রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে আবারও তৎপর যুক্তরাষ্ট্র। এ নিয়ে ২৮ দফা শান্তি পরিকল্পনায় অনুমোদন দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। প্রশাসনের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এনবিসি নিউজকে এ তথ্য জানিয়েছেন। কর্মকর্তা বলেন, ‘এই পরিকল্পনা উভয় পক্ষের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা এবং দীর্ঘস্থায়ী শান্তি নিশ্চিত করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করে তৈরি। ইউক্রেন টেকসই শান্তি বজায় রাখার জন্য যা চায় এবং যা প্রয়োজন, তা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।’ কিন্তু তিনজন মার্কিন কর্মকর্তা এনবিসি নিউজকে বলেছেন, শান্তিচুক্তির কাঠামো এখনো ইউক্রেনের কাছে উপস্থাপন করা হয়নি। ঘনিষ্ঠ সূত্রানুসারে, বুধবার সেনাসচিব ড্যানিয়েল ড্রিসকলের নেতৃত্বে একটি মার্কিন সেনা প্রতিনিধিদল দুটি মিশন নিয়ে কিয়েভ ভ্রমণ করেছে। একটি হলো সামরিক কৌশল ও প্রযুক্তি নিয়ে আলোচনা করা, অন্যটি শান্তি প্রক্রিয়া পুনরায় শুরু করার জন্য প্রশাসনের প্রচেষ্টাকে সমর্থন করা। একজন মার্কিন কর্মকর্তা এই সফরকে ‘শান্তি আলোচনা পুনরায় শুরু করার’ হোয়াইট হাউসের প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
ট্রাম্প তার এ পরিকল্পনা মানতে ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির জেলেনস্কিকে বাধ্য করা হবে বলে ইঙ্গিত দিয়েছে ওয়াশিংটন। আর এতে করে ইউক্রেন সার্বভৌমত্ব হারাতে পারে বলে মত অনেকের। এদিকে যুদ্ধবিরতি ইস্যুতে মধ্যস্থতা করতে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের শরণাপন্ন হয়েছেন ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির জেলেনস্কি। আঙ্কারা রাজি হলেও সবুজ সংকেত মেলেনি মস্কোর পক্ষ থেকে।
রাশিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোনের আঘাতে লন্ডভন্ড ইউক্রেনের পশ্চিমাঞ্চলের টেরনোপিল শহর। রাতভর সেখানকার বেসামরিক ভবন লক্ষ্য করে রুশ বাহিনী অভিযান চালিয়েছে বলে অভিযোগ কিয়েভের। সে সময় অর্ধশত ক্ষেপণাস্ত্র এবং প্রায় ৫০০ ড্রোন দিয়ে হামলা চালায় মস্কো। এতে হতাহত হন অনেক ইউক্রেনীয়। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের দেওয়া বেশ কিছু ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংসের দাবি রাশিয়ার। গত বুধবার রাশিয়ার পশ্চিমাঞ্চলের কয়েকটি শহরে বেসামরিক নাগরিকদের লক্ষ্য করে ইউক্রেনীয় সেনারা হামলা চালালে সে সময় তাদের প্রতিহত করে রুশ বাহিনী।
ইউক্রেনে রাশিয়ার তীব্র হামলার মধ্যেই যুদ্ধ বন্ধে তৎপর যুক্তরাষ্ট্র। চলতি সপ্তাহে দুই দেশের চলমান যুদ্ধের ইতি টানতে ২৮টি পয়েন্ট সংবলিত পরিকল্পনা অনুমোদন করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। মার্কিন প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ইউক্রেনে দীর্ঘমেয়াদি শান্তি ফেরাতেই এ উদ্যোগ।
ট্রাম্পের অনুমোদিত এই যুদ্ধবিরতি পরিকল্পনা মানতে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির জেলেনস্কিকে চাপ দেওয়া হবে বলেও জানিয়েছে মার্কিন প্রশাসন। তবে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানানো হয়নি ওয়াশিংটনের পক্ষ থেকে। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে বিষয়টি খুব একটা স্পষ্ট না করলেও এরই মধ্যে ট্রাম্পের যুদ্ধবিরতি পরিকল্পনা নিয়ে শুরু হয়েছে আলোচনা-সমালোচনা। এতে ইউক্রেন স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব হারাতে যাচ্ছে বলে মত অনেকের। কারণ জেলেনস্কি যদি ট্রাম্পের পরিকল্পনা মেনে নেয়, তাহলে তাকে ইউক্রেনের অনেক অঞ্চল ছেড়ে দিতে হবে। লাগাম টানতে হবে সামরিক সক্ষমতার। রাশিয়াকে ইউক্রেনের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট যখন যুদ্ধবিরতি ইস্যুতে কিয়েভকে চাপ দিচ্ছে, তখন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের শরণাপন্ন ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির জেলেনস্কি। এ নিয়ে যৌথ সংবাদ সম্মেলন করেন এ দুই নেতা। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর এখন পর্যন্ত সরাসরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়নি দুই দেশের প্রেসিডেন্টের মধ্যে। তবে তুরস্কের মধ্যস্থতায় ইউক্রেনের সঙ্গে বৈঠকে বসতে রাজি নয় বলে জানিয়েছে মস্কো।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির জেলেনস্কি বলেন, ‘শান্তি ও নিরাপত্তা আলোচনায় কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছি। যুদ্ধ এখানেই বন্ধ হওয়া দরকার। শান্তির কোনো বিকল্প নেই। রাশিয়ার বিষয়টি বুঝতে হবে।’
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়েপ এরদোয়ান বলেন, ‘ইউক্রেন যুদ্ধবিরতি আলোচনাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে রাশিয়ার সঙ্গে মধ্যস্থতায় আপত্তি নেই। আশা করি রক্তক্ষয়ী এ যুদ্ধ দ্রুতই শেষ হবে।’ এদিকে, যুদ্ধবিরতি ইস্যুতে আলোচনা করতে মার্কিন সেনাপ্রধান ড্যানিয়েল ড্রিসকলের নেতৃত্বে কিয়েভে পৌঁছেছেন পেন্টাগন কর্মকর্তারা। ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে বৈঠকে বসার কথা রয়েছে তাদের।
বুধবার তুরস্কে দেশটির প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়েপ এরদোয়ানের সঙ্গে বৈঠক করেছেন জেলেনস্কি, বৃহস্পতিবার তার সঙ্গে বৈঠক করতে মার্কিন সামরিক বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের একটি দল কিয়েভ পৌঁছেছে।
শান্তি আলোচনা অগ্রসর করার লক্ষ্যেই এসব বৈঠক হচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছে। মার্কিন সেনা সচিব ড্যান ড্রিসকলের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল ‘তথ্য অনুসন্ধান অভিযানে’ কিয়েভ এসেছেন বলে জানিয়েছে কিয়েভের মার্কিন দূতাবাস। সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ জেনারেল র্যান্ডি জর্জও ওই প্রতিনিধিদলে রয়েছেন। টেলিগ্রামে করা মন্তব্যে জেলেনস্কি ওয়াশিংটনের প্রস্তাবিত কাঠামো নিয়ে কিছু না বললেও সাড়ে তিন বছরের বেশি সময় ধরে চলা যুদ্ধ বন্ধে মার্কিন নেতৃত্বকে কার্যকর ভূমিকা রাখার আহ্বান জানান। ‘রক্তপাত বন্ধ ও স্থায়ী শান্তি অর্জনে আমাদের সব অংশীদারকে মিলেমিশে কাজ করতে হবে এবং মার্কিন নেতৃত্বকে দৃঢ় ও কার্যকর থাকতে হবে।’ আঙ্কারায় এরদোয়ানের সঙ্গে বৈঠকের পর এমনটাই লেখেন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট। ‘যুদ্ধের চূড়ান্ত অবসানের মতো যথেষ্ট ক্ষমতা’ কেবল যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পেরই আছেÑ বলেছেন তিনি। জেলেনস্কি বলেন, ‘আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে তুরস্ক প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দিতে প্রস্তুত।’ জুলাইয়ে ইস্তাম্বুলে বৈঠকের পর কিয়েভ ও মস্কোর কর্মকর্তাদের মধ্যে আর কোনো মুখোমুখি বৈঠক হয়নি। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে যুদ্ধকেষত্রে রাশিয়ার সাফল্যের গতিও বাড়ছে, ইউক্রেনজুড়ে তাদের হামলার মাত্রাও বেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পনা, জেলেনস্কির দৌড়ঝাঁপÑ সব মিলিয়ে শান্তি আলোচনা পুনরায় শুরুর উদ্যোগ গতি পেয়েছে বলেই মনে হচ্ছে; যদিও রাশিয়া তাদের আগের শর্তগুলো থেকে সামান্য সরেছে এমন কোনো ইঙ্গিতও পাওয়া যাচ্ছে না। রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন অনেক দিন ধরেই কিয়েভকে মার্কিন নেতৃত্বাধীন নেটো জোটে অন্তর্ভুক্তির ইচ্ছা ত্যাগ এবং দোনেৎস্ক, লুহানস্ক, জাপোরিঝিয়া ও খেরসন থেকে সেনা প্রত্যাহার করতে বলে আসছে। এই চার অঞ্চলকে মস্কো রাশিয়ার অংশ হিসেবে দাবি করে আসছে। তবে ইউক্রেন বারবার বলে আসছে, তারা রাশিয়ার এসব শর্তের কাছে মাথা নোয়াবে না।

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন