কিছু মানুষ ইউটিউব দেখে কেবল বিনোদনের জন্য আবার কিছু মানুষ প্রতিনিয়ত খোঁজ করে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার নতুন নতুন অধ্যায়। বেশ কিছু কন্টেন্ট নির্মাতাদের মধ্যে একজন রুহি চেনেট। রঙ শিল্পী যেমন রঙতুলি দিয়ে কোন দৃশ্যপট তুলে ধরেন, কবি যেমন কবিতায় তার কোন সময় স্থান তুলে ধরেন ঠিক তেমনি এই অধরার অজানা, অচেনা, অবহেলিত, ভয়ংকর, কিংবা উপেক্ষিত পৃথিবীকে সেলুলয়েড ফিতায় তুলে ধরেন তুরস্কের ইউটিউবার হলেন রুহি চেনেট। তার ভিডিওতে ধরা পরে বিশ্বের নানা জাতি, সংস্কৃতি ও জীবনের অজানা গল্প। এই গল্প গুলো যেমন একাধারে শিক্ষামূলক, তেমনি রহস্যময়, মাঝে মাঝে আতঙ্কিত করার মতো। তবে সব কিছু ছাপিয়ে এগুলোর প্রতিটিই একেকটি জীবন্ত ডকুমেন্টারি, যেখানে উঠে আসে পৃথিবীর ভিন্ন ভিন্ন প্রান্তের বাস্তবতা। তার ১৬টি ইউটিউব চ্যানেল রয়েছে। তার এ কাজগুলো পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের বাস্তবতাকে তুলে ধরে এবং দর্শকদের কাছে বিশ্বকে একটি বৈচিত্র্যময় স্থান হিসেবে উপস্থাপন করে। তিনি মূলত বিশ্বের বিভিন্ন দুর্গম, অস্বাভাবিক এবং কখনো কখনো বিপজ্জনক স্থানে ভ্রমণ করে সেসব স্থানের জীবনযাত্রা, সংস্কৃতি, এবং রহস্য নিয়ে ডকুমেন্টারি তৈরি করেন। তার ভিডিওগুলো
‘জবফরংপড়াবৎ’ সিরিজ
নামে পরিচিত এবং ১৫টির বেশি ভাষায় ডাবিং করা হয়। তিনি তার ভ্রমণ ও শিক্ষামূলক কন্টেন্টের জন্য পরিচিত।
রুহি চেনেট ১৯৯০ সালের ২০ অক্টোবর তুরস্কের আইদিন শহরে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশব কেটেছে মানিসা ও বান্দির্মা শহরে। ২০০৭ সালে তিনি উচ্চশিক্ষার জন্য ভারতে আসেন এবং ২০১১ সালে স্নাতক ডিগ্রি নিয়ে দেশে ফিরে যান। ২০১৯ সালের আগস্টে তিনি ক্যানসু গিজেম চেনেটকে বিয়ে
করেন এবং তাদের দুটি সন্তান রয়েছে- একটি
মেয়ে ও একটি ছেলে।
রুহি চেনেট ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে তার ইউটিউব চ্যানেল ‘জঁযর ড্ডবহবঃ ঠরফবড়ষধৎ?’ (বর্তমানে ‘জঁযর ড্ডবহবঃ গবফরধ’) চালু করেন। সে সময় তুরস্কে ইউটিউব তেমন জনপ্রিয় ছিল না, এবং ইউটিউব থেকে আয় করার সুযোগও ছিল না। তবু তিনি দ্রুত তুরস্কের অন্যতম শীর্ষ ইউটিউবার হয়ে ওঠেন।
তার ভিডিওগুলো সাধারণত বিশ্বের দুর্গম, অস্বাভাবিক এবং কখনো কখনো বিপজ্জনক স্থানগুলোয় ভ্রমণের ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়। তার ‘জবফরংপড়াবৎু’ নামক ডকুমেন্টারি সিরিজটি ১৫টির বেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে এবং বিশ্বজুড়ে বিলিয়ন বিলিয়ন ভিউ অর্জন করেছে।
রুহি চেনেট তার চ্যানেলে বিভিন্ন ধরনের শিক্ষামূলক, তথ্যবহুল এবং রহস্যময় ডকুমেন্টারি তৈরি করেন। তার উল্লেখযোগ্য কিছু ভিডিওর
