ঢাকা মঙ্গলবার, ২৮ অক্টোবর, ২০২৫

মাইলস্টোন ট্র্যাজিডি

তিন মাস পর ঘরে ফিরল দীপ্ত

রূপালী প্রতিবেদক
প্রকাশিত: অক্টোবর ২৮, ২০২৫, ০১:২২ এএম
  • ৩৬ বার অস্ত্রোপচার এবং ৮ বার করা হয়েছে স্কিন গ্রাফটিং

রাজধানীর উত্তরার মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান বাহিনীর যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় আহত নাভিদ নেওয়াজ দীপ্ত দীর্ঘ তিন মাস পর ঘরে ফিরল। আগুনের লেলিহান শিখা, তীব্র যন্ত্রণার চিৎকার ও জীবন-মৃত্যুর সীমান্তে অদম্য লড়াই করে দীপ্ত ফিরল নতুন জীবনে, ফিরল আপনজনদের কাছে। গতকাল সোমবার জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের ১৩০১ নম্বর কেবিন থেকে ছুটি মিলেছে ছেলেটির। মাইলস্টোন ট্র্যাজেডিতে বার্ন ইউনিটের ৩ নম্বর বেড থেকে চিকিৎসাযাত্রা শুরু হয়েছিল দীপ্তর। শরীরের ৪৫ শতাংশ দগ্ধ, ইনহেলেশন ইনজুরি নিয়ে চিকিৎসকেরা বলেছিলেন, এমন কেসে বেঁচে থাকা ‘কিছুটা অলৌকিক’। দীর্ঘ লড়াই শেষে দীপ্ত ফিরে গেল মমতাময়ী মা নুরুন নাহার, ছোট বোন নায়রা আফরিন আর পোষা পাখিদের ডাকের কাছে। এটি শুধু একটি ছেলের গল্প নয়; এটি সাহস, ভালোবাসা এবং পুনর্জন্মের কাহিনি; যে কাহিনির শিরোনাম দীপ্ত আগেই বাবাকে বলে গিয়েছিল। দীপ্ত বলেছিল, ‘বাবা, আমি তো বন্ধুদের সাহায্য করেছি, নিশ্চয়ই বেঁচে যাব।’

গত ২১ জুলাই সোমবার দুপুর ১টা ১০ মিনিটের দিকে স্কুলের ঘণ্টা বেজে ওঠে ক্লাস শেষ হওয়ার সংকেতে। গেটের সামনে অপেক্ষায় ছিলেন স্বজনেরা। এরই মধ্যে হঠাৎ আকাশ থেকে নেমে এলো বিমান বাহিনীর একটি এফটি-৭ বিজিআই যুদ্ধবিমান, আছড়ে পড়ল হায়দার আলী ভবনে। বিস্ফোরণ, আগুন, ধোঁয়াÑ সব মিলিয়ে এক অপ্রত্যাশিত নরক। তখন আইএসপিআর জানিয়েছিল, যুদ্ধবিমানটি নিয়মিত প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে সোমবার বেলা ১টা ৬ মিনিটে ঢাকার কুর্মিটোলায় বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর ঘাঁটি এ কে খন্দকার থেকে উড্ডয়নের পর যান্ত্রিক ত্রুটির সম্মুখীন হয় (যা বিস্তারিত তদন্ত সাপেক্ষে জানানো হবে)। দুর্ঘটনা মোকাবিলায় এবং বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে ওই বিমানের বৈমানিক ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মো. তৌকির ইসলাম বিমানটিকে ঘনবসতি এলাকা থেকে জনবিরল এলাকায় নিয়ে যাওয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত বিমানটি ঢাকার দিয়াবাড়িতে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের দোতলা একটি ভবনে অনাকাক্সিক্ষত দুর্ঘটনায় বিধ্বস্ত হয়েছে। এই আকস্মিক দুর্ঘটনায় বৈমানিকসহ ৩৫ জন নিহত এবং ১৭১ জন আহত হয়। এর মধ্যে ছিল সপ্তম শ্রেণির দীপ্ত, যার শরীরের ৪৫ শতাংশ পুড়ে যায় বন্ধুদের বাঁচাতে গিয়ে। জানা গেছে, দুর্ঘটনার তদন্ত চলছে এখনো, কিন্তু প্রাথমিক রিপোর্ট বলছে, বিমানটি টেকঅফের পরপরই নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। এতে ২৭ জন শিক্ষার্থী, কয়েকজন শিক্ষক এবং পাইলটসহ মোট ৩৫ জনের জীবন কেড়ে নেয় আগুন। শিক্ষিকা মেহরীন চৌধুরী, যিনি প্রাণ দিয়ে ২০ জনের প্রাণ রক্ষা করেন, হয়ে ওঠেন এই ট্র্যাজেডির প্রতীক।

মাইলস্টোনে অগ্নিকা-ের পরে জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে দীপ্তর চিকিৎসাযাত্রা শুরু হয় ৩ নম্বর বেডে। শরীরের ৪৫ শতাংশ দগ্ধ, ইনহেলেশন ইনজুরি। চিকিৎসকেরা বলেছিলেন, এমন কেসে বেঁচে থাকা ‘কিছুটা অলৌকিক’। লাইফ সাপোর্টে, যন্ত্রের শব্দের মধ্যে দীপ্ত লড়াই করে। এক হাত নড়ানোর ক্ষমতা রেখে সে মোনাজাত করে বাবাকে বলে, ‘বাবা, তুমি আমার কেমন বাবা যে নিজের সন্তানকে একটু জড়িয়ে ধরতেও পারো না?’ বাবা মিজানুর রহমানের তখন চোখে জল, ‘প্রতিটা মুহূর্ত একটা নতুন অভিজ্ঞতা। আমরা ফ্লোরে ঘুমাই, কিন্তু ছেলের জন্য সব সহ্য করি।’

ওই সময় আইসিইউ থেকে বাবা-মাকে দীপ্ত বলে, ‘তোমাদের ছেড়ে যাব না।’ বাবার রাগে পোষা পাখিগুলো ছাড়ার কথা শুনে আবদার করে যতœ নেওয়ার। ছোট বোন নায়রাকে আর কখনো বকবে নাÑ দেয় সেই প্রতিশ্রুতিও। ‘বন্ধুদের বাঁচাতে চেষ্টা করেছি, আমি তো মরব না।’ এই কথা তার অদম্য চেতনার প্রমাণ।

বাবা মিজানুর বলেন, ছেলেকে জড়িয়ে ধরতে পারছিলাম না, কিন্তু আজ হাত ধরতে পারলাম। দীপ্ত আমার মতোই বন্ধুভক্ত। জান দিয়ে সাহায্য করে। মামা-মামি, আত্মীয়স্বজন, বাবার স্কুলবন্ধু আদনান, সোহাগÑ সবাই পালা করে থেকেছে হাসপাতালে। পরিবার জাতীয় বার্ন হাসপাতাল, চিকিৎসক এবং দেশবাসীর কাছে কৃতজ্ঞ। এমন ট্র্যাজেডি আর না আসুক আমাদের জাতির জীবনে।

গতকাল ইনস্টিটিউটের যুগ্ম পরিচালক ডা. মারুফুল বলেন, ২১ জুলাই এই ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনায় নাভিদের শরীরের ৪৫ শতাংশ পুড়ে গিয়েছিল। সিএমএইচ থেকে পরদিন তাকে বার্ন ইনস্টিটিউটে আনা হয়। শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ায় পরপর দুবার তার পরিবারকে মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে বলা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, যে কোনো সময় দুঃসংবাদ আসতে পারে! তবে চিকিৎসকেরা হাল ছাড়েননি। মোট ২২ দিন সে আইসিইউতে ভর্তি ছিল, যার মধ্যে ১০ দিন রাখা হয়েছিল লাইফ সাপোর্টে। এরপর ৩৫ দিন হাইডিপেনডেন্সি ইউনিটে (এইচডিইউ) রাখা হয়। এরপর ৪০ দিন কেবিনে থাকার পর আজ (গতকাল) তাকে পুরোপুরি সুস্থ ঘোষণা করেন চিকিৎসকেরা।

ডা. মারুফুল ইসলাম বলেন, নাভিদের মোট ৩৬ বার ছোট-বড় অপারেশন হয়েছে। শরীরের ক্ষতস্থানে ত্বক প্রতিস্থাপন হয়েছে আটবার। এ ঘটনায় অন্য কোনো দগ্ধ রোগীর এটি লাগেনি।

ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. নাসির উদ্দিন বলেন, নাভিদকে যেদিন এখানে নিয়ে আসা হলো, সেদিন সে বারবার বাঁচার আকুতি জানাচ্ছিল। সে বলছিল, ‘আমাকে বাঁচান, আমি কি বাঁচব? দুর্ঘটনায় পুড়ে যাওয়ার পর তার ফুসফুসে পানি জমেছিল। এ জন্য লাইফ সাপোর্টেও উপুড় করে শুইয়ে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছিল। এটি খুবই চ্যালেঞ্জিং। সেখান থেকে সে সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরছে। এখনো এ ঘটনার পাঁচজন দগ্ধ শিক্ষার্থী ভর্তি রয়েছে। তারাও ভালো আছে। সপ্তাহখানেক পর তারাও বাড়িতে চলে যাবে।