ঢাকা শুক্রবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০২৫

শীত বাড়ার সঙ্গে বেড়েছে মশার দৌরাত্ম্য

রূপালী প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১২, ২০২৫, ০৬:৫৬ এএম

দেশের উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় চলছে শৈত্যপ্রবাহ। রাজধানীতে সন্ধ্যা নামলেই কুয়াশার দেখা পাচ্ছেন নগরবাসী। এ সময়টায় প্রতিবছরই বাড়ে মশার দৌরাত্ম্য। তবে এবার অন্যান্য মশার তুলনায় এডিস মশার প্রজননই যেন বেশি। শীতের এই সময়ে কেন বাড়ছে এর সংক্রমণ তার কোনো সঠিক কারণ ব্যাখ্যা করতে পারছেন না বিশেষজ্ঞরাও। আর তার ফলে প্রতিদিনই বাড়ছে এডিসবাহী মশা আর ডেঙ্গু আক্রান্ত ও সংক্রমণের সংখ্যা। বছরের শুরু থেকে গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ডেঙ্গুর সংক্রমণে প্রাণ হারিয়েছেন ৪শর ওপর মানুষ। আক্রান্ত পৌঁছাতে যাচ্ছে লাখের ঘর। এমন অবস্থা চলতে থাকলে ডিসেম্বর মাস শেষে অন্য যেকোনো বছরের তুলনায় আক্রান্ত ও মৃত্যুর দিক দিয়ে ছাড়াতে পারে সব রেকর্ড।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডেঙ্গুবিষয়ক নিয়মিত সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে গতকাল বৃহস্পতিবার জানানো হয়, এর আগের ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ৩ জন। আর নতুন করে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৪১১ জন। এর ফলে ডেঙ্গুতে চলতি বছরে মৃত্যুর সংখ্যা ৪০০ ছাড়িয়ে গেল। গত বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিল ১ লাখ ১ হাজার ২১৪ জন। যা চলতি বছর শেষ হওয়া নাগাদ আরও বেশি হওয়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। গত ২৪ ঘণ্টায় ভর্তি হওয়া রোগীদের মধ্যে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের হাসপাতালগুলোয় ডেঙ্গু নিয়ে ভর্তি হয়েছেন ১৬৯ জন। দুই সিটির বাইরে চট্টগ্রাম বিভাগে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা ৬১। সব মিলিয়ে এবার এখন পর্যন্ত ডেঙ্গু নিয়ে ৯৯ হাজার ৪৯৩ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। আর এখন পর্যন্ত এডিস মশাবাহিত এ রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ৪০৪ জন।

