সুস্থ শরীরের জন্য ফলের কোনো বিকল্প নেই, এমনটাই মনে করেন চিকিৎসক ও পুষ্টিবিদরা। ফলে যতই পুষ্টি থাকুক না কেনÑ অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে এই ফল কেনা ও খাওয়া অনেকটা যেন বিলাসিতার পর্যায়ে পৌঁছেছে। এদিকে বর্তমানে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ও মৌসুমী জ্বরসহ বিভিন্ন রোগের সংক্রমণ তীব্র হয়ে উঠেছে। জ¦র আক্রান্তদের সুস্থতা ও বিস্বাদ মুখে ভিটামিন সি জাতীয় ফল খুবই উপকারী।
কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে ফলের দামে যে বিস্ফোরণ ঘটেছেÑ যে কারণে বিড়ম্বনায় পড়ছেন রোগী বা তার স্বজনরা। গত এক মাসের ব্যবধানে ঢাকাসহ সারা দেশে দেশি ও আমদানি করা ফলের দাম প্রায় দ্বিগুণ বেড়েছে। এ ছাড়াও প্রতিনিয়ত কমছে সব ধরনের ফলের আমদানি। বর্তমানে চাহিদার শীর্ষে থাকা মাল্টা গত জুন মাসের চেয়ে চলতি মাসে ৮০ শতাংশ আমদানি কম হয়েছে। ফলে দামও বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে ফলের চাহিদার সঙ্গে আমদানি ঘাটতি বাড়ায় অতি মূল্যবৃদ্ধি ঘটেছে।
ঢাকার ফল ব্যবসায়ীরা বলেছেন, ভিটামিন সি সমৃদ্ধ আমদানিনির্ভর ফলের দাম অনেকে বেড়েছে। এ ছাড়াও দেশীয় ফল এবং ডাবের দামও বেড়েছে। তবে আমদানি ঘাটতির কারণে সবেচেয়ে বেশি বেড়েছে মাল্টার দাম।
দেশের অন্যতম বৃহৎ ফলের পাইকারি বাজার বসে ঢাকার বাদামতলীতে। এ বাজারের কয়েকজন পাইকারি বিক্রেতা বলেন, বর্তমানে ফলের মৌসুম নয়, তাই যেসব দেশ থেকে মাল্টা, কমলা, আপেল, বেদানা আমদানি করা হয়, সেখান থেকেই সরবরাহ কম হচ্ছে, তাই দাম বেড়েছে। তাদের ভাষ্য মতে, যে কারণে বাবুবাজার, মগবাজার, শান্তিনগর, কারওয়ান বাজারের ফুটপাত ও বিভিন্ন এলাকায় ভাসমান দোকানের সংখ্যাও কমেছে।
ঢাকার বিভিন্ন স্থান ঘুরে গতকাল বৃহস্পতিকার দেখা গেছে, আমদানি করা ফলের দাম গত এক মাসের ব্যবধানে বেশি বেড়েছে মাল্টার। এক কেজি মাল্টা বিক্রি হচ্ছে ৪৪০ থেকে ৫০০ টাকা কেজি দরে। প্রায় এক মাস আগেও ঢাকার বাজারে ভালোমানের মাল্টা ২৮০ থেকে ৩০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। একইভাবে আপেলের দাম সর্বনি¤œ ৩৮০ টাকা থেকে ৪২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বেদানা, আঙুর, কমলা, নাশপাতিও চড়া দামে বিক্রি হতে দেখা যায়। দেশীয় ফলের দামও বাড়তি। গত ১৫ দিন আগে ৮০ থেকে ১০০ টাকা বিক্রি হওয়া একজোড়া আনারসের দাম বেড়ে বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে ১৪০ টাকায়। মাঝারি সাইজের একটি জাম্বুরা ৮০-১০০ এবং হাসপাতালগুলোর গেটে একটি ডাব নূ্যূনতম ১৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
বিক্রেতারা বলছেন, বর্তমানে ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া ও জ্বরের প্রকোপ বেড়েছে। যার কারণে মাল্টার চাহিদা অনেক বেড়েছে। চাহিদা বাড়লেও আমদানি ও সরবরাহ কমেছে। যার কারণে ডাব, মাল্টা ও লেবু জাতীয় ফলের দাম বেড়েছে। তবে গত মাসে চাহিদার চেয়ে ৮০ শতাংশ মাল্টা আমদানি কম হয়েছে বলে তথ্য জানিয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।
বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুটস ইম্পোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএফআইএ) প্রেসিডেন্ট সিরাজুল ইসলাম রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘বর্তমানে আমদানি ফল বিলাসী পণ্যের পর্যায়ে পড়ে। এ জন্য আমদানিতে অর্থের সরবরাহ বেশি দরকার। যে কারণে অনেক আমদানিকারক এই ব্যবসা থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন। যার কারণে ফল আমদানি ঘাটতি বেড়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আগের ফল ব্যবসায়ীরা অনেকেই ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছেন, ফলে ব্যবসার প্রতিযোগিতাও কমেছে। ফল এখন হান্ডেড পার্সেন্ট মার্জিনে এলসি করতে হয়। এক কোটি টাকার এলসি করলে আসতে সময় লাগবে দেড়-দুই মাস। ব্যবসায়ী নতুন করে যে আরেকটা চালান করবে সেই পুঁজি তো নেই। আগে ব্যাংকের সম্পর্ক অনুযায়ী মার্জিন লোন দেওয়া হতো, এখন তা হয় না। যে কারণে পুঁজিপতিদের হাতে এই ব্যবসা চলে গেছে। যারা বড় ব্যবসায়ী, এখন তাদের কাছে এই ব্যবসা। সরকার চাইলে এটার সুরাহা করতে পারে।’
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছরে ৩৭৬টি প্রতিষ্ঠান মাল্টা আমদানি করেছে। নতুন অর্থবছরের জুলাই মাসে মাত্র ৩০ জন ব্যবসায়ী মাল্টা আমদানি করেন। গত অর্থবছরে প্রতি মাসে গড়ে এক কোটি ৪০ লাখ কেজি করে মাল্টা আমদানি করা হয়েছে। নতুন অর্থবছরের শুরুতে অর্থাৎ জুলাই মাসে মাল্টা আমদানি করা হয় মাত্র ২৭ লাখ ৫৭ হাজার কেজি; যা স্বাভাবিক গড় চাহিদার মাত্র ২০ শতাংশ। এতে গত মাসে চাহিদার চেয়ে ৮০ শতাংশ মাল্টা আমদানি কম হয়েছে।
২০২৫ সালের জানুয়ারির সঙ্গে পূর্ববর্তী বছরের জানুয়ারি মাসের আমদানি চিত্র তুলনা করলে দেখা যায়, তাজা ফলের ওপর আরোপিত সম্পূরক শুল্ক ২০ থেকে বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ করা হয়েছে। প্রতি ১০০ টাকার ফল আমদানি করতে ১৩৬ টাকার খরচ করতে হয়। অন্যদিকে, সরকার পরিবর্তনের পরে দীর্ঘদিন ধরে নিয়ন্ত্রিত ফলের ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সরকারের অনেক নেতা। তারও প্রভাব বয়েছে বাজারে।
২০২৫ সালের জানুয়ারির সঙ্গে পূর্ববর্তী বছরের জানুয়ারি মাসের আমদানি চিত্র তুলনা করলে দেখা যায়, সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধির ফলে তাজা ফলের আমদানি উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পেয়েছে। যেমন মেন্ডারিন ৫১ দশমিক ৪৯ শতাংশ, আঙুর ২০ দশমিক ৮৬ শতাংশ, আপেল ৩ দশমিক ৪৯ শতাংশ, নাশপাতি ৪৫ দশমিক ৬৪ শতাংশ, আনার-ড্রাগন ফল ইত্যাদি ৩১ দশমিক ৯৮ শতাংশ আমদানি হ্রাস পেয়েছে।
গত কয়েক অর্থবছরের ফল আমদানির চিত্রে নজর রাখলেও দেখা যায়, বছর বছর কমেছে ফলের আমদানি। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মোট তাজা ফল আমদানি করা হয়েছে ৩ লাখ ৩৯ হাজার ৮৯৪ টন। এর আগে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৩ লাখ ৮৬ হাজার ৪১০ টন, ২০২১-২২ অর্থবছরে ৪ লাখ ৮০ হাজার ২১৩ টন, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৪ লাখ ৬৫ হাজার ৩২২ টন এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৪ লাখ ১৭ হাজার ৩৬৫ টন তাজা ফলের আমদানি করা হয়েছিল।
কারওয়ান বাজারের ফল বিক্রেতা সুমন মিয়া জানান, আপেলের দাম কেজিপ্রতি বেড়েছে ১০০ থেকে ১৫০ টাকা। কমলার দাম বেড়েছে ৫০ থেকে ৬০ টাকা, নাশপাতি এবং আনারের দামও প্রতি কেজিতে বেড়েছে ১৪০ থেকে ১৫০ টাকা।
মগবাজারের ফুটপাতে ফল বিক্রি করেন আনসারি বাবু। বাজার সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কালো আঙুর ৬৮০ টাকা থেকে ৭৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। সাদা আঙুর মানভেদে বিক্রি হচ্ছে ৫৫০ থেকে ৬০০ টাকায়। আফ্রিকার আপেল মানভেদে ৪০০ থেকে ৪২০ টাকা, অস্ট্রেলিয়ান আপেল ৩৮০ থেকে ৪২০ টাকা এবং কমলা বিক্রি হচ্ছে ৩০০ থেকে ৩২০ টাকা কেজি দরে।’
তিনি বলেন, ‘প্রতি কেজিতে অন্তত ৬০ টাকা বেড়েছে। গত এক মাসে এই দরে ফল কিনে বিক্রি করতে পারছি না। দাম শুনেই চলে যাচ্ছেন ক্রেতা। যে কারণে ফল আনাও কমিয়েছি।’
তিনি আরও বলেন, ‘নাশপাতি এখন বিক্রি হচ্ছে ৩২০ থেকে ৩৩০ টাকা কেজিতে। ছোট আনার ৩৫০ টাকা এবং মাঝারিটা ৪৫০ টাকায়। সবচেয়ে বড় আনার ৫০০ থেকে ৫৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
ঢাকার আরামবাগে থাকেন গণমাধ্যমকর্মী শাহীন আলম। তিনি বলেন, ‘এক কেজি আপেল কিনতে হয়েছে ৪০০ টাকায়। তিন সপ্তাহ আগে যার দাম ছিল ২৫০ থেকে ২৮০ টাকা।’
ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে কথা হয় ডেঙ্গু আক্রান্ত এক রোগীর স্বজন আশরাফ আহমেদের সঙ্গে। তিনি বলেন, ফলের যে দাম ভাই, শুনেই চলে আসতে ইচ্ছে করে। কিন্তু ছোট ভাইয়ের ডেঙ্গু হয়েছে। ডাক্তার বলেছেন, ভিটামিন সি সমৃদ্ধ ফল খাওয়াতে। এক কেজি মাল্টা কিনেছি সাড়ে চারশ টাকায়।’
ঢাকার কয়েকটি বাজার ঘুরে গতকাল দেখা গেছে, আনারস ১৫০ টাকা জোড়া দরে বিক্রি হচ্ছে। কয়েকদিন আগেও তার দাম ছিল ৮০ থেকে ১০০ টাকা জোড়া। বাজারে প্রতি কেজি পেয়ারা ৮০ থেকে ১২০ টাকা, তরমুজের কেজি ৬০ থেকে ৮০ টাকা এবং পেঁপে ১২০ থেকে ১৪০ টাকা। কলা ৮০ থেকে ১৩০ টাকা ডজন।
তবে বর্তমানে আমদানি করা ফলের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে মাল্টার দাম। মাল্টার দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ার পেছনে সরবরাহ ঘাটতিকেই দায়ী করছেন বিক্রেতারা। তারা বলেছেন, সরবরাহ ঘাটতি রয়েছে এবং চাহিদা বেড়েছে।
ফলের দাম বৃদ্ধি সম্পর্কে কনজুমার অ্যাসেসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সিনিয়র সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, ‘সরকারের সঠিক মনিটরিং নাই, যে কারণে ব্যবসায়ীরা অতি মুনাফা করছে। তাদের অনেকেই সিন্ডিকেট করে দাম বাড়িয়েও দিয়েছে। এ ছাড়াও ফলের দাম বৃদ্ধির আরও কিছু কারণ আছে। যে কারণে ফলের বাজারে অস্থিরতা বাড়ছে। সরকারকে বিষয়টি দ্রুত নিয়ন্ত্রণে আনা দরকার।’
এদিকে ফলের আমদানি কমে যাওয়ার বিষয়ে নাম প্রকাশ করতে না চাওয়া এনবিআরে শীর্ষ এক কর্মকর্তা বলেন, ‘ব্যবসায়ীকে বাণিজ্য সুবিধা দিয়েই করারোপ করা হয়েছে। এটি অতি মূল্যস্ফীতির কারণও হতে পারে। সরকার পরিবর্তন, ভাসমান ব্যবসায়ীদের উচ্ছেদ ও চাঁদা আদায়সহ বিভিন্ন কারণে মূল্যবৃদ্ধি হতে পারে।’
ফল না খেলে স্বাস্থ্যহানি ঘটবে। তাই সুস্বাস্থ্যের জন্য ফলে বিকল্প কি সম্পর্কে জানতে চাইলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসক ডা. সালেহ মাহমুদ তুষার বলেন, ‘ফলের বিকল্প কিছুু নাই। ফল খেতেই হবে। সুস্বাস্থ্যের জন্য ফল চাই।’
সরকারের মনিটরিং সম্পর্কে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আলীম আখতার খান বলেন, ‘ঢাকা শহরে প্রতিদিন আমাদের ৮টি টিম অভিযান চালায়। কম জনশক্তি দিয়ে আমরা সর্বোচ্চ সেবা দেওয়ার চেষ্টা করি। কেউ যাতে ভোক্তা অধিকার আইন খর্ব না করেÑ এ বিষয়ে আমরা সচেতন আছি। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে অবশ্যই ব্যবস্থ নেব।’ ‘ভোক্তাকে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ করার কথা জানিয়ে’ তিনি রূপালী বাংলাদেশকে আরও বলেন, ‘এসব আমদানি পণ্য। আমদানি করা পণ্যে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলেই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন