দেশি ও বিদেশি মুদ্রায় প্রায় ২ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করে বিপাকে পড়েছে সাবমেরিন ক্যাবল সেবা প্রদানে লাইসেন্সপ্রাপ্ত বেসরকারি খাতের দেশীয় তিন প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনকে (বিটিআরসি) লাইসেন্স ফি এবং বিটিআরসির দেওয়া লক্ষ্যমাত্রা পূরণে বৈদেশিক ক্রয় বাবদ এই অর্থ বিনিয়োগ করেছে প্রতিষ্ঠানগুলো। আগামী ২৫ অক্টোবরের মধ্যে ফাইবার ক্যাবল স্থাপনে প্রয়োজনীয় অনুমোদন না পেলে বিনিয়োগকৃত অর্থ গচ্চার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
অন্যদিকে বেসরকারি খাতের এই সাবমেরিন ক্যাবল-সেবা চালু না হলে দেশের আরও ২০০ মিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রাও খরচ হবে। সেই সঙ্গে বাড়বে ইন্টারনেটের জন্য ভারতের প্রতি নির্ভরশীলতা। খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ে এবং ভারতের প্রতি নির্ভরশীলতা কমাতে লাইসেন্সপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে সাবমেরিন ক্যাবল সেবার বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করতে সরকারি সংস্থাগুলোর সহযোগিতা করা উচিত।
দেশে সাবমেরিন ক্যাবলভিত্তিক ব্যান্ডউইথ সেবা প্রদানের প্রথম লাইসেন্সপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান ছিল রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বাংলাদেশ সাবমেরিন ক্যাবল কোম্পানি লিমিটেড (বিএসসিপিএলসি)। এরপর ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে বেসরকারি তিন প্রতিষ্ঠান সামিট কমিউনিকেশন্স লিমিটেড, সিডিনেট কমিউনিকেশন্স লিমিটেড ও মেটাকোর সাবকম লিমিটেডকে সাবমেরিন ক্যাবল লাইসেন্স দেওয়া হয়। ১০ বছর মেয়াদি এই লাইসেন্সের জন্য লাইসেন্স একুইজিশেন ফি, লাইসেন্স রিনিউয়াল ফি এবং প্রযোজ্য কর বাবদ তিনটি প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসিকে দিয়েছে প্রায় ৬৫ কোটি টাকা। ‘রোল আউট অবলিগেশন’-এর শর্ত অনুযায়ী, চলতি বছরের সেপ্টেম্বরের মধ্যে বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করতে হবে প্রতিষ্ঠানগুলোকে।
শর্ত অনুযায়ী সিঙ্গাপুর থেকে বাংলাদেশের কক্সবাজার পর্যন্ত সাবমেরিন ক্যাবল স্থাপনের উদ্যোগ নেয় সামিট, সিডিনেট ও মেটাকোর। সিঙ্গাপুর থেকে মিয়ানমার পর্যন্ত প্রায় ২ হাজার কিলোমিটার (কিমি) এবং মিয়ানমার থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত প্রায় ১ হাজার ৩০০ কিমি ক্যাবল স্থাপনে ‘কাম্পানা’ নামক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করে দেশীয় প্রতিষ্ঠান তিনটি। সিঙ্গাপুরভিত্তিক এই প্রতিষ্ঠান ফাইবার অপটিক্যাল ক্যাবল তৈরি এবং সিঙ্গাপুর থেকে মিয়ানমার হয়ে বাংলাদেশের কক্সবাজারে সেই ক্যাবল স্থাপনের দায়িত্বে থাকবে। এ জন্য প্রতিষ্ঠান দুটির সঙ্গে ১২৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের চুক্তি করে। পুরো কাজের মধ্যে সিঙ্গাপুর থেকে মিয়ানমার পর্যন্ত ক্যাবল স্থাপনের কাজও সম্পন্ন হয়েছে। ১২৩ মিলিয়ন ডলারের মধ্যে কাম্পানাকে ৬৭ মিলিয়ন ডলার ইতিমধ্যে পরিশোধও করেছে প্রতিষ্ঠান তিনটি। এর সঙ্গে মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) বাবদ ২৫ শতাংশ হারে ১৬ দশমিক ৭৫ মিলিয়ন ডলার জমা হয়েছে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় কোষাগারে। তবে বিপত্তি হয়েছে মিয়ানমার থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত অংশের ফাইবার স্থাপনে।
এই কার্যক্রমের সঙ্গে যুক্ত একটি পক্ষ জানিয়েছে, মিয়ানমার থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ক্যাবল স্থাপনকারী জাহাজ বাংলাদেশের জলসীমায় প্রবেশের জন্য প্রয়োজনীয় অনুমোদন পাওয়া যাচ্ছে না। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পরিবেশ মন্ত্রণালয় ও গোয়েন্দা সংস্থার অনুমোদনের অপেক্ষা করছে প্রতিষ্ঠানগুলো। তুলনামূলকভাবে শীতকালে সাগরের জলরাশি বেশি শান্ত থাকার কারণে জাহাজগুলো শীতের মৌসুমে ক্যাবল স্থাপনের কাজ করে। সেই হিসাবে চলতি বছরের ডিসেম্বরে মিয়ানমার থেকে কক্সবাজার অংশে ক্যাবল স্থাপনের সময়কাল ধার্য ছিল। এ বাবদ জাহাজের অর্থও পরিশোধ করেছে প্রতিষ্ঠান তিনটি। নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পাওয়া না গেলে আগামী শীতের আগে এই ক্যাবল স্থাপনের কাজ সম্পন্ন হবে না। তখন আবার বিশেষ ওই জাহাজের শিডিউল থাকবে কি না, সেটাও একটি প্রশ্ন।
সূত্রমতে, ক্যাবল স্থাপন সম্পন্ন হোক বা না হোক, চুক্তির ১২৩ মিলিয়নের বাকি ৫৬ মিলিয়নের অর্থও পরিশোধ করতে হবে সামিট, সিডিনেট ও মেটাকোরকে। এ থেকেও ২৫ শতাংশ হারে ভ্যাট পাবে সরকার। সব মিলিয়ে ১৫৩ দশমিক ৭৫ মিলিয়ন ডলার বা ১ হাজার ৮৬৬ কোটি ডলার খরচ হবে প্রতিষ্ঠান তিনটির। সেই সঙ্গে বিটিআরসিকে আগে থেকেই দেওয়া ৬৫ কোটি মিলে, প্রায় ২ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগকৃত অর্থ গচ্চা যাওয়ার আশঙ্কা করছে প্রতিষ্ঠানগুলো।
এদিকে প্রতি বছর বাংলাদেশে ব্যবহারকারীদের মধ্যে যে ইন্টারনেট ব্যবহারের প্রবণতা রয়েছে, সেই হিসাবে ২০২৬ ও ২০২৭ সালে যথাক্রমে প্রতি সেকেন্ডে ৬ দশমিক ৫ এবং ১৩ টেরাবিট (টিবিপিএস) ব্যান্ডউইথ আমদানি করতে হবে। অর্থাৎ, আগামী দুই বছরে ভারত থেকে প্রায় প্রতি সেকেন্ডে ২০ টেরাবিট (টিবিপিএস) ব্যান্ডউইথ আমদানি করতে হবে। চলতি বছরে বাংলাদেশের প্রায় ১৩ কোটি ইন্টারনেট ব্যবহারকারী প্রায় ৯ টিবি ব্যান্ডউইথ ব্যবহার করবে, যার মধ্য থেকে দুটি ক্যাবলের (সি-মি-উই-৪ এবং সি-মি-উই-৫) মাধ্যমে ৭ দশমিক ২ টিবিপিএস দিচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বিএসসিপিএলসি। বাকিটা ইন্টারন্যাশনাল টেরিস্টোরিয়াল ক্যাবলের (আইটিসি) মাধ্যমে আসছে ভারত থেকে। ইন্টারনেট ব্যবহারের প্রবণতা অনুযায়ী, ২০২৬ ও ২০২৭ সালে বাংলাদেশে ১৫ দশমিক ৭ টিবি এবং ২১ দশমিক ১ টিবি ব্যান্ডউইথের প্রয়োজন হবে। অতিরিক্ত চাহিদার এই ব্যান্ডউইথ বিএসসিপিএলসি দিতে না পারলে এবং বেসরকারি খাতের সাবমেরিন ক্যাবলভিত্তিক ব্যান্ডউইথ দেশে না এলে, ব্যান্ডউইথ আমদানি করতে হবে ভারত থেকে।
পরিচয় গোপন রাখার শর্তে দেশের একজন অভিজ্ঞ টেলিকম বিশেষজ্ঞ বলেন, ‘২০২৬ সালে ৬ থেকে ৭ টিবি এবং ২০২৭ সালে ১২ থেকে ১৩ টিবি ব্যান্ডউইথ ভারত থেকে আনতে হতে পারে। অর্থাৎ, দুই বছরে প্রায় ২০ টিবি। প্রতি সেকেন্ডে ১ মেগাবিট ১ ডলার হিসেবে এই ২০ টিবিপিএস ব্যান্ডউইথের জন্য ভারতকে দিতে হবে ২০০ মিলিয়ন ডলার। এটা এড়িয়ে নতুন সাবমেরিন ক্যাবলের ব্যান্ডউইথ আনা গেলে একদিকে যেমন বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হবে, আরেকদিকে দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর বিনিয়োগে দেশীয় সক্ষমতা বাড়বে।’
এসব বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে কোনো ধরনের মন্তব্য করতে রাজি হয়নি সামিট, মেটাকোর ও সিডিনেট। তবে সরকারের পক্ষ থেকে সহযোগিতা পাওয়ার আশাবাদ ব্যক্ত করেছে প্রতিষ্ঠানগুলো।
এ বিষয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসির বক্তব্য জানতে এর চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) এমদাদ উল বারীর সঙ্গে দুই দিন চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা যায়নি। তবে তৃতীয় সাবমেরিন ক্যাবল ‘সি-মি-উই-৬’-এর মাধ্যমে দেশে আরও ১৫ টিবি ব্যান্ডউইথ সরবরাহের সক্ষমতার কথা জানিয়েছে বিএসসিপিএলসি। চলতি বছরের দ্বিতীয় অর্ধভাগের যেকোনো সময় এই ক্যাবল বাণিজ্যিক কার্যক্রমে আসবে উল্লেখ করে প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক আসলাম হোসেন রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘এই ক্যাবলের মাধ্যমে কমপক্ষে ১৫ টিবি ব্যান্ডউইথ আসবে; সিঙ্গাপুর থেকে আমাদের দিকে ১৫ এবং এখান থেকে ফ্রান্সের দিকে ১৫ টিবি। এখন যে ৭ দশমিক ২ টিবি দিচ্ছি, তার সঙ্গে এটা যুক্ত হবে। তবে প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের সঙ্গে চাইলে এর সক্ষমতা আরও বাড়ানো যাবে, যা দিয়ে ২০৩০ সালের পরেও চাহিদা মেটানো যাবে। এখন ভারত থেকে ব্যান্ডউইথ আমদানি করা হচ্ছে। কারণ আমাদের তুলনায় সেখান থেকে কমে পাওয়া যাচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘কিন্তু তাদের ব্যান্ডউইথে আমরা মূলত ‘কনটেন্ট’ দেখি। এই কনটেন্ট দেখার জন্য বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোর সার্ভার (ফেসবুক, গুগল, ইউটিউব) বাংলাদেশে স্থাপনে প্রতিষ্ঠানগুলোকে এখানে বিনিয়োগে আগ্রহী করতে সরকারের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। তেমনটা হলে ভারতীয় ব্যান্ডউইথের ওপর নির্ভরশীলতা কমবে। আবার সেই কনটেন্টগুলো সিঙ্গাপুরের সার্ভারেও রয়েছে। সেখান থেকে এনে কিন্তু দেখাচ্ছি আমরা। আবার চতুর্থ আরেকটি ক্যাবল সংযোগের চিন্তাভাবনাও চলছে, যদিও এটি এখনো আলোচনার পর্যায়ে রয়েছে।’ তবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বাণিজ্যিক কার্যক্রমে এলে বিএসসিপিএলসি ব্যাবসায়িকভাবে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হবে বলেও জানান আসলাম হোসেন।
অন্যদিকে, কারণ যাই হোক, বাংলাদেশের ইন্টারনেট ব্যবস্থা বাধাহীন রাখতে ও স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে এই সাবমেরিন ক্যাবলগুলোর প্রয়োজনীয়তা রয়েছে বলে জানান খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের শীর্ষ সংগঠন বেসিসের সাবেক প্রেসিডেন্ট ও ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক পরিচালক সৈয়দ আলমাস কবীর রূপালী বাংলাদেশকে বলেন, ‘ইন্টারনেট খাতে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় রয়েছি। আমরা ফ্রিল্যান্সার বাজারে শক্ত অবস্থান চাই, আউটসোর্সিং খাতের বাজার আরও সম্প্রসারণ করতে চাই। এসবের জন্য প্রয়োজন হবে ইন্টারনেটের। আমাদের পাশর্^বর্তী দেশগুলোতে যেমন পাকিস্তানে সাতটি, শ্রীলঙ্কায় আটটি, ভারতে ২০টির বেশি এবং মিয়ানমারে তিনটি সাবমেরিন ক্যাবল আছে। আমাদের এখন পর্যন্ত আছে দুটি। এই সাবমেরিন ক্যাবল আমাদের আরও আগেই দরকার ছিল। কোনো অনিয়ম নিয়ে সরকারের কাছে কোনো তথ্য থাকলে সরকার সেটা খতিয়ে দেখতেই পারে, কিন্তু জাতীয় স্বার্থেই এই কাজগুলো (ক্যাবল স্থাপন) সম্পন্ন করতে হবে।’

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন