ঢাকা সোমবার, ০১ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

শেষ হলো রাকসুর  মনোনয়নপত্র বিতরণ

মাইনুল ইসলাম রাজু, রাবি
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১, ২০২৫, ০৩:২৭ এএম
রাকসু নির্বাচন

ছাত্রদলের অবস্থান কর্মসূচি ঘিরে নানা উত্তেজনাকর পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে শেষে হলো রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু) নির্বাচনের মনোনয়ন ফরম বিতরণ কার্যক্রম। ফরম বিতরণের শেষ দিনে শিক্ষার্থী ও ছাত্রশিবিরের সঙ্গে ছাত্রদলের হাতাহাতিসহ নানা ঘটনা ঘটেছে গতকাল রোববার। এতে এক সাংবাদিকসহ বিভিন্ন পক্ষের অন্তত ১০ জন আহত হয়েছেন। সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের ‘ব্যর্থতার’ প্রকাশ পেয়েছে। 

আহতরা হলেনÑ ডিবিসির রাজশাহী ব্যুরো অফিসের ভিডিও সাংবাদিক মনিরুল ইসলাম, সাবেক সমন্বয়ক মাহায়ের ইসলামসহ অন্তত ১০ জন। আহতের বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় চিকিৎসা কেন্দ্রের প্রধান ডা. মাফরুহা সিদ্দিকী লিপি রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, আমাদের চিকিৎসা কেন্দ্রে অন্তত ১০ জন চিকিৎসা নিয়েছেন।

এর আগে গতকাল সকাল সাড়ে ৯টা থেকে ভোটার তালিকায় প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের অন্তর্ভুক্ত করার এক দফা দাবিতে অবস্থান কর্মসূচি পালন শুরু করে শাখা জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। কর্মসূচির শুরুতেই তারা কোষাধ্যক্ষ কার্যালয়ের চেয়ার-টেবিল ভাঙচুর করে এবং তালাবদ্ধ শুরু করেন। তাদের কর্মসূচিতে সংহতি জানায় বিএনপিপন্থি শিক্ষকদের সংগঠন ইউট্যাব, জাতীয়তাবাদী শিক্ষক ফোরাম। 

এর আগে ছাত্রদলের সময় চেয়ে করা অনুরোধসহ ছাত্র রাজনৈতিক দল ও ছাত্রনেতা কয়েকটি দাবিতে তাদের সাথে দুই দফা আলোচনা করে কয়েকটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে নির্বাচন কমিশন। এতে নির্বাচনি তারিখ ও মনোনয়ন ফরম বিতরণের সময় বাড়ানো হয়। নতুন নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হয় দুর্গাপূজার ষষ্ঠীর দিনে। এতে ক্যাম্পাসজুড়ে শুরু হয় তীব্র সমালোচনা। ফলে ১০ ঘণ্টার ব্যবধানে আবারও পরিবর্তন করে নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণ করা হয় ২৫ সেপ্টেম্বর। অনেকে অভিযোগ করেন, নির্বাচন কমিশন ছাত্রদলকে ‘সুবিধা’ দিতেই এ সিদ্ধান্ত নেয়। গতকালকের কর্মসূচিতে নির্বাচনের এক রিটার্নিং কর্মকর্তাকে সরাসরি ছাত্রদলের কর্মসূচিতে বক্তব্য দিতে দেখা গেছে। এতে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন খোদ প্রধান রিটার্নিং কর্মকর্তা।   

ছাত্রদলের কর্মসূচিতে শাখা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক সর্দার জহুরুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা দীর্ঘদিন ধরে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের ভোটার তালিকা অন্তর্ভুক্ত করার দাবি করছি, তবে তারা আমাদের দাবি মানছেই না। তারা রাকসুর ফি দিয়েছে কিন্তু তারা ভোটার হতে পারছে না। সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত হলেই আমরা কর্মসূচি প্রত্যাহার করব।’

দফায় দফায় হাতাহাতি

ছাত্রদলের কর্মসূচিতে বন্ধ করে দেওয়া হয় নির্বাচনের মনোনয়ন ফরম বিতরণের কার্যক্রম। বেলা ১১টা থেকে মনোনয়নপ্রত্যাশী শিক্ষার্থী, সাবেক সমন্বয়করাসহ ছাত্রশিবির ও বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মীরা মনোনয়ন ফরম উত্তোলন করতে রিটার্নিং কর্মকর্তা কার্যালয়ে আসেন। কিন্তু ছাত্রদলের রাকসু কার্যালয়ে তালা দিয়ে অবস্থান করায় তারা আর মনোনয়ন নিতে পারেনি। পরে মনোনয়নপ্রত্যাশী শিক্ষার্থীরা ছাত্রদলের বিপক্ষে অবস্থান নেন। কার্যালয়ের তালা ভাঙতে যান। ছাত্রদল নেতাকর্র্মীদের বাধার কারণে শিক্ষার্থীরা তা আর করতে পারেনি। এরপর শুরু হয় দুই পক্ষের বিভিন্ন ‘আক্রমণাত্মক’ স্লোগান। এ সময় উভয় পক্ষের মাঝে দফায় দফায় ধাক্কাধাক্কি ও হাতাহাতি হয়। একপর্যায়ে বেলা ১টার দিকে তারা ছাত্রদলকে পিছু হটিয়ে কার্যালয়ের তালা ভেঙে সেখানের দখল নেন শিক্ষার্থী, সমন্বয়ক, শিবির। পরে ছাত্রদল নেতাকর্মীরা আবারও কার্যালয়ে ফটকে অবস্থান নেয়। এ সময় উভয় পক্ষ থেকে একে অপরকে ‘আক্রমণ’ করে বিভিন্ন স্লোগান দেন।  

শিবিরের ‘এন্ট্রি’

শিক্ষার্থী ও ছাত্রদলের বিপরীতমুখী অবস্থানের একপর্যায়ে বেলা দেড়টার দিকে কার্যালয়ের সামনে দলবেঁধে উপস্থিত হয় শাখা ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক ও বর্তমান নেতাকর্মীরা। এ সময় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের একটি বড় অংশ শিবিরের সঙ্গে যুক্ত হতে দেখা গেছে। এরপর ছাত্রদল ও শিবির, সমন্বয়ক, শিক্ষার্থীদের মাঝে দুই দফায় ধাক্কাধাক্কি ও বোতল, জুতা ছোড়াছুড়ির ঘটনা ঘটেছে। এ সময় একটি পানির বোতল শিবির সভাপতি মোস্তাকুর রহমান জাহিদের গায়ে লাগলে তাদের নেতাকর্মীরা ছাত্রদলের ব্যবহৃত মাইক ভাঙচুর করেন। এ সময় তাদের ধাক্কায় দায়িত্ব পালনকালে চেয়ার থেকে পড়ে গিয়ে পা ভেঙে যায় সাংবাদিক মনিরুল ইসলামের। ঘটনাস্থলে ছাত্রশিবিরের বর্তমান ও সাবেক সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ বেশ কয়েকজন নেতা উপস্থিত ছিলেন। একপর্যায়ে শিক্ষার্থী ও ছাত্রশিবিরের তোপের মুখে কার্যালয়ের ফটক ছেড়ে পিছু হটে ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা। 

এ সময় ছাত্রশিবিরের সাধারণ সম্পাদক মুজাহিদ ফয়সাল বলেন, ‘আমরা এখানে শুধু মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করতে এসেছি। কাউকে প্রতিরোধ বা প্রতিবাদ করা আমাদের উদ্দেশ্য না।’

প্রশাসনের অনুপস্থিতি

বেলা ১১টায় শুরু হওয়া শিবির, সমন্বয়ক, শিক্ষার্থী ও ছাত্রদলের মুখোমুখি অবস্থান, স্লোগান-পাল্টা স্লোগান, ধাক্কাধাক্কি ও হাতাহাতি চলেছে দুপুর ১টা পর্যন্ত। এর মাঝে সোয়া ১১টার দিকে প্রক্টর অধ্যাপক মাহবুবর রহমান পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করলেও ব্যর্থ হয়ে ফেরত গেছেন তিনি। এর পরে দুপুর ১টা পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন সংশ্লিষ্ট কাউকে পরিস্থিতি সামাল দিতে উদ্যোগী হতে দেখা যায়নি। তবে, ঘটনাস্থল থেকে দূরে পুলিশ প্রশাসনের সঙ্গে প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, দুই উপ-উপাচার্যসহ আর কোনো প্রশাসনিক ব্যক্তি ঘটনাস্থলে আসেননি। এদিকে ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীরা মনোনয়নপত্র তুলতে গেলে সেখানে উপস্থিত হতে দেখা গেছে রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ইফতিখারুল আলম মাসউদকে। 

৫ ঘণ্টা পর মনোনয়ন ফরম বিতরণ শুরু

মনোনয়নপত্র বিতরণের গতকাল রোববার শেষ দিন হলেও ছাত্রদলের কর্মসূচিতে ব্যাহত হয় মনোনয়নপত্র বিতরণ। পরে ছাত্রশিবির, শিক্ষার্থী ও সমন্বয়কদের প্রতিরোধের মুখে ছাত্রদল পিছু হটলে দুপুর ২টা থেকে মনোনয়ন ফরম বিতরণ শুরু হয়। পাঁচ ঘণ্টা পর মনোনয়ন ফরম বিতরণ শুরু হলে শাখা ছাত্রশিবির পূর্ণাঙ্গ প্যানেল, সাবেক সমন্বয়ক সালাহউদ্দিন আম্মার, মেহেদী সজীব, আকিল বিন তালেবসহ অনেকেই মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছেন।

যা বলছেন ছাত্রনেতারা

এ বিষয়ে সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখার আহ্বায়ক ফুয়াদ রাতুল বলেন, ‘একটা রাজনৈতিক সংগঠন প্রশাসনের কাছে দাবি নিয়ে এসেছে। সেখানে প্রশাসন নিজে ব্যবস্থা না নিয়ে শিক্ষার্থীদের বা অন্য কোনো রাজনৈতিক সংগঠনকে তা প্রতিরোধ করতে পাঠালে তা অবশ্যই নির্বাচনের মাঠকে নিরুত্তাপ করবে। এতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ কমবে। এভাবে চললে রাকসু দুইটা রাজনৈতিক সংগঠনেরই হয়ে উঠবে।’

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক মেহেদী সজীব বলেন, ‘আমরা মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করতে আসলে সেখানে ছাত্রদলের কর্মসূচি দেখতে পাই। তাদের প্রতিরোধ করে তালা ভেঙে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছি। এখানে আমরা প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তা দেখতে পেয়েছি, যা একটি স্বাধীন নির্বাচন পরিচালনা করার জন্য উদ্বেগজনক।’

আরেক সাবেক সমন্বয়ক সালাহউদ্দিন আম্মার মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ শেষে বলেন, ‘ছাত্রদল যাদের ভোটার তালিকা অন্তর্ভুক্ত করার দাবি নিয়ে এসেছে তাদের তো এখনো হল সংযুক্ত, আইডি কার্ড কোনো কিছুই হয়নি। এটাকে সামনে রেখে তারা রাকসু বানচালের ছক কষছিল, আমরা তা প্রতিহত করে মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেছি।’

সার্বিক বিষয়ে রাকসুর প্রধান রিটার্নিং কর্মকর্তা অধ্যাপক সেতাউর রহমান, ‘এই পরিস্থিতিতে আমরা বৈঠকে বসছি। তাদের আগের দেওয়া দাবি-দাওয়াগুলো আমরা মেনে নিয়েছি। তারা এখন নতুন নতুন দাবি-দাওয়া নিয়ে হাজির হচ্ছেন। এখন যে দাবিতে তারা আন্দোলন করছে, কিছুদিন আগেও তাদের এই দাবি ছিল না। তারা রাকসু কোষাধ্যক্ষ কার্যালয়ে চেয়ার-টেবিল ওলট-পালট করে গেট আটকে রেখেছে। তাদের আরও দাবি-দাওয়া থাকলে সেটা স্মারকলিপি দিয়ে আমাদের কাছে পেশ করবে। কিন্তু তারা যেটা ঘটিয়েছে এটা অত্যন্ত নিন্দনীয়। এ ছাড়া আমরা লক্ষ্য করেছি, তাদের এই কর্মসূচিতে কিছু শিক্ষকও বক্তব্য রেখেছেন, যার মধ্যে একজন রিটার্নিং কর্মকর্তা ছিলেন, যিনি নির্বাচনের জন্য এসাইনমেন্ট পার্সন। এটা কোন ভাষায় ব্যক্ত করব আমার জানা নেই।’