দোকানগুলোর থরে থরে সাজানো নতুন মোড়কের প্রসাধনী পণ্য। সাথে আছে চটকদার অফার। এতে বিভ্রান্ত হচ্ছেন ক্রেতারা। তারা মুগ্ধ হয়ে কিনে নিচ্ছেন পণ্য। কিন্তু কিনে উপকার পাওয়ার চেয়ে হচ্ছেন প্রতারিত। কেননা এসবের বেশির ভাগই মেয়াদোত্তীর্ণ কিংবা নকল। মেয়াদোত্তীর্ণ ও নকল এসব পণ্য ব্যবহার করে তারা যেমন প্রতিনিয়ত প্রতারিত হচ্ছেন আর্থিকভাবে, তেমনি পড়ছেন চরম স্বাস্থ্যঝুঁকিতে। সিলেটের বাজার এখন এ রকম নকল ও মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্যে সয়লাব।
সিলেট মহানগরীর জিন্দাবাজার, বন্দরবাজার, হকার্স মার্কেট ও লালদিঘির পাড় এলাকার প্রসাধনীর দোকানগুলোয় রঙিন মোড়ক আর চটকদার অফারের আড়ালে ক্রেতাদের হাতে প্রতিদিন তুলে দেওয়া হচ্ছে নকল ও মেয়াদোত্তীর্ণ প্রসাধনী।
বাজার ঘুরে দেখা গেছে, অন্তত ৭০ শতাংশ দোকানেই বিএসটিআই সনদবিহীন, মেয়াদ ঘষা বা নতুন স্টিকার সাঁটানো প্রসাধনী ঠাসা। ফুটপাত থেকে শুরু করে নামি শোরুমে পর্যন্ত এই ‘বিষবাণিজ্য’ চলছে প্রকাশ্যে। অথচ স্থানীয় প্রশাসন, বিএসটিআই ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর স্রেফ নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে।
‘প্রতিদিন লাখ লাখ টাকার প্রসাধনী বিক্রি হচ্ছে। অথচ তার বড় অংশই নকল বা মেয়াদোত্তীর্ণ। বিষয়টি ভয়াবহ জনস্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি করছে।’ জানিয়েছেন ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা।
মহানগরীর উপশহর এলাকার শাপলা আক্তার (১৭) তিন দিন ধরে ওসমানী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। তিনি জানান, জিন্দাবাজার থেকে কেনা হোয়াইটেনিং ক্রিম ব্যবহারের পর মুখ জ্বালা শুরু হয়, ফোস্কা পড়ে যায়। ‘দোকানি বলেছিল বিদেশি ব্র্যান্ড। পরে ডাক্তার বলেন, এটা নকল আর মেয়াদোত্তীর্ণ। মুখে স্থায়ী দাগ হয়ে যাবে।’
আফসানা বেগম নামে আরেক নারী বলেন, ‘নগরীর হকার্স মার্কেট থেকে ব্র্যান্ডের নামে ২৫০ টাকা দিয়ে ক্রিম কিনি। তিন দিনেই গাল পুড়ে যায়। আমরা আর বিষ কিনতে চাই না। বাজারে নকল পণ্যের বিক্রয় বন্ধ করতে হবে। ভোক্তাদের জীবন নিয়ে ব্যবসা বন্ধ করা উচিত।’
মহানগরীর বিভিন্ন মার্কেট ও বাজারে সরেজমিনে দেখা গেছে, দোকানিরা মেয়াদ ঘষে মুছে নতুন স্টিকার বসিয়ে দিচ্ছেন। ফুটপাতে ৫০-৬০ টাকার ‘হোয়াইটেনিং ক্রিম’ বিক্রি হচ্ছে ২০০-৩০০ টাকায়। দোকানিদের একাংশ নিজেরাই স্বীকার করেন। ‘সবাই বিক্রি করে। নইলে টিকে থাকা যাবে না।’
হকার্স মার্কেটের একটি দোকানের পেছনে দেখা গেছে, কয়েকজন কর্মী মেয়াদোত্তীর্ণ পণ্যের ওপর নতুন স্টিকার লাগাচ্ছেন। এমন দৃশ্য প্রায় সময় দেখা যায়। তবে সেদিকে প্রশাসনের তেমন নজর নেই।
চর্মরোগ বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, ‘নকল ও মেয়াদোত্তীর্ণ প্রসাধনীতে পারদ, সিসা ও জীবাণু থাকে। দীর্ঘ মেয়াদে ত্বকে ক্ষত, ক্যানসার, হরমোনজনিত সমস্যা ও শিশুর জন্মগত ত্রুটি পর্যন্ত হতে পারে। এটি জনস্বাস্থ্যের জন্য একটি নীরব দুর্যোগ।’
