- কাজী নাবিলের বিরুদ্ধে আলাদা মামলা
চটপটির দোকান ও রেস্তোরাঁর বিপরীতে ৮০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলমসহ ২০ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। এ ছাড়া ঋণের নামে প্রায় ৮৫৭ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে নাসা গ্রুপের চেয়ারম্যান ও এক্সিম ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদারসহ ২১ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এ ছাড়া মামলা হয়েছে জেমকন গ্রুপের মালিক ও যশোরের সাবেক সংসদ সদস্য কাজী নাবিল আহমেদের বিরুদ্ধেও। গতকাল সোমবার এক ব্রিফিংয়ে দুদক মহাপরিচালক আক্তার হোসেন এ তথ্য জানান। চট্টগ্রাম নগরীর কয়েকটি চটপটির দোকান ও দুটি রেস্তোরাঁর জন্য ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক থেকে ঋণের নামে অন্তত ২৩৪ কোটি টাকা লোপাটের অভিযোগ উঠলে, গত জানুয়ারিতে অনুসন্ধান শুরু করে দুদক।
অনুসন্ধান শেষে, ৮০ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে সোমবার মামলা করেছে সংস্থাটি। এতে বলা হয়েছে, ঋণ গ্রহণ করেন নওরোজ এন্টারপ্রাইজের মালিক নাজমি নওরোজ। তবে প্রকৃত অর্থে ঋণের টাকা যায় এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল আলমের পকেটে। এ ঘটনায় দুদকের মামলায় আসামি করা হয়েছে ২০ জনকে।
গতকাল বিকেলে চট্টগ্রামে দুদকের জেলা সমন্বিত কার্যালয়-১-এ মামলাটি দায়ের করা হয়েছে। দুদকের উপপরিচালক আফরোজা হক খান বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন।
মামলার এজাহারে বলা হয়, এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যান সাইফুল ইসলাম মাসুদের সহযোগিতায় ‘লা এরিস্ট্রোক্রেসি’ রেস্টুরেন্টের মালিক নাজমে নওরোজ ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক থেকে ৭৯ কোটি ৯৬ লাখ টাকা ঋণের মাধ্যমে নিয়ে তা আত্মসাৎ করেন।
দুদক জানায়, নাজমে নওরোজকে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে ১ কোটি ৫০ লাখ টাকার কম নির্ধারিত ঋণসীমার বাইরে অতিরিক্ত অর্থায়ন করে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক। দেড় কোটি টাকার ঋণসীমার বিপরীতে তাকে দেওয়া হয় ৭৪ কোটি ৩৩ লাখ টাকার ঋণ। ২০১৫ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ৮০ কোটি টাকা। ১৫২টি ডিলের মাধ্যমে তিনি ব্যাংক থেকে এই ঋণ গ্রহণ করেন।
দুদক জানায়, ২০২০ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে উত্তোলনকৃত এই অর্থ নাজমে নওরোজ নগদে তুলে ১১টি প্রতিষ্ঠান এবং তিনজন ব্যক্তির ব্যাংক অ্যাকাউন্টে স্থানান্তর করেন। তদন্তে উঠে আসা এসব প্রতিষ্ঠানের মালিক ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদেরও মামলায় আসামি করা হয়েছে।
সাইফুল আলম ছাড়াও মামলার অন্য আসামিরা হলেনÑ ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ ওয়াসেক মো. আলী, সাইফুল আলমের ব্যক্তিগত সহকারী আকিজ উদ্দীন, চট্টগ্রামের ‘লা এরিস্টোক্রেসি’ রেস্টুরেন্টের মালিক নাজমে নওরোজ এবং ব্যাংকটির কাজির দেউড়ি শাখার সাবেক ব্যবস্থাপক নাজমা মালেক ও হুমায়রা সাঈদা খানম। এ ছাড়া, জেড আর জে সার্ভে কোম্পানির মালিক শফিকুল করিম, মিশকাত ট্রেড সেন্টারের মিশকাত আহমেদ, ব্যবসায়ী মো. আরিফ হাসনাইন, নুর ট্রেডার্সের জসিম উদ্দিন, মায়ের দোয়া এন্টারপ্রাইজের জুয়েল মিয়া, রিমঝিম শাড়ি হাউজের জুয়েল মিয়া, আগমন এন্টারপ্রাইজের এরসাদ সিকদার, এম এইচ এন্টারপ্রাইজের মনিরুল হক, নিউ বসুন্ধরা জুয়েলার্সের যিশু বণিক, আল মদিনা স্টিলের মো. আলমগীর এবং মেরিন ফিশের মাহবুবুল হক।
এদিকে, এক্সিম ব্যাংক থেকে ঋণের নামে প্রায় ৮৫৭ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগে নাসা গ্রুপের চেয়ারম্যান ও ব্যাংকটির সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার, বর্তমান চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম স্বপন ও সাবেক এমডি ফিরোজ হোসেনসহ ২১ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে ঋণ অনুমোদন করে এক্সিম ব্যাংকের ৮৫৭ কোটি ৯৩ লাখ টাকা আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগ আনা হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। গত রোববার দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয়, ঢাকা-১-এ সংস্থাটির সহকারী পরিচালক শাহজাহান মিরাজ এ মামলা করেন।
নাসা গ্রুপের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার ব্যাংক মালিকদের সংগঠন বিএবিরও সাবেক চেয়ারম্যান। আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে ব্যাংক খাতে আলোচনায় ছিলেন তিনি। ২০২৪ সালে ক্ষমতার পালাবদলের পর ১ অক্টোবর গুলশান থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে ডিবি।তার বিরুদ্ধে দুদকের এ মামলায় আসামির তালিকায় আরও রয়েছেনÑ ‘মদিনা ডেটস অ্যান্ড নাটস’-এর প্রোপ্রাইটর মোজাম্মেল হোসাইন, এক্সিম ব্যাংকের সাবেক সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ও শাখা ব্যবস্থাপক মো. আসাদ মালেক, সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট ও দ্বিতীয় কর্মকর্তা মোসা. জেবুন্নেসা বেগম, সিনিয়র অফিসার ও ইনভেস্টমেন্ট রিস্ক ম্যানেজমেন্ট অফিসার কাওসার আহমেদ, ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আরমান হোসেন, সাবেক এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. আনিছুল আলম, অ্যাডিশনাল ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর মো. ইছরাইল খান ও মো. মঈদুল ইসলাম, ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর মাকসুদা খানম ও মো. জসিম উদ্দিন ভূইয়া। এ ছাড়া সাবেক অ্যাডিশনাল ম্যানেজিং ডিরেক্টর শাহ মো. আব্দুল বারি, সাবেক অ্যাডিশনাল ম্যানেজিং ডিরেক্টর ও সিএফও মো. হুমায়ুন কবীর, ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. ফিরোজ হোসেন, সাবেক পরিচালক ও বর্তমানে চেয়ারম্যান মো. নজরুল ইসলাম স্বপন, সাবেক পরিচালক মো. আব্দুল্লাহ, পরিচালক মো. নুরুল আমিন, পরিচালক অঞ্জন কুমার সাহা, সাবেক স্বতন্ত্র পরিচালক মো. নাজমুস ছালেহিন এবং সাবেক স্বতন্ত্র পরিচালক মিয়া মোহাম্মদ কাওছার আলমও রয়েছেন তালিকায়।
এজাহারে দুদক বলেছে, ‘মদিনা ডেটস অ্যান্ড নাটস’ শাখার অসম্পূর্ণ ঋণপ্রস্তাবের বিষয়ে কোনো যাচাই, সম্ভাব্যতা যাচাই বা স্টক রিপোর্ট ছাড়াই এবং জামানতের বিষয়টি থাকলেও আসামিরা যোগসাজশে ক্ষমতার অপব্যবহার, অসদাচরণ ও বিশ্বাসভঙ্গের মাধ্যমে ঋণ অনুমোদনের সুপারিশ করেন।
তারা ইনভেস্টমেন্ট রিস্ক ম্যানেজমেন্ট কমিটির সদস্য ও সভাপতি হিসেবে ঋণ অনুমোদনের সুপারিশ, বোর্ড মেমো পাঠানো এবং বোর্ডের অনুমোদন করিয়ে বিপুল অর্থ আত্মসাৎ করেন। তাদের বিরুদ্ধে দ-বিধির ৪০৯ ধারা, ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন, ৫(২) ধারা এবং ২০১২ সালের মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ৪(২) ও ৪(৩) ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে।
এ ছাড়া, ১০৯ কোটি টাকার সন্দেহজনক লেনদেন ও ৭ কোটি ৩৫ লাখ টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে জেমকন গ্রুপের মালিক ও যশোর-৩ আসনের আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য কাজী নাবিল আহমেদের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুদক। গতকাল সোমবার দুদকের প্রধান কার্যালয় থেকে মামলাটি অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, আসামি কাজী নাবিল আহমেদ সাবেক সংসদ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় ক্ষমতার অপব্যবহার করে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত ৭ কোটি ৩৫ লাখ ৬৪ হাজার ৩৫৪ টাকা অর্জন করেন। এ ছাড়া তার নিজ ও যৌথ নামে পরিচালিত বিভিন্ন ব্যাংকের ৪৫টি হিসাবে মোট ১০৯ কোটি ২২ লাখ ৫৩ হাজার ৯৮৯ টাকার অস্বাভাবিক ও সন্দেহজনক লেনদেনের প্রমাণ পাওয়া গেছে।
এসব অর্থ তিনি হস্তান্তর, স্থানান্তর ও রূপান্তরের মাধ্যমে মানিলন্ডারিং সংক্রান্ত অপরাধ করেছেন। আসামির বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন ২০০৪-এর ২৭(১) ধারা, ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারা এবং মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০১২-এর ৪(২) ও ৪(৩) ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে। কাজী নাবিল আহমেদ যশোর-৩ আসন থেকে একাধিকবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিরও একজন সদস্য ছিলেন।