ঢাকা শুক্রবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০২৫

মোহাম্মদপুরে মা-মেয়ে হত্যা

গলার পোড়া দাগের ক্লুতেই ঘাতক শনাক্ত 

রূপালী প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১২, ২০২৫, ০৬:৫৪ এএম
  • আয়েশা ৬ দিন ও তার স্বামী রাব্বী ৩ দিনের রিমান্ডে 
  • জুলাই মাসে আরেক বাসায় চুরি করেন আয়েশা
  • চুরি করা ফোন ও রক্তাক্ত কাপড় ফেলা হয় সিঙ্গাইর ব্রিজ থেকে নদীতে

রাজধানীর মোহাম্মদপুরে মা-মেয়েকে কুপিয়ে হত্যার প্রধান আসামি আয়েশার আগে থেকেই চুরির অভ্যাস ছিল। চলতি বছরের গত জুলাই মাসেও ওই এলাকার বাবর রোডের একটি বাসা থেকে টাকা চুরি করে পালিয়ে যান। আয়েশা মোবাইল ফোন ব্যবহার করতেন না। তার গলায় আগুনে পোড়ার দাগ থাকায় ঘোমটা পরে থাকতেন। আর পোড়া দাগের ক্লুতেই ঘাতককে শনাক্ত করে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। আয়েশাকে গ্রেপ্তারের পর চাঞ্চল্যকর এসব তথ্য জানিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। এদিকে গ্রেপ্তারের পর অভিযুক্ত আয়েশাকে ছয় দিন এবং তার স্বামী রাব্বীকে তিন দিনের রিমান্ডে নিয়েছে পুলিশ। 

গত সোমবার মোহাম্মাদপুরের শাহজাহান রোডের এক বাসায় চুরির অপবাদ দেওয়ায় গৃহবধূ লায়লা আফরোজ ও তার মেয়ে নাফিসা লাওয়াল বিনতে আজিজকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। আয়েশা গৃহকর্মীর কাজ নেওয়ার চার দিনের মাথায় এ ঘটনা ঘটান। পুলিশ বলছে, শুরু থেকে প্রধান সন্দেহভাজন হিসেবে গৃহকর্মী আয়েশার কথা বললেও কোথাও তার বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যাচ্ছিল না। কাজে আসা-যাওয়ার চার দিনে মুখ ঢেকে চলাফেরা করায় সিসিটিভির ফুটেজেও আয়েশার চেহারা স্পষ্ট নয়। গলার একপাশে পোড়া দাগের তথ্যের ভিত্তিতে মোহাম্মদপুর থানার এক বছরের চুরির মামলা পর্যালোচনা করে বেরিয়ে আসে গত জুলাইয়ের একটি চুরির তথ্য। সেই তথ্যের সূত্র ধরেই আয়েশাকে শনাক্ত করে ঝালকাঠির নলছিটি থেকে গ্রেপ্তার করা হয়।

গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) এক সংবাদ সম্মেলনে অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন্স) এস এন মো. নজরুল ইসলাম বলেন, গৃহকর্মীর কাজে আগে থেকেই তার চুরির অভ্যাস ছিল। গেল জুলাই মাসে মোহাম্মদপুরের বাবর রোডের একটি বাসা থেকে আয়েশা ৮ হাজার টাকা চুরি করেছিলেন। সেই ঘটনায়ও থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) হয়। আয়েশা মোবাইল ফোন ব্যবহার করতেন না, গলায় আগুনে পোড়ার দাগ থাকায় গোমটা পরে থাকতেন। ছবিও তুলতেন না। পরিচয় গোপন করতে ভিন্ন ভিন্ন বাসাবাড়িতে কাজ করতেন আর তথ্য নিতেন। তবে আয়েশা শুধু ২ হাজার টাকা চুরির জন্য নয়, বড় ক্রাইম করতেই মোহাম্মদপুরের ওই বাসায় ফের কাজে আসেন এবং সঙ্গে চাকুও নিয়ে আসেন। তার মধ্যে ক্লিয়ার ক্রিমিনাল ইনটেনশন ছিল। কোনো ধরনের অপরাধমূলক ক্লু যাতে না থাকে, তাই চুরি করা ফোন ও রক্তাক্ত কাপড় সাভারের সিঙ্গাইর ব্রিজ থেকে নদীতে ফেলে দেন আয়েশা। আরও তথ্য জানতে তাদের রিমান্ডে নেওয়া হয়েছে।

নজরুল ইসলাম বলেন, ওই বাসায় কাজে যোগ দেওয়ার সময় আয়েশার কোনো ঠিকানা বা যোগাযোগের নম্বর রাখা হয়নি। আগের একটি জিডির সূত্র ধরে জেনেভা ক্যাম্প এলাকায় বসবাস করে এমন একজন গৃহকর্মীর সন্ধান পাওয়া যায়। এরপর সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে প্রাপ্ত তথ্য ‘যাচাই-বাছাই’ করে আয়েশাসংশ্লিষ্ট একটি মোবাইল নম্বর পাওয়া যায়। রাব্বীকে শনাক্তের পর জানা যায় তার স্ত্রীর নাম আয়েশা, গৃহকর্মীর কাজ করেন এবং জেনেভা ক্যাম্পে ভাড়া বাসায় থাকেন। এভাবে ঘটনার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে হত্যাকারী আয়েশার পরিচয় নিশ্চিত হওয়া যায়। বরিশালে যাওয়ার ধারণা পেয়ে পটুয়াখালীর দুমকিতে এবং পরে ঝালকাঠির নলছিটিতে রাব্বীর দাদার বাড়িতে অভিযান চালিয়ে রাব্বীসহ আয়েশাকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের কাছ থেকে মোহাম্মদপুরের ওই বাসা থেকে খোয়া যাওয়া একটি ল্যাপটপও উদ্ধার করা হয়।

অতিরিক্ত কমিশনার বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আয়েশা ঘটনার সঙ্গে নিজের সম্পৃক্ততা স্বীকার করেছেন। গৃহকর্মী হিসেবে নিয়োজিত থেকে চুরির অভ্যাস তার আগে থেকেই ছিল। তিনি মোবাইল ফোন ব্যবহার করতেন না, ছবি ছিল না। তার গলার পোড়া দাগটাই শুধু ক্লু ছিল। তার বিরুদ্ধে করা আগের একটা জিডির ক্লু ধরে রহস্য উদঘাটন সম্ভব হয়েছে।

এই জোড়া খুনের মোটিভের বিষয়ে প্রাথমিক তথ্যের বরাতে তিনি বলেন, কাজে যোগ দেওয়ার দ্বিতীয় দিন আয়েশা ওই বাসা থেকে ২ হাজার টাকা চুরি করেন। এ নিয়ে তাকে প্রশ্ন করলে গৃহকর্ত্রী লায়লা আফরোজের সঙ্গে তার বাগবিত-া হয়। গৃহকর্ত্রী আয়েশাকে পুলিশে দেওয়ার ভয় দেখান। চতুর্থ দিন কাজে যাওয়ার সময় একটি সুইচগিয়ার চাকু নিয়ে গিয়েছিলেন আয়েশা। সেদিন আবারও কথাকাটাকাটি হলে তাদের মধ্যে ধস্তাধস্তির একপর্যায়ে সুইচগিয়ার দিয়ে ছুরিকাঘাত করেন। পরে মেয়ে এগিয়ে এলে তাকেও ছুরিকাঘাত করা হয়। ঘটনার দিন আয়েশা নিজেও আহত হয়েছেন। এরপর তিনি নিজের রক্তাক্ত পোশাক পাল্টে মেয়ে নাফিসার স্কুলড্রেস পরে একটি ল্যাপটপ ও মোবাইল ফোন নিয়ে চলে যান।

জিজ্ঞাসাবোদে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ডিএমপি জানায়, খুন করে আয়েশা সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের ভেতরে গিয়ে পোশাক পরিবর্তন করে সাভারের দিকে চলে যান। চুরি করা ফোন ও রক্তাক্ত কাপড় সিঙ্গাইর ব্রিজ থেকে নদীতে ফেলে দেওয়ার কথা পুলিশকে বলেছেন আয়েশা।

গৃহকর্মী আয়েশা ও তার স্বামী রিমান্ডে : আদালত প্রতিবেদক জানান, মা ও মেয়ে হত্যার ঘটনায় গ্রেপ্তার গৃহকর্মী আয়েশা আক্তারকে ছয় দিন এবং তার স্বামী রাব্বীকে তিন দিন রিমান্ডে দেন আদালত। গতকাল মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদপুর থানার এসআই সহিদুল ওসমান মাসুম দুই আসামিকে ১০ দিন করে রিমান্ডের আবেদন করেন। ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মাহবুব আলম এই রিমান্ড মঞ্জুর করেন।