বাংলাদেশের ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন ২০০৯-এর ৩৭ ধারা অনুযায়ী, নকল বা মেয়াদোত্তীর্ণ প্রসাধনী বিক্রির জন্য সর্বোচ্চ ২ বছরের জেল ও ২ লাখ টাকা জরিমানা হতে পারে। কিন্তু সিলেট হকার্স মার্কেটের ব্যবসায়ী সমিতির এক নেতা বলেন, ‘ভোক্তা অধিদপ্তর বছরে এক-দুইবার আসে। তখনো নামমাত্র জরিমানা করে চলে যায়। তাই দোকানদাররা ভয় পায় না।’
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সিলেট জেলা কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক মো. আমিরুল ইসলাম মাসুদ বলেন, ‘নকল ও মেয়াদোত্তীর্ণ প্রসাধনী বিক্রি জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি এবং আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। আমরা এই অপরাধের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের শিথিলতা দেখাব না। নিয়মিত অভিযানে ইতিমধ্যে বেশ কিছু ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানকে জরিমানা ও সিলগালা করা হয়েছে। তবে সিলেট নগরীর বিপুলসংখ্যক দোকান এবং সীমিত জনবল আমাদের জন্য চ্যালেঞ্জ।
ব্যবসায়ীদের হুঁশিয়ার করে তিনি বলেন, এ ধরনের প্রতারণা করলে কঠোর শাস্তি দেওয়া হবে। জনস্বাস্থ্য নিয়ে খেলতে দেওয়া হবে না।
বিএসটিআইয়ের সিলেট বিভাগীয় কার্যালয়ের উপ-পরিচালক (মেট্রোলজি) ও অফিস প্রধান মো. মাজাহারুল হক বলেন, ‘আমরা শুধু মাননিয়ন্ত্রণ সনদ দিই। মাঠপর্যায়ে তদারকি করতে পারি না।’
পরিবেশ ও স্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলনের কর্মী মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘বাজারে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষকে বিষাক্ত প্রসাধনী কিনতে বাধ্য করা হচ্ছে। এটা সরাসরি ফৌজদারি অপরাধ। যারা দায়িত্বে আছেন, তাদের ব্যর্থতার জন্য জনগণ মূল্য দিচ্ছে। দায়ীদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে।’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিটি বাজারে ভোক্তা অধিদপ্তর ও প্রশাসনের যৌথ অভিযান নিয়মিত চালু করতে হবে। লাইসেন্স নবায়নের আগে দোকানের ভোক্তা অধিকার রিপোর্ট বাধ্যতামূলক করতে হবে। ভোক্তাদের সচেতন করতে বাজারে হেল্পলাইন ও মোবাইল অ্যাপ চালু করতে হবে। ফুটপাতে প্রসাধনী বিক্রি নিষিদ্ধ করতে হবে। মেয়াদোত্তীর্ণ ও নকল পণ্যের জব্দকৃত তালিকা গণমাধ্যমে প্রকাশ করতে হবে।
রঙিন মোড়কের আড়ালে প্রতিদিন হাজারো মানুষকে প্রতারণা ও বিষক্রিয়ায় ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। অথচ কর্তৃপক্ষের দায় এড়ানো ও অভিযান-নাটক ছাড়া কার্যত কিছুই হচ্ছে না। এখনই কঠোর পদক্ষেপ, নিয়মিত নজরদারি ও শাস্তির ব্যবস্থা না নিলে সিলেটের বাজার অচিরেই জনস্বাস্থ্যের জন্য এক ভয়ংকর ফাঁদে পরিণত হবে।