বিষয়বস্তু হলো যেমন-
বিশ্বের সবচেয়ে ঠান্ডা গ্রাম
বিশ্বের সবচেয়ে ঠান্ডা গ্রাম রাশিয়ার ওইমিয়াকন, যেখানে তাপমাত্রা-৭১ক্কঈ (-৯৬ক্কঋ) পর্যন্ত নেমে যায়। রুহি চেনেট এই অঞ্চলে ঘুরে এ এলাকার মানুষের জীবন যাত্রা তুলে ধরেছেন। বিশ্বের বৃহত্তম গুহা ভিয়েতনামের হ্যাং সন ডুংযেখানে বন, নদী এবং মেঘও দেখা যায়; গুহার ভেতরে কেমন কি আছে তার ভিডিও তে আমরা জানতে পারি।
সর্বোচ্চ নিরাপত্তা কারাগার
বিশ্বের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা কারাগার এল সালভাদরের ঈঊঈঙঞ কারাগার; এখানে কারা থাকে, তারা কী কী সুবিধা পায় সবকিছু তার ভিডিওতে জানা যায়।
সবচেয়ে পুরোনো আদিবাসী
এমন এক আদিবাসী আছে তানজানিয়াতে যারা প্রায় ৫০ হাজার বছর ধরে একিভাবে জীবন ধারণ করে আসছে, রুহি চেনেট তার ভিডিওতে হাযদাতে জীবনযাত্রা তুলে ধরেছেন।
সবচেয়ে দরিদ্র গ্রাম
রুহি চেনেট বুরুন্ডি নিয়ে একটি ভিডিও করেছেন। ভিডিওটির শিরোনাম হলো ‘ঠরংরঃরহম ঃযব ডড়ৎষফ’ং চড়ড়ৎবংঃ ঈড়ঁহঃৎু (খরভব রিঃয ড়হষু $১)’। এ ভিডিওতে তিনি বুরুন্ডির মানুষের জীবনযাত্রা, তাদের দারিদ্র্যের কারণ এবং দৈনন্দিন সংগ্রামের চিত্র তুলে ধরেছেন। ভিডিওতে রুহি চেনেট যেসব বিষয় তুলে ধরেছেন তার কয়েকটি হলো এ দেশের দৈনন্দিন জীবন বুরুন্ডির রাজধানী বুজুম্বুরা থেকে শুরু করে গ্রাম পর্যন্ত, তিনি সাধারণ মানুষের জীবনযাপন দেখিয়েছেন। সেখানে কীভাবে মানুষ মৌলিক চাহিদা মেটানোর জন্য লড়াই করে, বিশেষ করে খাবার, পানীয় জল এবং চিকিৎসার অভাব কতটা প্রকট, তা তিনি তুলে ধরেছেন। বুরুন্ডির অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ; তার ভিডিওতে দেখানো হয়েছে, কীভাবে মানুষ দিনে মাত্র ১ ডলার বা তারও কম উপার্জন করে জীবন চালায়। কৃষিকাজের ওপর নির্ভরশীলতা, চাকরির অভাব এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা কীভাবে দারিদ্র্যকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে, তা তিনি ব্যাখ্যা করেছেন।
হিরোশিমা
রুহি চেনেট জাপানের হিরোশিমা শহর নিয়ে
একটি ভিডিও তৈরি করেছেন, যেখানে তিনি বোমা বিধ্বস্ত হওয়ার পরের জীবনযাত্রা এবং শহরের পুনর্গঠনের প্রক্রিয়া তুলে ধরেছেন। ভিডিওটির শিরোনাম হলো ‘ঠরংরঃরহম ঃযব ডড়ৎষফ’ং ঋরৎংঃ অঃড়সরপ ইড়সন ঈরঃু (খরভব রহ ঐরৎড়ংযরসধ ঞড়ফধু)’।
