামী লীগকে নির্বাচনের বাইরে রাখলেও জাতীয় পার্টির সুযোগ পাওয়ার অর্থ হলো, আওয়ামী লীগই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করল। গতকাল রোববার রাজধানীর কাকরাইলের ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে গণঅধিকার পরিষদের চতুর্থ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা বক্তব্যে আখতার হোসেন এ কথা বলেন।
গতকাল রোববার গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হকের সভাপতিত্বে এবং মুখপাত্র ফারুক হাসানের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে সমসাময়িক রাজনীতি আরও কথা বলেন, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু, খেলাফত মজলিসের মহাসচিব আহমদ আবদুল কাদের, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের মহাসচিব জালালুদ্দীন আহমদ, খেলাফত আন্দোলনের নায়েবে আমির মুজিবুর রহমান হামিদী, নাগরিক ঐক্যের সাধারণ সম্পাদক শহীদুল্লাহ্ কায়সার।
এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেন বলেন, আওয়ামী লীগ আগামী নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না, সেটি সরকারের পক্ষ থেকে আশ্বস্ত করা হয়েছে। আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে নিয়ে আসার জন্য যারা বক্তব্য দিচ্ছেন, দেশবিরোধী বক্তব্য দিচ্ছেন, তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। আখতার হোসেন আরও বলেন, রাষ্ট্রের মৌলিক সংস্কার বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একমত হয়েছে। জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি দেওয়ার বিষয়েও এক হয়েছে দলগুলো। তারপরও এখান থেকে কিছু অর্জন করা যায়নি। দেশকে এই সংকট থেকে উত্তরণ করতে হলে জুলাই সনদের পরিপূর্ণ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশের প্রতিটি দল জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি চায়। বাধা কোথায়, সেটি খুঁজে বের করতে হবে বলে মন্তব্য করেন আখতার হোসেন। যদি কারো দলীয় স্বার্থের কারণে সনদ বাস্তবায়ন বাধাগ্রস্ত হয়, সেই দলের সঙ্গে কথা বলে তাদের দলীয় স্বার্থ থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানাতে হবে বলেন তিনি। বাংলাদেশের প্রশ্নে রাজনৈতিক দলগুলোকে এক হতে হবে বলে মন্তব্য করেন।
অনুষ্ঠানে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, জুলাই হচ্ছে জাতীয় জীবনে রাজনৈতিক সমঝোতার একটি ঐহিতাসিক পূর্ণাঙ্গ দলিল। যা বাস্তবায়নের জন্য আমরা সবাই অঙ্গীকারবদ্ধ এবং সেই বাস্তবায়নের জন্য সুনির্দিষ্ট ফোরাম হচ্ছে একটি নির্বাচিত জাতীয় সংসদ। এখানে কোনো দলের সেই বিষয়ে কোনো দ্বিমত নেই। সেই জাতীয় সংসদে জুলাই সনদ বাস্তবায়নের জন্য যাতে জাতীয় সংসদ বাধ্য থাকে সেই একটা আইন ভিত্তি করতে এখন সেই প্রস্তাব জাতীয় সংসদের কাছ থেকে প্রস্তাব অথবা সুপারিশ সরকারের কাছে দেওয়া। সেই সুপারিশটা দেওয়ার পরেই আমরা জানতে পারব কি প্রক্রিয়ায় সেই আইনটা রচনা করতে চাচ্ছে।
সব রাজনৈতিক দলের উদ্দেশে সালাহউদ্দিন বলেন, আমরা যেন কোনোভাবেই আইনানুগ প্রক্রিয়ার বাইরে না যাই, সাংবিধানিক প্রক্রিয়ার বাইরে না যাই। আমরা যেন এই জাতিকে একটি সুষ্ঠু নিয়মতান্ত্রিক ধারার মধ্যে দিয়ে পরিচালনা করি। কারণ অনেকেই আবেগের বশবর্তী বলে থাকেন যে, জুলাই গণঅভ্যুত্থানে যে জনগণের অভিপ্রায় প্রকাশিত হয়েছে সে অভিপ্রায়ের অবনতি ঘটবে বলে অনেক কিছু বৈপ্লবিক আদেশ জারি করা যায়Ñ এই বক্তব্য হচ্ছে আবেগের বক্তব্য। কারণ জনগণের অভিপ্রায়কে বাস্তবায়ন করার জন্যই আমরা সবাই সংবিধানের আশ্রয় নিয়েছি এবং সাংবিধানিকভাবেই এই সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছি এবং এখনো পর্যন্ত আইনানুগভাবে সাংবিধানিকভাবে আমরা এই রাষ্ট্রটা পরিচালনা করছি।
বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেছেন, এখন আর রাস্তায় আন্দোলনের সময় নয়, জনগণের কাছে গিয়ে আগামী নির্বাচনে ঐক্যবদ্ধভাবে অংশ নেওয়ার মাধ্যমে দেশে গণতান্ত্রিক শাসন ফিরিয়ে আনতে হবে। পাশাপাশি সাংঘর্ষিক ও প্রতিহিংসামূলক রাজনীতি পরিহার করে সহনশীলতার সংস্কৃতি ফিরিয়ে আনতে হবে। বিএনপির এ নেতা বলেন, শেখ হাসিনার পতনের পর ১৪ মাস অতিক্রম হয়েছে, কিন্তু বাংলাদেশে এখনো গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ফিরে আসেনি এবং কাক্সিক্ষত নির্বাচিত সংসদ সরকারও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এ জন্যই জনগণের মালিকানা এবং সাংবিধানিক অধিকার ফিরিয়ে আনার লক্ষ্যে এক দশকের বেশি সময় ধরে চলা কঠিন আন্দোলনে সবাই একসঙ্গে ছিলেন। এই সংগ্রামের ফলস্বরূপ যে রাজনৈতিক অর্জন, অর্থাৎ জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার, তা নিশ্চিত করতে এখন বাকি কাজ সম্পন্ন করতে হবে।
জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, নির্বাচনকে উপলক্ষ্য করে বিভিন্ন পরাশক্তি ও এজেন্সি সক্রিয়। কিন্তু সবাই ঐক্যবদ্ধ থাকলে পরাশক্তি ও অভ্যন্তরীণ শক্তি নির্বাচন ও নতুন দেশ গঠন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করতে পারবে না। জাতীয় নির্বাচনের দিকে যে অভিযাত্রা শুরু হয়েছে, সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে তা এগিয়ে নিতে হবে।
অনুষ্ঠানে গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেছেন, নির্বাচন ছাড়া সংস্কার বাস্তবায়িত হবে না। বিপ্লব করলেও শেষ পর্যন্ত পার্লামেন্ট লাগে; একটা সংসদ, একটা সংবিধান কিংবা যেকোনো কিছুকে বৈধতা দিতে। একটা জনপ্রতিনিধির মধ্য দিয়ে বৈধতা দেওয়া হয়। কাজেই আগামী সংসদের নির্বাচন ছাড়া আমরা এই পুরো সংস্কার প্রক্রিয়াকে সম্পন্ন করতে পারব না। আমরা আইনি বাধ্যবাধকতার বিষয়ে একমত হয়েছি।
সাকি বলেন, যে সনদ (জুলাই জাতীয় সনদ) তৈরি হয়েছে তার ওপর ভিত্তি করে মৌলিক সংস্কারের ক্ষমতা আমরা গণভোটের মাধ্যমে আগামী সংসদের কাছে অর্পণের ব্যাপারে একমত হয়েছি। এই কাজ যদি আমরা সম্পন্ন করতে পারি, তাহলে বাংলাদেশে সত্যি সত্যি আমরা নতুন যাত্রা তৈরি করতে পারব। নির্বাচনকে কোনোভাবে প্রলম্বিত কিংবা বাধাগ্রস্ত করলে সেটি আমাদের কারো জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে না।
গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর বলেন, আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে জাতীয় পার্টির বিষয়ে ফয়সালা হওয়া দরকার। নির্বাচন বিঘিœত হোক আমরা এমন কোনো কাজ চাই না। কিন্তু জাতীয় পার্টির বিষয়ে ফয়সালা না হয়ে যদি আমরা নির্বাচনে যাই, তাহলে আমাদের জন্য শনির দশা অপেক্ষা করছে। এই জাতীয় পার্টির মাধ্যমেই আওয়ামী লীগ ব্যাক করবে।
নুরুল হক নুর বলেন, ফরিদপুর, মাদারীপুর ও খুলনাসহ যেসব এলাকা একটু আওয়ামী লীগ হিসেবে পরিচিত, ওইসব এলাকায় জাতীয় পার্টির মাধ্যমেই তারা নির্বাচনে নাশকতা করতে চেষ্টা করবে। আন্তর্জাতিকভাবে নির্বাচনকে কলঙ্কিত করতে চেষ্টা করবে। কাজেই জাতীয় পার্টির বিষয়ে নির্বাচনের আগে আমাদের একটা ফয়সালায় যাওয়া দরকার। কিছুদিন আগেই জি এম কাদের একটা বক্তব্য দিয়েছিলেন। তিনি কীভাবে এই দুঃসাহস দেখাতে পারেন এবং বলতে পারেন আওয়ামী লীগ ছাড়া নাকি এই দেশে কোনো নির্বাচন হবে না। এই কথা বলার পর জি এম কাদের কীভাবে এই ঢাকার রাজপথে তার অফিসে আসেন, তার উত্তরার বাড়িতে অবস্থান করেন।
গণঅধিকার পরিষদের এই শীর্ষ নেতা বলেন, আমরা চাই আগামীর বাংলাদেশ গণঅভ্যুত্থানের আকাক্সক্ষায় গড়ে উঠবে। আগামীর বাংলাদেশে হানাহানি, মারামারি ও বিভাজন থাকবে না। আমরা সবাই চাচ্ছি যে, নির্বাচন যথাসময় হোক। রাজনৈতিক নেতাদের একটা কথা মনে রাখতে হবে। এই গণঅভ্যুত্থানের সময় ছাত্র-যুবক-তরুণরা আন্দোলন করেছেন। তারা আহত হয়েছেন, গ্রেপ্তারও হয়েছেন। একইসঙ্গে রাজনৈতিক নেতাদেরও কিন্তু প্রথম গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

