ঢাকা বুধবার, ২৯ অক্টোবর, ২০২৫

গাজীপুর মহানগর

শ্রমিকদের টার্গেট করে বেড়েছে চুরি-ছিনতাই

মো. শহিদুল ইসলাম, গাজীপুর
প্রকাশিত: অক্টোবর ২৯, ২০২৫, ০১:০৯ এএম

গাজীপুর যেন ছিনতাইকারী ও অপরাধীদের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। রাত নেই দিন নেই, হরহামেশাই ঘটছে চুরি-ছিনতাই। ঘটছে হতাহতের ঘটনা। অনেক সময় এসব কর্মকা-ে অতিষ্ঠ হয়ে আইন নিজের হাতে তুলে নিচ্ছে বিক্ষুব্ধ জনতা। আর এতে গণপিটুনিতে নিহতের সংখ্যাও বাড়ছে।

স্থানীয়দের দাবি, ছিনতাইকারীদের প্রধান টার্গেট থাকেন সাধারণত শিল্পকারখানার শ্রমিকেরা। বিশেষ করে মাসের শুরুতে কারখানাগুলোতে বেতন-ভাতা দেওয়ার সময় তাদের অপতৎপরতা বেড়ে যায়। এ ছাড়া কর্মস্থলে যাওয়া-আসার সময় অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে স্বর্বস্ব লুটে নেয় দুষ্কৃতকারীরা। এতে ভয় ও আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন তারা।

শুধু পোশাকশ্রমিক নন, চুরি-ছিনতাই বেড়ে যাওয়ায় আতঙ্ক ভর করেছে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে। আর এ জন্য পুলিশের উদাসীনতা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অপ্রতুল তৎপরতা, নজরদারির অভাবকে দায়ী করেছেন স্থানীয়রা।

পুলিশ বলছে, চুরি-ছিনতাই রোধ এবং মানুষের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পুলিশ কাজ করছে। তবে অপ্রতুল লোকবল দিয়ে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পুলিশকে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে।

জানা গেছে, গত ১৯ অক্টোবর রাত সাড়ে ৮টার দিকে পলিটেকনিকের শিক্ষার্থী জাহিদুল আহসান জিহাদ তার মায়ের কাছ থেকে ৩ হাজার টাকা নিয়ে পলিটেকনিকের ফি জমা দেওয়ার জন্য কলেজ রোডের দিকে আসছিলেন। পথে আউচপাড়ার সাহাজ উদ্দিন সরকার রোডের গলিতে ঢুকলে অজ্ঞাতনামা চার-পাঁচজন ছিনতাইকারী জাহিদুল, তার বন্ধু রহমান ও আরিফের গতি রোধ করে। এ সময় রহমান ও আরিফ দৌড়ে পালিয়ে গেলেও ছিনতাইকারীরা জিহাদকে ছুরিকাঘাত করে। স্থানীয় লোকজন তাকে উদ্ধার করে স্থানীয় ঢাকা ইম্পেরিয়াল হাসপাতালে নিয়ে যান। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যাওয়ার পথে জিহাদ মারা যান।

এই হত্যাকা-ের রেশ কাটতে না কাটতেই গত মঙ্গলবার দুপুরে টঙ্গীর স্টেশন রোড এলাকায় মোবাইল ফোন ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টাকালে স্থানীয়রা এক যুবককে আটক করে গণপিটুনি দেয়। এ সময় তার শরীরের বিভিন্ন স্থানে লবণ ছিটিয়ে উল্লাস করে উত্তেজিত জনতা। পরে তাকে শহীদ আহসান উল্লাহ মাস্টার জেনারেল হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসকেরা মৃত ঘোষণা করেন।

পুলিশের একটি সূত্র জানায়, বেশির ভাগ কারখানাশ্রমিকের বেতন-ভাতা সাধারণত মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে শুরু করে দ্বিতীয় সপ্তাহের মধ্যে পরিশোধ করে। এই সময়ে কারখানা এলাকায় সুযোগসন্ধানী দুষ্কৃতকারীরা চুরি-ছিনতাই করে। সাধারণত ব্যাংকের এটিএম বুথগুলোতে নজর রেখে শ্রমিকদের টার্গেট করে তারা। পরে ভয়ভীতি দেখিয়ে স্বর্বস্ব লুটে নেয়।

শ্রমিকদের অভিযোগ, কারখানার ফটক ও আশপাশে মাদকাসক্তরা নিয়মিত অবস্থান করে। বেতন পাওয়ার সময় এদের উৎপাত বেড়ে যায়। হামলা, ছিনতাই, হেনস্তা থেকে শুরু করে নির্যাতনের মতো ঘটনা ঘটিয়ে টাকা ছিনিয়ে নেয় তারা। ফলে অনেকেই বাধ্য হয়ে চাকরি বদলাচ্ছেন।

শ্রীপুর পৌরসভার ভাঙ্গাহাটি এলাকার গার্মেন্টস শ্রমিক ফজলুল হক বলেন, ‘গত এপ্রিলে রাতের ডিউটি শেষে বাসায় ফিরছিলাম। পথে কয়েক যুবক এসে আমাকে আটকায়। তারা টাকা দাবি করে। না দিতে চাইলে রাস্তার পাশের জঙ্গলে নিয়ে আমাকে মারধর করে। শেষ পর্যন্ত ৩ হাজার টাকা দেওয়ার শর্তে ছেড়ে দেওয়া হয়।’ তিনি জানান, ভয়ে তিনি থানায় অভিযোগ করেননি। পরে অন্য কারখানায় চাকরি নেন।

একই অভিজ্ঞতার কথা জানান ডেকো গার্মেন্টস, রিদিশা গার্মেন্টস, ডিবিএল গার্মেন্টস, এক্স সিরামিক, নিট হরাইজন, আমান গার্মেন্টস, সিজি গার্মেন্টস, মেঘনা গার্মেন্টস, সাদমা গ্রুপসহ মহানগরের বেশির ভাগ কারখানার শ্রমিকেরা।

মৌচাক এলাকার সাদমা গ্রুপের পরিচালক সোহেল রানা বলেন, সাধারণত ব্যাংকের বুথ থেকে বেতন উত্তোলন বা নগদ টাকা বহনের সময় শ্রমিকদের আটকে টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনা অহরহ ঘটছে। কারণ, এ সময় শ্রমিকদের টার্গেট করা সহজ হয়। এ কারণে মোবাইল ব্যাংকিং আরও সহজতর করতে হবে, যেন শ্রমিকদের বুথে গিয়ে লম্বা লাইনে না দাঁড়াতে হয়।

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গত ১০ মাসে মহানগর এলাকার বিভিন্ন থানায় ১৭৮টি ছিনতাইয়ের মামলা হয়েছে। এ সময় পুলিশ ঘটনায় জড়িত ১ হাজার ৪৩১ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। আর জেলার পাঁচটি থানা এলাকায় জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ১০ মাসে দস্যুতা মামলা হয়েছে ২৭টি। এসব মামলায় এজাহারনামীয় আসামি ১৮ জনসহ অজ্ঞাত ২০ থেকে ২৫ জনকে আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছে ১৪ জন।

স্থানীয়দের দাবি, অনেক সময় চুরি-ছিনতাইয়ের শিকার হলেও সাধারণ মানুষ ও শ্রমিকেরা থানায় অভিযোগ দেন না। পুলিশি হয়রানি ও সন্ত্রাসীদের ভয়ে অনেক ভুক্তভোগী ঘটনা চেপে যান। ফলে বিচার না হওয়ায় অপরাধীরা পার পেয়ে যায়।

গাজীপুর মহানগর পুলিশের (জিএমপি) ভারপ্রাপ্ত কমিশনার জাহিদ হাসান বলেন, চুরি-ছিনতাই রোধে বিভিন্ন এলাকায় টহল পুলিশের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। বিশেষ করে টঙ্গী ফ্লাইওভার ও চান্দনা চৌরাস্তায় সন্ধ্যার পর অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়। এজন্য টঙ্গী পূর্ব থানায় গত এক মাসে ৪৮ জন ছিনতাইকারীকে আমরা গ্রেপ্তার করেছি। তাদের অনেকেই চুরি-ডাকাতির প্রস্তুতিসহ বিভিন্ন মামলার আসামি। এ ছাড়া অপরাধ নিয়ন্ত্রণে পুলিশের পাশাপাশি বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের লোকজনও কাজ করছে।