এ ভিডিওতে রুহি চেনেট প্রধানত দুটি মূল বিষয়কে কেন্দ্র করে হিরোশিমার মানুষের জীবনযাত্রা ফুটিয়ে তুলেছেন ভিডিওতে রুহি চেনেট দেখিয়েছেন, কীভাবে ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্টের পারমাণবিক বোমা হামলার পর হিরোশিমা শহর সম্পূর্ণ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল। তিনি পিস মেমোরিয়াল পার্ক এবং পিস মেমোরিয়াল মিউজিয়াম পরিদর্শন করেছেন, যেখানে বোমা হামলার ভয়াবহতা, এর শিকারদের যন্ত্রণা এবং সেই দিনের ঘটনার নির্মমতা তুলে ধরা হয়েছে। রুহি সেসব মানুষের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন, যারা বোমা হামলা থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন এবং কীভাবে তারা তাদের জীবন নতুন করে শুরু করেছিলেন। রুহি চেনেট হিরোশিমার বর্তমান জীবনযাত্রার চিত্রও তুলে ধরেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, কীভাবে শহরটি স্বাভাবিক ছন্দে ফিরে এসেছে, মানুষ কীভাবে তাদের দৈনন্দিন কাজ করছে, শিক্ষার্থীরা স্কুলে যাচ্ছে এবং ব্যবসা-বাণিজ্য চলছে। এখানকার মানুষের জীবন অন্যান্য জাপানি শহরের মতোই আধুনিক এবং প্রযুক্তিনির্ভর।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় গুহা
হ্যাংসন ডুং বিশ্বের সবচেয়ে বড় গুহা যেটি ভিয়েতনামের কোং বিন প্রদেশের বো টাচ জেলায় এ গুহা নেটওয়ার্কের অবস্থান, এটি এমন একটি গুহা যার ভেতরে বন, নদী এবং এমনকি মেঘও রয়েছে। রুহি চেনেট এই গুহার বিস্ময়কর প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য এবং তার ভেতরের রহস্যময় পরিবেশ দেখিয়েছেন।
পৃথিবীর সর্বোচ্চ স্থায়ী মানব বসতি
পেরুর আন্দিজ পর্বতমালার ওপর অবস্থিত লা রিকোনাদা শহরটি পৃথিবীর সর্বোচ্চ স্থায়ী মানব বসতি। এখানে মানুষের জীবনযাত্রা অত্যন্ত কঠিন এবং ঝুঁকিপূর্ণ। এ শহরকে ‘শয়তানের স্বর্গ’ বলা হয়, কারণ এখানে সোনা থাকলেও জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় সব সুবিধা ও নিরাপত্তা চরমভাবে অনুপস্থিত। লা রিকোনাদা হলো পেরুর আন্দিজ পর্বতমালার একটি শহর, যা পৃথিবীর সর্বোচ্চ স্থায়ী মানব বসতি হিসেবে পরিচিত। শহরটি সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৫ হাজার ১০০ মিটার (প্রায় ১৬ হাজার ৭০০ ফুট) উচ্চতায় অবস্থিত। এর অবস্থান এমন এক জায়গায় যেখানে গাছপালা জন্মায় না এবং অক্সিজেন খুবই কম। রুহি চেনেট এখানে মানুষ কীভাবে টিকে থাকে কী কী কাজ, কীভাবে কাজ করে তা তুলে ধরেছেন তার ভিডিওতে।
বিশ্বের অন্যতম উষ্ণতম
‘লুত’ শব্দটি ফার্সি ভাষায় ‘খালি’ বা ‘পানি ও গাছপালাবিহীন’ বোঝায়। ইরানের লুট মরুভূমি বিশ্বের অন্যতম উষ্ণতম এবং শুষ্কতম স্থান। এখানে তাপমাত্রা প্রায় ৭০ক্ক সেলসিয়াস (১৫৮ক্ক ফারেনহাইট) পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। এই চরম প্রতিকূলতার কারণে মরুভূমির মূল অংশে স্থায়ীভাবে মানুষের বসবাস প্রায় অসম্ভব। তবে, মরুভূমির উপকণ্ঠে বা প্রান্তিক অঞ্চলগুলোয় কিছু গ্রাম এবং বসতি রয়েছে, যেখানে মানুষ হাজার হাজার বছর ধরে বসবাস করে আসছে। এ অঞ্চলগুলোয় মানুষের জীবনযাত্রা কঠোর
পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলতে বাধ্য। রুহি চেনেট তার ভিডিওতে এই অঞ্চলের মানুষের কঠিন জীবন তুলে ধরেন।
অপরিবর্তিত জীবন ব্যবস্থা হাযদা উপজাতি
প্রায় ৫০ হাজার বছর ধরে অপরিবর্তিত জীবন হাযদা উপজাতি; তানজানিয়ার এই আদিবাসী উপজাতি কীভাবে তাদের প্রাচীন জীবনধারা বজায় রেখেছে, তাদের শিকারের পদ্ধতি, খাদ্যাভ্যাস এবং সামাজিক রীতি-নীতি তুলে ধরেছেন রুহি চেনেটের ইউটিউব চ্যানেলে। এল সালভাদরের বিশ্বের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা কারাগার কতটা সুরক্ষিত এবং সেখানে অপরাধীদের কীভাবে রাখা হয়, তা তিনি অনুসন্ধান করেছেন। রুহি চেনেটের ভিডিওতে দেখা যায় নেপালের উন্মাদ মধু, যা খেলে হ্যালুসিনেশন হয়। স্থানীয়রা কীভাবে এ বিপজ্জনক মধু সংগ্রহ করে এবং এর প্রভাব কেমন,
তা তিনি দেখিয়েছেন।
রুহি চেনেট আফ্রিকান উপজাতি যারা মাটি খায় পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে কিছু মানুষের অদ্ভুত খাদ্যাভ্যাস এবং তার কারণগুলো নিয়ে তিনি ভিডিও তৈরি করেছেন। রুহি চেনেটের শিশ দিয়ে কথা বলা
মানুষ এমন একটি সম্প্রদায় যেখানে মানুষ কথা
বলার পরিবর্তে শিস দিয়ে একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ করে; তাদের কাজ-কর্ম তার
ভিডিওতে তুলে ধরেছেন।
ধুলোর নরক
বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহর বা ধুলোর নরক বলা হয় লাহোরকে যেখানে বায়ুদূষণ মারাত্মক আকার ধারণ করেছে এবং ফলে মানুষের জীবনে কী প্রভাব পড়ছে, তা তিনি দেখিয়েছেন।
হিরোশিমায়
বিশ্বের প্রথম পারমাণবিক বোমা বিধ্বস্ত শহর হিরোশিমায় পারমাণবিক হামলার পর শহরের অবস্থা এবং কীভাবে তা পুনর্গঠিত হয়েছে, তার একটি মর্মস্পর্শী চিত্র তুলে ধরেছেন।
ডেথ রোড
বিশ্বের সবচেয়ে বিপজ্জনক রাস্তা কারাকোরাম ডেথ রোড পাকিস্তানের পাঞ্জাবে এ বিপজ্জনক রাস্তাটির চ্যালেঞ্জ এবং সেখানে ভ্রমণকারীদের অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি একটি ডকুমেন্টারি করেছেন।
রুহি চেনেট তার ব্যক্তিগত জীবন এবং অভিজ্ঞতা সম্পর্কে প্রায় ২৫টি ব্যক্তিগত তথ্য শেয়ার করেছেন। নিজের পরিবারের পরিচয় এবং কর্মজীবন নিয়ে তিনি ভিডিওতে মাঝে মাঝে কথা বলেন। রুহি চেনেটের ভিডিওগুলো তার গভীর অনুসন্ধান, ব্যতিক্রমী বিষয় নির্বাচন এবং সুন্দর চিত্রগ্রহণের জন্য পরিচিত। তার লক্ষ্য হলো- দর্শকদের কাছে অজানা বিশ্বকে তুলে ধরা এবং কৌতূহল জাগিয়ে তোলা।
রুহি চেনেটের ভিডিও আমাদের তরুণ মানুষদের জন্য একটা আত্মবিশ্বাসের গল্প। যে গল্প আমাদের তরুণদের শেখায় নতুন কিছু শেখার, নতুন কিছু আবিষ্কারের নতুন কোনো পথ খুঁজে বের করার।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন