রাজধানীর মাইলস্টোন স্কুলে বিমান দুর্ঘটনার পর দেশজুড়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর অগ্নি নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মতোই দেশের অন্যতম আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) অগ্নি নিরাপত্তাব্যবস্থাও কতটা কার্যকর তা নিয়ে ইতিমধ্যে প্রশ্ন উঠেছে। বিশ^বিদ্যালয়ে নতুন নতুন বহুতল আবাসিক হল, ডিপার্টমেন্ট ও অফিস ভবন গড়ে উঠলেও নিরাপত্তাব্যবস্থা এখনো দৃশ্যমান নয়। শিক্ষার্থীরা মনে করেন, আগুন লাগলে জীবন রক্ষার বিষয়টি ‘নিয়তিনির্ভর’।
ক্যাম্পাস ঘুরে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরোনো হলগুলো যেমনÑ আল বেরুনী, মীর মশাররফ হোসেন, মাওলানা ভাসানী, ১০ নং ছাত্র হল, নওয়াব ফয়জুন্নেসা, বেগম খালেদা জিয়া, জাহানারা ইমাম হলসহ বাকি পুরোনো হলের কোথাও দৃশ্যমান অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র নেই। কোথাও কোনো ফায়ার অ্যালার্ম নেই, নেই পানির রিজার্ভ ট্যাংক বা হাইড্রেন্ট সিস্টেম। নতুন নির্মিত বহুতল আবাসিক ভবনগুলোতেও ফায়ার সেফটি সিস্টেম আংশিকভাবে স্থাপন করা হলেও দায়িত্বপ্রাপ্তদের অনেকেই জানেন না কীভাবে এগুলো পরিচালনা করতে হয়। ফলে কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে তা নিছক আনুষ্ঠানিকতার পর্যায়ে থেকে যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি ভবনের ভেতরেই পর্যাপ্ত ইমার্জেন্সি এক্সিট বা ফায়ার এস্কেপ সিঁড়ি নেই।
দর্শন বিভাগের শিক্ষার্থী মাহির রায়ান নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, ফায়ার সেফটির বিষয়টা সাধারণ প্রয়োজনীয়তার অন্তর্ভুক্ত আর প্রশাসনের উচিত এটি নিশ্চিত করা। বড় সমস্যা হলো হলগুলোতে যারা টপ ফ্লোরে থাকি। কখনো যদি আগুন লাগে, তাদের লাইফ সব থেকে বেশি রিস্কের মধ্যে থাকবে। ফায়ার সেফটির বিষয়টা ক্যাম্পাসের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোর মধ্যে একটা, আমার মনে হয় প্রশাসনের এই বিষয়টা গুরুত্ব দেওয়া উচিত। প্রশাসন বিষয়টি দ্রুত সমাধান করবে বলে আশা প্রকাশ করেন মাহির।
ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী মেহেদী মামুন বলেন, রাজধানীসহ সারা দেশে বিভিন্ন জায়গায় দুর্ঘটনা ঘটছে। বিশেষ করে ছয়তলার অধিক যে ভবনগুলো আছে, সেসব ভবনে অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থা যদি না থাকে, তাহলে সেটি সংকট সৃষ্টি করে। জাবিতে প্রায় ছয়টি হল আছে, যেগুলো ১০ তলা করে এবং অন্য আগের যে হলগুলো আছে, সেগুলোর কোনোটাতেই অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থা নেই। আমি মনে করি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অতি দ্রুত এসব হল এবং অন্যান্য আবাসিক ভবন ছাড়াও অনাবাসিক ও একাডেমিক ভবনগুলোতে দ্রুত অগ্নিনির্বাপণের ব্যবস্থা যোগ করবে।
জাকসুতে ইসলামি ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেলের সমাজসেবা পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা আরিফুল ইসলাম বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে অগ্নিনির্বাপণের যে ব্যবস্থাটা রয়েছে, এটাকে উন্নত করা প্রয়োজন। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে এবং ফ্যাকাল্টির বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টগুলোতে যথাযথ অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র নেই। আর যে যন্ত্রগুলো রয়েছে, সেগুলো পরিচালনার দায়িত্বরতরা দক্ষ নন। আমাদের এখানে দেশের অন্যতম একটি বড় বিজ্ঞান গবেষণাগার রয়েছে। সবকিছু বিবেচনা করে ফায়ার এক্সটিংগুইশারের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা রাখা জরুরি। পরিচালনায় দায়িত্বরতদের যথাযথ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক অগ্নিনির্বাপণের ক্ষেত্রে একটি ফায়ার সার্ভিস স্টেশন স্থাপনও বিবেচনাযোগ্য।
জাকসুতে ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেলের সহসমাজসেবা (নারী) পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা কাজী মৌসুমি আফরোজ বলেন, ‘মেয়েদের হল বা ফ্যাকাল্টিতে অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র নেই। যদি দুর্ঘটনা ঘটে, তখন অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র না থাকার কারণে এটি বড় হয়ে উঠতে পারে। বিষয়টি অবগত আছি। যদি সুযোগ হয়, তাহলে আমি অবশ্যই এই সমস্যা সমাধানে কাজ করব।’
বাংলাদেশে ফায়ার সার্ভিসের হিসাব অনুযায়ী, প্রতি বছর গড়ে ২৬ হাজারের বেশি অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে বড় একটি অংশ ঘটে শীতকালে। বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট, রান্নাঘরের গ্যাস লিকেজ অথবা অসাবধানতাবশত মোমবাতি বা কয়লা ব্যবহারের ফলে এসব দুর্ঘটনা ঘটে। এই দিক বিবেচনা করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের নবনির্মিত ছয়টি হলে কারিগরি দুর্বলতার কারণে বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিটের মাধ্যমে আগুন লাগার সম্ভাবনা প্রকট।
এ বিষয়ে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স স্টেশনের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আমাদের স্টেশন থেকে যানজট না থাকলে জাহাঙ্গীরনগরে পৌঁছাতে ২০ থেকে ২৫ মিনিট সময় লাগে। তবে যানজট থাকলে দীর্ঘ সময় লাগতে পারে।
ফায়ার সার্ভিস স্টেশন স্থাপন বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল কর্মকর্তা হাবিবুর রহমান বলেন, ‘নবনির্মিত ছয়টি হলের জেনারেটর রুমের সঙ্গে ফায়ার এক্সটিংগুইশারের সাব-স্টেশন করা হলেও পুরোনো হলে এরকম কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। প্রশাসন যদি একটি জায়গায় ফায়ার স্টেশনের অনুমোদন দেয়, তাহলে অগ্নি নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুর্যোগ বিজ্ঞান ও জলবায়ু স্থিতিস্থাপকতা বিভাগের অধ্যাপক মো. জিল্লুর রহমান বলেন, ‘দুর্ঘটনা কমানোর জন্য নির্মাণের সময় অগ্নি নিরাপত্তায় বিল্ডিং কোড ও ফায়ার সার্ভিস আইন অনুসরণ করতে হবে। অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা, দ্রুত জননিরাপত্তা নিশ্চিত করা, ফায়ার এক্সিট, জরুরি নির্গমন পথ ও সাইনের ব্যবস্থা রাখতে হবে। নির্মাণ সঠিক হলেও আগুন লাগতে পারে, তাই বিদ্যমান কাঠামোগুলোর জন্য জনসচেতনতা অত্যন্ত জরুরি। এ ক্ষেত্রে অগ্নি সুরক্ষাবিষয়ক প্রশিক্ষণ, অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রের ব্যবহার এবং ধোঁয়া শনাক্তকরণ যন্ত্রের (স্মোক ডিটেক্টর) সঠিক স্থাপনা ও কার্যকারিতা সম্পর্কে বোঝানো প্রয়োজন।’
তিনি আরও বলেন, শিক্ষার্থীদের জন্য নিয়মিত ফায়ার ড্রিল বা মহড়ার আয়োজন করা দরকার। তা না হলে দুর্ঘটনার সময় আতঙ্কই হয়ে উঠবে সবচেয়ে বড়ো শত্রু।
শিক্ষার্থীরা বলছেন, এখনই যদি বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থা না নেয়, তাহলে বড় দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা থেকে যায়। তাদের দাবিÑ প্রতিটি হল, বিভাগ ও প্রশাসনিক ভবনে কার্যকর অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র স্থাপন। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মীদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ। বছরে অন্তত একবার ফায়ার ড্রিল আয়োজন। একটি স্থায়ী ফায়ার সার্ভিস পোস্ট বা স্টেশন স্থাপন। গ্যাসের সংযোগ ও বৈদ্যুতিক তারের নিয়মিত পরিদর্শন।
অগ্নিনির্বাপণের বিষয়ে জাকসুর নির্বাচিত সমাজসেবা ও মানবসম্পদ উন্নয়নবিষয়ক সম্পাদক আহসান লাবিব বলেন, জাবি প্রশাসন এখনো সব বিভাগ ও অনুষদে অগ্নিনির্বাপকের ব্যবস্থা করতে পারেনি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলে প্রতিটি বিভাগে ফায়ার এক্সটিংগুইশার যন্ত্র আদায় করব, যাতে করে অগ্নিনির্বাপণের সুন্দর একটা ব্যবস্থা রাখা হয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের যেকোনো ঝুঁকি থেকে মুক্ত রাখা যায়।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক সোহেল আহমেদ বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন ছয়টি আবাসিক হলে যে সাবস্টেশন বা ট্রান্সফর্মার আছে, সেই জায়গাগুলোতে ফায়ার এক্সটিংগুইশারের মাধ্যমে ফায়ার সেফটি ইনসিওর করা হয়েছে। কিন্তু হলগুলোর ক্যান্টিন ও ডাইনিংয়ের গ্যাস সরবরাহের জায়গাগুলোতে ফায়ার সেফটি নেই।
আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিরেক্টর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট শীর্ষক প্রকল্পের পরিচালকের সঙ্গে কথা বলে এ বিষয়গুলো জিজ্ঞেস করি। ‘প্রজেক্ট ইমপ্লিমেন্টেশন (পিআইসি) কমিটির অধিকতর উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পের সভায় তিনটি মন্ত্রণালয় ও ইউজিসির প্রতিনিধিরা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছিলেন। তাদের জানাই, আমরা হলগুলোতে ফায়ার সেফটি নিশ্চিত করতে চাই। আরডিপিপি অনুমোদন হলে সব হলেই অগ্নি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যাবে বলে উপ-উপাচার্য আশা প্রকাশ করেন।
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন