ঢাকা শুক্রবার, ২১ নভেম্বর, ২০২৫

ওয়ারিশদের তথ্য সংরক্ষণে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে অসন্তোষ

মাইনুল হক ভূঁইয়া
প্রকাশিত: নভেম্বর ২১, ২০২৫, ০১:৪২ এএম

ওয়ারিশদের তথ্য আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমে (এমআইএস) সংরক্ষণে সরকারি সিদ্ধান্তে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। তারা বলছেন, নিজেদের তথ্য এমআইএসে অন্তর্ভুক্তির সময় ওয়ারিশদের নাম উল্লেখ করা সত্ত্বেও এখন এমআইএসে সংরক্ষণের সময় নতুন করে তথ্য দেওয়ার সিদ্ধান্ত তাদের ভাবিয়ে তুলেছে।

এই প্রেক্ষাপটে রূপালী বাংলাদেশের অনুসন্ধানে দেখা যায়, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী পারিবারিক সনদ দেওয়ার বাধ্যবাধকতা বীর মুক্তিযোদ্ধাদের হয়রানির মুখে ফেলে দিয়েছে। প্রাসঙ্গিকভাবেই ওয়ারিশদের জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে সব প্রয়োজন মেটানো গেলেও পারিবারিক সনদ প্রদানের আবশ্যকতা তাদের উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। তা ছাড়া বিষয়টি প্রথম শ্রেণির গেজেটেড কর্মকতাদের দিয়ে করানোর বিধানও রাখা যেত। কারণ পারিবারিক সনদ যেখান থেকে নিতে হবে, সেই ওয়ার্ড সচিবের কাছে গিয়ে তাদের নানা বিড়ম্বনার সম্মুখীন হতে হচ্ছে।

চব্বিশের ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে ওয়ার্ড কাউন্সিলর না থাকায় ওয়ার্ড সচিবগণ ওয়ার্ডের কাজকর্ম দেখভাল করে আসছেন। কিন্তু অধিকাংশ ওয়ার্ডেই কাউন্সিলরদের পাশাপাশি সচিবরাও পালিয়ে যাওয়ায় সেই সব ওয়ার্ড সমস্যাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। সেখানে সংশ্লিষ্ট সিটি করপোরেশন ভারপ্রাপ্ত সচিব নিয়োগ দিয়ে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করে। তবু ওয়ার্ডগুলোতে কাক্সিক্ষত সুফল আসেনি। অনেক ওয়ার্ডে বাতি জ¦ালিয়েও তাদের খুঁজে পাওয়া যায় না। তারা কোথায় থাকেন, এর হদিস কেউ বলতে পারেন না। ডিএসসিসির পাশাপাশি ডিএনসিসির ওয়ার্ডগুলোতেও একই অবস্থা। 

ফলে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ভারপ্রাপ্ত ওয়ার্ড সচিবদের হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াতে হয়Ñ কেউ তাদের পান, কেউ পান না। এ কারণে সেখানে দালাল তৈরি হচ্ছে এবং দিনে দিনে তাদের দৌরাত্ম্য বেড়েই চলেছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন অসুস্থ বীর মুক্তিযোদ্ধা জানান, তাদের ওয়ার্ডে ডিএসসিসির কর্মচারী পরিচয়ে এক যুবক মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে ৩-৫ হাজার টাকা আদায় করছেন। মুক্তিযোদ্ধারা সরল বিশ^াসে তাতেই সম্মত হচ্ছেন। এমনকি তারা এতখানি পেরেশানিতে পড়ে গেছেন যে, এই যুবক সত্যি সত্যি ডিএসসিসির মনোনীত কি না, তা যাচাইয়ের সুযোগও তারা পাচ্ছেন না। অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধা ধৈর্য হারিয়ে তাদের ওয়ারিশদের তথ্য না দেওয়ার সংকল্প করে ফেলেছেন। তারা বলছেন, যা হয় হোক, আর পেরেশান হতে চাই না। কেউ কেউ আবার অজানা আশঙ্কায় আর কোনো তথ্য দিতে উৎসাহী হচ্ছেন না।

এদিকে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলো থেকে আসা ক্রমাগত টেলিফোন তাদের আরও বেশি হয়রানি করে তুলেছে। জানা গেছে, এমন একটি ফোন পেয়ে গুরুতর অসুস্থ একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা ঢাকা থেকে তার উপজেলা পর্যন্ত ছুটে গেছেন। কী কারণে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে এমন টানাহ্যাঁচড়া- কোনো তরফ থেকেই এর কোনো যৌক্তিক উত্তর মেলেনি। সার্বিক বিষয়ে জানার জন্য ১৯ নভেম্বর সন্ধ্যায় রূপালী বাংলাদেশ কথা বলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব ইশরাত চৌধুরীর সঙ্গে। তিনি বললেন, এ তথ্য দিতে অনীহা দেখানোর কিছু নেই। বীর মুক্তিযোদ্ধাদের স্বার্থেই এটি দেওয়া দরকার। তাহলে ভুয়া ওয়ারিশদের হাত থেকে রেহাই পাওয়া যাবে। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, দেখা গেছে ভাই তার বোনকে বঞ্চিত করছে, ভুয়া বউ সাজিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধার বউয়ের টাকা তুলে নিচ্ছে- এসব ঠেকাতে এ সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে।

পারিবারিক ওয়ারিশ সনদ নিতে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের হয়রানির বিষয়টি নজরে আনা হলে সচিব ইশরাত চৌধুরী বলেন, ‘বিষয়টি আমি খতিয়ে দেখব- আপনি অফিস সময়ে ফোন করুন।’ পরদিন ২০ নভেম্বর দুই দফা ফোন করলেও তিনি রিসিভ করেননি। বিষয়টি নিয়ে সোনালী ব্যাংক ধানমন্ডি করপোরেট শাখায় যোগাযোগ করলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা আকবর হোসেন জানান, একটু কষ্ট হলেও পারিবারিক সনদ দেওয়া ভালোÑ এতে আসল-নকল চেনা সম্ভব হবে এবং বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রকৃত ওয়ারিশরা উপকৃত হবেন।

উল্লেখ্য, সম্প্রতি মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কল্যাণ-২ শাখার সিনিয়র সহকারী সচিব আখিনুর জাহান নীলা স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ওয়ারিশদের তথ্য আগামী দুই মাসের মধ্যে ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (এমআইএস) সফটওয়্যারে  সংরক্ষণের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অফিস আদেশে বলা হয়েছে, উপর্যুক্ত বিষয়ের পরিপ্রেক্ষিতে সব বীর মুক্তিযোদ্ধার (জীবিত/মৃত) পারিবারিক/ওয়ারিশদের (পিতা, মাতা, সন্তান, স্ত্রী) তথ্য ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (এমআইএস) সফটওয়্যারে সংরক্ষণের জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। এমআইএস সফটওয়্যারে ওয়ারিশদের তথ্য সংরক্ষণ করার পদ্ধতি নি¤œরূপ।

মুক্তিযোদ্ধার তথ্য প্রদর্শিত প্রত্যেক বীর মুক্তিযোদ্ধার তথ্যের তালিকার সর্বশেষ আইকন, বীর মুক্তিযোদ্ধার প্রোফাইলের ওয়ারিশ তথ্য। উল্লেখ্য, জীবিত বীর মুক্তিযোদ্ধার ক্ষেত্রে পারিবারিক সনদ এবং মৃত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষেত্রে ওয়ারিশ সনদ আপলোড করতে হবে। জীবিত ও মৃত ওয়ারিশ/সদস্যদের তথ্য পৃথকভাবে এন্ট্রি করার অপশন রয়েছে (কপি সংযুক্ত)। জীবিত সব ওয়ারিশের ক্ষেত্রে জাতীয় পরিচয়পত্র যাচাই-পূর্বক ভেরিফাই করে ওয়ারিশদের তথ্য অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। মৃত ওয়ারিশের ক্ষেত্রে ওয়ারিশদের মৃত্যু সনদ, মৃত্যুর তারিখ অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। সে ক্ষেত্রে মৃত ওয়ারিশদের জাতীয় পরিচয়পত্র যাচাইয়ের প্রয়োজন নেই। সব ক্ষেত্রে একাধিক ওয়ারিশের তথ্য অন্তর্ভুক্ত করার সুযোগ রয়েছে।

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ভাতাপ্রাপ্ত কোনো ওয়ারিশ মৃত্যুবরণ করলে তার তথ্য মৃত ওয়ারিশদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। বীর মুক্তিযোদ্ধা সম্মানী ভাতা বিতরণ কমিটির সদস্যসচিব হিসেবে ব্যবস্থাপক, সোনালী ব্যাংক, পিএলসি উল্লিখিত তথ্য এন্ট্রি করবেন এবং সভাপতি হিসেবে জেলা প্রশাসক/উপজেলা নির্বাহী অফিসার অনুমোদন করবেন। বর্ণিত অবস্থায়, এমআইএস সফটওয়্যারে সব বীর মুক্তিযোদ্ধার (জীবিত/মৃত) ওয়ারিশদের তথ্য আগামী দুই মাসের মধ্যে অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করে মন্ত্রণালয়কে অবহিত করার জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হলো।