একই দিনে ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং করপোরেশনের (বিবিসি) শীর্ষ দুই কর্মকর্তার পদত্যাগের ঘটনা নজিরবিহীন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে নিয়ে তৈরি এক তথ্যচিত্র সম্পাদনার জেরে সমালোচনার মুখে পদত্যাগ করেছেন বিবিসির মহাপরিচালক টিম ডেভি ও বার্তা বিভাগের প্রধান ডেবোরাহ টারনেস। গত ৩ নভেম্বর সোমবার দ্য টেলিগ্রাফ বিবিসির ফাঁস হওয়া এক অভ্যন্তরীণ মেমো ফাঁস করে। এ থেকে জানা যায়, ‘প্যানোরামা’ তথ্যচিত্রে ট্রাম্পের ভাষণের দুটি অংশ এমনভাবে সম্পাদনা করা হয়, যাতে মনে হচ্ছিল ২০২১ সালের জানুয়ারিতে ক্যাপিটল হিলের দাঙ্গাকে তিনি উসকে দিয়েছিলেন।
ডেভি গত পাঁচ বছর ধরে বিবিসির মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তিনি নানা বিতর্ক ও পক্ষপাতের অভিযোগের মুখে পড়েছিলেন। ব্রিটিশ আরেক সংবাদমাধ্যম টেলিগ্রাফের ফাঁস করা অভ্যন্তরীণ নথির বরাতে জানা গেছে, বিবিসির প্যানোরামা অনুষ্ঠানে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ভাষণের দুটি অংশ কেটে একত্র করা হয়। ফলে মনে হয়, ট্রাম্প ২০২১ সালের জানুয়ারিতে ক্যাপিটল হিলে দাঙ্গায় উৎসাহ দিয়েছিলেন।
২০২১ সালের ৬ জানুয়ারি ওয়াশিংটন ডিসিতে দেওয়া ভাষণে ট্রাম্প বলেছিলেনÑ ‘আমরা ক্যাপিটলে হেঁটে যাব এবং আমরা আমাদের সাহসী সিনেটর, কংগ্রেসম্যান ও নারীদের উৎসাহিত করব।’ কিন্তু প্যানোরামা তথ্যচিত্রে সম্পাদনায় দেখানো হয়েছে, ট্রাম্প বলছেনÑ ‘আমরা ক্যাপিটলে হেঁটে যাব... এবং আমি আপনাদের সঙ্গে থাকব। আর আমরা লড়াই করব। আমরা প্রাণপণে লড়ব।’
তথ্যচিত্রে প্রথম অংশের পর যে অংশটি জোড়া লাগানো হয়, সেটি ট্রাম্প বলেছিলেন ৫০ মিনিটেরও বেশি সময়ের ব্যবধানে। মেমো ফাঁস হওয়ার পরই বিবিসিকে ঘিরে সমালোচনা শুরু হয়। হোয়াইট হাউস সংস্থাটিকে ‘১০০ ভাগ ভুয়া’ আখ্যা দিয়েছে।
ট্রাম্প এই পদত্যাগকে স্বাগত জানিয়েছেন। ওই দুজনকে ‘খুবই অসৎ মানুষ’ বলে সমালোচনা করেছেন। বিবিসির অনুষ্ঠান ‘প্যানোরামা’তে ট্রাম্পের একটি বক্তৃতার দুটি ভিন্ন অংশকে এমনভাবে সম্পাদনা করে জুড়ে দেওয়া হয়েছিল, যাতে মনে হচ্ছিল তিনি ২০২১ সালের জানুয়ারিতে ক্যাপিটল হিলের দাঙ্গায় উসকানি দিচ্ছেন।
গতকাল সোমবার বিবিসি চেয়ারম্যান সামির শাহ তাদের পদত্যাগ নিয়ে বলেন, ‘এটি বিবিসির জন্য একটি দুঃখের দিন।’ তিনি শীর্ষ কর্মকর্তা ডেভির প্রতি নিজের ও বিবিসি বোর্ডের পূর্ণ সমর্থন থাকার কথা উল্লেখ করেন। তিনি আরও বলেন, ‘তবুও আমি বুঝতে পারি তার ওপর ব্যক্তিগত ও পেশাগত চাপ অব্যাহত ছিল, যা তাকে আজ এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করেছে। পুরো বোর্ড তার পদত্যাগের এই সিদ্ধান্ত এবং এর কারণকে সম্মান জানাচ্ছে।’
ফাঁস হওয়া মেমোটি লিখেছিলেন মাইকেল প্রেসকট। তিনি বিবিসির এডিটোরিয়াল স্ট্যান্ডার্ডস কমিটির স্বাধীন এক্সটারনাল অ্যাডভাইজর ছিলেন। গত জুনে তিনি এই পদ থেকে বিদায় নেন।
মেমোতে তিনি বিবিসির তৃতীয় লিঙ্গবিষয়ক সংবাদ প্রতিবেদনগুলো নিয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি আরও লেখেন, যখন বিষয়গুলো সামনে আসে, তখন বিবিসির ব্যবস্থাপনা পর্ষদ কোনো পদক্ষেপ না নেওয়ায় তার মধ্যে ‘হতাশা’ জন্ম নেয়।
দ্য টেলিগ্রাফ প্রকাশিত অভ্যন্তরীণ মেমোতে আরও দেখা যায়, বিবিসি আরবি’র ইসরায়েল-গাজা যুদ্ধের পক্ষপাতদুষ্ট কাভারেজের বিষয়েও যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। বিবিসির সংস্কৃতি ও মিডিয়াবিষয়ক সম্পাদক কেটি রাজাল বলেন, আমার মনে হয়, সর্বশেষ বিতর্ক তার (টিম ডেভি) জন্য অতিরিক্ত চাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে, কারণ এর আগে একের পর এক সংকটের মুখোমুখি হয়েছেন। আরেকটি সংকট মোকাবিলার শক্তি তার কাছে অবশিষ্ট ছিল না।
বিবিসির সাবেক কমিউনিকেশন প্রধান জন শিল্ড বলেন, ‘মহাপরিচালকের কাজ হলো জনসেবার মধ্যে সবচেয়ে কঠিন কাজগুলোর একটি।’ তিনি আরও বলেন, ‘তিনি খুব কর্মক্ষম নেতা এবং বাস্তব পরিবর্তন এনেছেন, কিন্তু একেবারে এত চাপ সহ্য করা সম্ভব নয়।’ গত রোববার সন্ধ্যায় পদত্যাগের ঘোষণা দিয়ে টিম ডেভি বলেন, সব সরকারি প্রতিষ্ঠানের মতো বিবিসিও নিখুঁত নয়।
আমাদের সব সময় উন্মুক্ত, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক থাকতে হবে। যদিও এটি আমার সিদ্ধান্তের একমাত্র কারণ নয়, তবে বিবিসি নিউজকে ঘিরে চলমান বিতর্ক নিঃসন্দেহে আমার সিদ্ধান্তে ভূমিকা রেখেছে। ‘মোটের ওপর বিবিসি ভালো কাজ করছে, তবে কিছু ভুলও হয়েছে, আর মহাপরিচালক হিসেবে এর পূর্ণ দায় আমাকে নিতে হবে।’
রোববার রাতে এক বিবৃতিতে ডেবোরা টারনেস বলেন, প্যানোরামা সংক্রান্ত বিতর্ক এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে, যা এখন বিবিসির জন্য ক্ষতির কারণ হচ্ছে। তিনি আরও যোগ করেন, ‘এর দায় শেষ পর্যন্ত আমারই।’