চলতি বছর আক্রান্ত ও মৃত্যুর দিক দিয়ে নভেম্বর মাস শীর্ষে ছিল। ডিসেম্বর মাসে সেই রেকর্ড ভাঙার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। গত বছর নভেম্বরে সর্বোচ্চ মৃত্যু হলেও সর্বোচ্চ সংক্রমণ হয়েছিল অক্টোবর মাসে। তবে গত বছরের ডিসেম্বর মাসে সংক্রমণ অনেক কমে গিয়েছিল। তবে এ বছর ডিসেম্বরে সংক্রমণ গত বছরের মতো দ্রুত না-ও কমতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এর কারণ হিসেবে তারা বলছেন, নভেম্বর মাসে যে বৃষ্টি হয়েছিল, তার কারণে এ মাসের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত প্রাপ্তবয়স্ক এডিস মশা টিকে থাকবে। এর পাশাপাশি মশা নিধন ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কাজে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো সক্রিয় নয়। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, ডেঙ্গুর আক্রমণ বেশি পরিমাণে কমার জন্য আগামী বছরের জানুয়ারির শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হতে পারে। এ সময়টায় শুধু ডেঙ্গু নয়, অন্যান্য মশার প্রজননও বেড়েছে বলে জানিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ববিদ ও অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, এ বছর নভেম্বর মাসেও থেমে থেমে বৃষ্টি হতে দেখেছি আমরা। আর ডেঙ্গুর জীবনপ্রবাহ অনুযায়ী ডিম থেকে ফুটতে ১৪ দিনের মতো সময় লাগে। সে ক্ষেত্রে নভেম্বর মাসজুড়েই ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেশি। কিন্তু ডিসেম্বরেও আক্রান্তের সংখ্যা বলে দিচ্ছে, ডেঙ্গুর প্রজনন এখনো সমান হারেই রয়েছে। বৃষ্টি না হলেও বাসাবাড়িতে ও নির্মাণসামগ্রীতে জমানো পানি, নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়াÑ সব মিলিয়ে ডেঙ্গুর প্রজনন উপযুক্ত পরিবেশ পাচ্ছে। এদিকে মশা মারতে স্থানীয় প্রশাসন বলতে গেলে পুরোটাই অকার্যকর। দেশের কোনো সিটি করপোরেশনেই মেয়র বা কাউন্সিলর নেই, যারা মশা মারা কার্যক্রম তদারকি করবে। ফলে মশা মারার যে চেইন অব কমান্ড ছিল, সেটি পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে। তিনি বলেন, আমি আগেই বলেছিলাম চলতি বছরের নভেম্বর-ডিসেম্বরেও ডেঙ্গুর প্রকোপ বেশ ব্যাপক থাকবে। আমরা প্রতিদিন এডিস মশার ঘনত্ব নিয়ে কাজ করি। দেখছি এখনো এডিস মশার ঘনত্ব কমেনি। এডিস মশার ঘনত্ব যখন ২০-এর ওপরে থাকে, তখন ধরে নেওয়া হয় এডিস মশা বাড়বে উল্লেখ করে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এডিস মশার ঘনত্বের পাশাপাশি কোনো জায়গায় যদি ডেঙ্গুরোগী থাকে, তাহলে এডিস মশা জ্যামিতিক হারে বাড়তে থাকে। বর্তমানে দেশে এডিস মশাও আছে আবার রোগীও আছেÑ দুইটা বিষয় যখন একসাথে থাকে তখন ডেঙ্গু বাড়বে এবং সেটা থাকবে।

এ কারণেই আমরা আগেই বলেছিলাম, এবার নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে ডেঙ্গুর প্রকোপ অনেক থাকবে উল্লেখ করে জনস্বাস্থ্যবিদ ডা. লেনিন চৌধুরী রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ডেঙ্গু একটি মশাবাহিত প্রতিরোধযোগ্য রোগ। তবে এর জন্য মশার প্রজনন যেন না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। দ্বিতীয়ত, উড়ন্ত মশাগুলোকে মারার ব্যবস্থা করতে হবে এবং কেউ যদি ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়, তাকে পরীক্ষার মাধ্যমে ডেঙ্গু নিশ্চিত হলে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের অনেকগুলো ব্যবস্থার কথা আমি বলেছিলাম। কিন্তু কখনোই আমাদের কথা কেউ শোনেনি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, ২০০০ সালে দেশে সাড়ে পাঁচ হাজার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন এবং ৯৩ জনের মৃত্যু হয়। ২০০১ সালে আড়াই হাজার আক্রান্ত হন এবং ৪৪ জনের মৃত্যু হয়। ২০০২ সালে ছয় হাজার  ডেঙ্গুরোগীর মধ্যে ৫৮ জন মারা যান। ২০০৩ সালে ৪৮৬ জনের মধ্যে ১০ জন, ২০০৪ সালে চার হাজারের মধ্যে ১৩ জন, ২০০৫ সালে এক হাজারের মধ্যে চারজন, ২০০৬ সালে দুই হাজারের মধ্যে মৃত্যু হয় ১১ জনের মৃত্যু হয়। ২০০৭  থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত আড়াই হাজার ডেঙ্গুরোগী হাসপাতালে ভর্তি হলেও মৃত্যু নেই। ২০১১ সালে দেড় হাজার ডেঙ্গুরোগীর মধ্যে ছয়জনের মৃত্যু হয়। ২০১২ সালে ৬৭১ জনের মধ্যে একজন, ২০১৩ সালে প্রায় দুই হাজারের মধ্যে দুজন ডেঙ্গুরোগী মারা যান। ২০১৪ সালে ৩৭৫ জন ডেঙ্গুরোগীর মধ্যে কেউ মারা যাননি। ২০১৫ সালে তিন হাজারের মধ্যে ছয়জন, ২০১৬ সালে ছয় হাজারের মধ্যে ১৪ জন, ২০১৭ সালে তিন হাজারের মধ্যে আটজন, ২০১৮ সালে ১০ হাজার ১৪৮ জনের মধ্যে ২৬ জন, ২০১৯ সালে এক লাখ এক হাজার ৩৫৪ জনের মধ্যে ১৭৯ জন মারা যান। ২০২০ সালে দেড় হাজার মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হলেও মৃত্যু হয় চারজনের। আর ২০২১ সালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয় সাড়ে ২৮ হাজার, মারা যান ১০৫ জন। ২০২২ সালে সর্বমোট ৬২ হাজার ৩৮২ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হন এবং মোট ২৮১ জন মারা যান। ২০২৩ সালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মোট এক হাজার ৭০৫ জনের মৃত্যু হয়, পাশাপাশি ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন মোট তিন লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন।

দিনদিন ডেঙ্গুর সংক্রমণ কেন বেড়ে চলেছে দেশেÑ এমন প্রশ্নের উত্তরে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অধ্যাপক এ বি এম আব্দুল্লাহ রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ডেঙ্গু প্রতিরোধের যে স্তরগুলো রয়েছে, তার প্রথম ধাপ হচ্ছে এডিস মশা নির্মূল বা নিয়ন্ত্রণ। দেশব্যাপী এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত কোনো কার্যক্রম বা পরিকল্পনা শুরু থেকে চলতি বছর একেবারেই হয়নি। কিছু কিছু স্থানভিত্তিক মশা মারার কার্যক্রম শুরু হয়েছিল। কিন্তু মশা মারতে সাধারণ মানুষ স্বেচ্ছাসেবক, সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা, স্থানীয় পরিষদের লোকজনসহ সবাইকে যুক্ত করাও হয়নি। মানুষ বাড়িঘরে কীভাবে এডিস মশার প্রজনন নিয়ন্ত্রণ করবে, হাতে-কলমে সেটা  শেখানোর কোনো উদ্যোগও নেওয়া হয়নি। মশা নিয়ন্ত্রণে কার্যকরী রাসায়নিক নিয়ন্ত্রণ, সেটাও আমরা দেখিনি। এর আগে যে ওষুধগুলো ব্যবহার হয়েছে, সেগুলোতে মশা মারা যায়নি। এই সুযোগে ডেঙ্গু সারা দেশে ছড়িয়ে গিয়েছে। সারা দেশে ডেঙ্গুর হটস্পট ম্যানেজমেন্টও দেখা যায়নি। ডেঙ্গুর ভ্যাকসিন দেওয়ার কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। অন্যদিকে এডিস মশার বিষয়ে কোনো গবেষণাও আমরা করছি না। আমরা দেশে ডেঙ্গুর টিকা আবিষ্কারের কোনো কার্যক্রম শুরু করিনি। এসব কারণেই মশা নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। আর তাই দিন দিন ডেঙ্গুর সংক্রমণ বেড়েই চলেছে।

এদিকে ডেঙ্গুর তীব্রতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজধানীর হাসপাতালগুলোতে বাড়ছে রোগীদের ভিড়। মুগদা জেনারেল হাসপাতাল, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ডিএনসিসি কোভিড হাসপাতাল, শহিদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালসহ প্রায় সব সরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীদের ভিড়ে তিলধারণের জায়গা নেই। ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সিট না পেয়ে অনেক রোগী মেঝেয়, বাথরুমের সামনে ফাঁকা জায়গায়, এমনকি সিঁড়ির সামনের খালি জায়গাতেও ভর্তি থেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন।