রাজধানী ঢাকার বিস্তারিত এলাকা পরিকল্পনা বা ডিটেইল এরিয়া প্ল্যান (ড্যাপ) সংশোধন করে বিভিন্ন এলাকায় ফ্লোর এরিয়া রেশিও (এফএআর) প্রায় দ্বিগুণ পর্যন্ত বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এর ফলে এখনকার তুলনায় অধিক উচ্চতার ভবন নির্মাণের সুযোগ তৈরি হবে। নতুন পরিকল্পনায় ঢাকা মহানগরকে ৬৫টি জনঘনত্ব ব্লকে ভাগ করে এলাকাভিত্তিক নতুন এফএআর নির্ধারণ করা হচ্ছে।
রাজউক সূত্র জানায়, আজ রোববার ‘ড্যাপ সংশোধন’ ও ‘ঢাকা ইমারত বিধিমালা-২০২৫’ চূড়ান্ত করা হবে। ইতোমধ্যে রিহ্যাব, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউশন অব প্ল্যানার্স, রাজউক এবং উপদেষ্টা পরিষদের মতামত নিয়ে সংশোধিত খসড়া প্রস্তুত হয়েছে। অনুমোদন শেষে প্রজ্ঞাপন জারি করা হবে।
সরকারি কর্মকর্তারা জানান, জমির মালিক ও ডেভেলপারদের দীর্ঘদিনের দাবি এবং ভবিষ্যতের চাহিদা বিবেচনা করেই এফএআর বাড়ানো হচ্ছে। এতে ছোট জমিতে অধিক আয়তনের ভবন নির্মাণ সম্ভব হবে, যা ফ্ল্যাটের দাম কমাতেও সহায়তা করতে পারে। তবে নগর পরিকল্পনাবিদদের অভিযোগ, ব্যবসায়ীদের স্বার্থে নেওয়া এই পদক্ষেপ নগরের ভবিষ্যতের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।
কী থাকছে সংশোধিত ড্যাপে : নতুন পরিকল্পনায় প্লটের ২৫ থেকে ৪০ শতাংশ ‘সেটব্যাক এলাকা’ হিসেবে খালি রাখতে হবে। পাশাপাশি, আলো-বাতাসের প্রবাহ নিশ্চিত করতে দুটি ভবনের মধ্যে কমপক্ষে ৭২ ডিগ্রি কৌণিক দূরত্ব রাখার বিষয়টি বিবেচনাধীন। তবে পরিকল্পনাবিদদের মতে, ৪৫ ডিগ্রিই যথেষ্ট।
এলাকাভিত্তিক পরিবর্তনের মধ্যে রয়েছেÑ রামপুরা, বাড্ডা, তেজগাঁও, তারাব পৌরসভা, হেমায়েতপুর, সাভার পৌরসভা ও টঙ্গীতে আবাসন এফএআর সর্বোচ্চ ২.৩, গুলশান ও বনানীতে এলাকাভিত্তিক এফএআর ৫.৫, আবাসন এফএআর ২.০, বসুন্ধরায় আবাসন এফএআর ১.৯ থেকে ২.০, বারিধারায় ১.৮ থেকে ১.৭, ধানমন্ডি ও জলসিঁড়ি আবাসিক এলাকায় ২.১, খিলক্ষেতে ২.০, মিরপুরে ২.০, নারায়ণগঞ্জ সেন্টারে ২.১, পূর্বাচলে ১.৯। বিমানবন্দর এলাকার এফএআর এখনো নির্ধারিত হয়নি।
নতুন বিধিমালা ২০২৫ : ‘ঢাকা ইমারত বিধিমালা-২০২৫’ অনুযায়ী, ৭০ শতাংশ বা ৪২.৪৩ কাঠা থেকে দেড় একরের কম জমিতে অ্যাপার্টমেন্ট বা ব্লকভিত্তিক উন্নয়নের জন্য নগর পরিকল্পনাবিদের অনুমোদন লাগবে। দেড় একরের বেশি জমির ক্ষেত্রে আরও বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের ছাড়পত্র বাধ্যতামূলক হবে। এ ছাড়া ঢালু ছাদের সর্বোচ্চ বিন্দুকে ভবনের উচ্চতা ধরা হবে এবং ‘এট্রিয়া’ নির্মাণের অনুমোদন থাকবে। নদীতীরবর্তী বা বন্যাপ্রবণ এলাকায় প্রকল্প নিতে হলে প্রাকৃতিক প্রবাহ, পানির উচ্চতা এবং নিষ্কাশনব্যবস্থা নিয়ে মূল্যায়ন করতে হবে। রাস্তার জন্য জমি অধিগ্রহণ হলে তিন গুণ ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে।
এদিকে রিহ্যাবের নেতারা বলছেন, ঢাকার ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় উঁচু ভবনের সুযোগ বাড়ানো অপরিহার্য। তাদের দাবি, রাজধানীর ন্যূনতম এফএআর ৩.৫ থেকে ৪.০ হওয়া উচিত, যাতে আটতলা ভবন নির্মাণ সম্ভব হয়। রিহ্যাবের ভাইস প্রেসিডেন্ট ও বেসিক বিল্ডার্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল লতিফ বলেন, ঢাকা শহরের আয়তনের তুলনায় মানুষের সংখ্যা বেশি। তাই সবার জন্য নিরাপদ ও শোভন আবাসন নিশ্চিত করতে উঁচু ভবন নির্মাণের সুযোগ বাড়ানো জরুরি। এখন যে এফএআর নির্ধারণ করা হচ্ছে, সেটিও পর্যাপ্ত নয়। জমির বর্তমান দামে অন্তত সাততলা ভবন নির্মাণের সুযোগ না পেলে ব্যবসায়ীরা টিকতে পারবে না।
তিনি আরও বলেন, রাজধানীর ন্যূনতম এফএআর ৩.৫ থেকে ৪.০ হওয়া উচিত, যাতে ৪০ শতাংশ সেটব্যাক রেখে আটতলা ভবন নির্মাণ সম্ভব হয়। সরকার যা করছে সেটি মন্দের ভালো; এফএআর বাড়ালে কোনো ক্ষতি হবে না, বরং স্বাস্থ্যসম্মত নগর গড়ে উঠবে।
অন্যদিকে, নগর পরিকল্পনাবিদরা সতর্ক করে বলছেন, উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে আলো-বাতাস ও আকাশের দৃশ্য বাধাগ্রস্ত হবে এবং কাঠামোগত বিশৃঙ্খলা বাড়বে। একজন পরিকল্পনাবিদ উদাহরণ দিয়ে বলেন, একসময় ধানমন্ডিতে ভবন ছিল ছয়তলা, পরে নয়তলা হয়েছে, আর এখন আরও বেশি উচ্চতার ভবন হবেÑ যা নগরের ভারসাম্য নষ্ট করতে পারে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্লানার্সের প্রেসিডেন্ট আদিল মোহাম্মাদ খান বলেন, ড্যাপ সংশোধনে আবাসন ব্যবসায়ীরা উপকৃত হবেন। তবে ঢাকা শহরের জনসংখ্যা, অবকাঠামো ও বসতি বিবেচনায় ভবিষ্যৎ সুরক্ষার জন্য নিয়ন্ত্রণমূলক পদক্ষেপ প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সরকার ব্যবসায়ীদের প্রভাবে এমন উদ্যোগ নিচ্ছে যা অবকাঠামোর আরও বিস্তৃতি ঘটাবে।
তিনি আরও বলেন, সংশোধিত এফএআর অনুযায়ী উঁচু ভবনের সারি গড়ে উঠবে, এতে আলো-বাতাস চলাচলে বিঘœ ঘটতে পারে, যা পরিবেশের জন্য অনুকূল নয়। অনেক ভবনে আলো-বাতাসের ঘাটতি হবে, আকাশও দেখা যাবে না। বর্তমান এফএআরই শহরের জন্য যথেষ্ট। একসময় ধানমন্ডিতে ভবনের উচ্চতা ছিল ছয়তলা, পরে এফএআর পরিবর্তনের কারণে তা নয়তলা হয়েছে। এখন আরও বেশি উচ্চতার ভবন হবে, যা কাঠামোগত বিশৃঙ্খলা তৈরি করবে।
আপনার মতামত লিখুন :