জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের ন্যায্য রূপান্তরে রাজনৈতিক দলগুলোর অঙ্গীকার নিশ্চিতকরণের দাবিতে ১২ দফা নাগরিক ইশতেহার প্রকাশ করেছেন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা। তারা বলছেন, নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় এলে দীর্ঘমেয়াদি অঙ্গীকার গ্রহণ করুক। যাতে করে জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমানো যায়, দেশের শক্তি ও সার্বভৌমত্ব শক্তিশালী হয় এবং দুর্বল জনগোষ্ঠীর জন্য ন্যায্য, সমানাধিকারভিত্তিক ও জলবায়ু সহনশীল শক্তি রূপান্তর নিশ্চিত করা যায়। যা সরকার ও রাজনৈতিক দলের অঙ্গীকার ও ভূমিকার ওপরই জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের ইতিবাচক পরিবর্তন নির্ভর করে। তাই আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে যখন রাজনৈতিক দল ও জোটগুলো তাদের নির্বাচনি ইশতেহার প্রণয়নে ব্যস্ত, ঠিক তখন নাগরিক সমাজ ‘জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে ন্যায্য রূপান্তরের’ দাবি তুলে ধরতে এই ১২ দফা সংবলিত নাগরিক ইশতেহার প্রণয়ন করে। যাতে করে রাজনৈতিক দলগুলো খোলামনে এ খাতের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো দলীয় নির্বাচনি ইশতেহারে অন্তর্ভুক্ত করতে প্রণোদিত হয়।
গতকাল মঙ্গলবার ২০২৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে রাজধানীর রিপোর্টার্স ইউনিটিতে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে দেশের নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা এই ১২ দফা নাগরিক ইশতেহার উন্মোচন করেন। বাংলাদেশের প্রতিবেশ ও উন্নয়নবিষয়ক কর্মজোট (বিডব্লিউজিইডি) এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে। সহ-আয়োজক হিসেবে অংশ নেয়Ñ বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতি (বেলা), বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট ফর লেবার স্টাডিজ (বিলস্), উপকূলীয় জীবনযাত্রা ও পরিবেশ কর্মজোট (ক্লিন), এথিক্যাল ট্রেড ইনিশিয়েটিভ (ইটিআই বাংলাদেশ), লইয়ার্স ফর এনার্জি, এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (লিড), মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন এবং রিগ্লোবাল।
ইশতেহারটি পাঠ করেন ক্লিনর নেটওয়ার্ক অ্যাডভাইজার মনোয়ার মোস্তফা। ইশতেহারে বলা হয়, বাংলাদেশের জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে দাঁড়িয়েছে। দেশে বিদ্যুৎ পৌঁছে গেছে ৯৯.২৫% পরিবারে, কিন্তু দীর্ঘদিনের অযৌক্তিক ফসিল জ্বালানি নির্ভরতা, অস্বচ্ছ চুক্তি এবং অবাস্তব মাস্টারপ্ল্যানের কারণে দেশ বড় ধরনের আর্থিক ক্ষতি, পরিবেশগত অবনতি এবং জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকিতে পড়েছে। তিনি বলেন, এই সময়ে দেশের কার্বন নির্গমন দ্বিগুণ হয়েছে, ২০০৮ সালে ১৪৬.৮ মিলিয়ন টন থেকে বেড়ে ২৮১.৪ মিলিয়ন টন হয়েছে। এ কারণে বাংলাদেশের বায়ুর মান বিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণের মধ্যে পড়ে গেছে।
এ সময় বিডব্লিউজিইডির সদস্যসচিব হাসান মেহেদী বলেন, গত ১৬ বছরে বেসরকারি বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলো ১.৭২ ট্রিলিয়ন টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে নিয়েছে, আর বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের ক্ষতি হয়েছে ২.৫৩ ট্রিলিয়ন টাকা, যার ফলে সরকারকে ২.৩৬ ট্রিলিয়ন টাকা ভর্তুকি দিতে হয়েছে। সাধারণ মানুষের অর্থ মূলত ফসিল জ্বালানিতে যুক্ত স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর হাতে চলে গেছে।
প্যানেলে আরও উপস্থিত ছিলেন মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের সমন্বয়ক ওয়াসিউর রহমান এবং লিড বাংলাদেশের আইনজীবী ও গবেষক শিমনউজ্জামান।
১২ দফা নাগরিক ইশতেহারের মধ্যে রয়েছেÑ জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক অভিঘাত মোকাবিলায় ১. দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ‘জাতীয় জ্বালানিনীতি’ প্রণয়ন করতে হবে। নতুন জ্বালানিনীতির আলোকে পরিবেশগত, সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব বিবেচনায় নিয়ে অন্যান্য খাতভিত্তিক নীতি এবং মহাপরিকল্পনা পর্যালোচনা ও প্রণয়ন করতে হবে। জ্বালানি, বিদ্যুৎ ও জলবায়ু-সংশ্লিষ্ট সব ধরনের নীতিমালা, পরিকল্পনা, আইন ও বিধিমালা প্রণয়নের পূর্বে নাগরিক সমাজ ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিতে হবে। ২. বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের সম্ভাব্য দুর্নীতি প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইন ও বিধিমালা পরিমার্জন করে সব ধরনের বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তি (পিপিএ) ও বাস্তবায়ন চুক্তি (আইএ) তথ্য অধিকার আইনের আওতায় উন্মুক্ত করতে হবে। প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নে নাগরিক পরিবীক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে। দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত প্রত্যেককে বিচারের আওতায় আনা এবং বিদ্যুৎ খাত থেকে পাচারকৃত অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। ৩. জীবাশ্ম জ্বালানি, বিশেষত কয়লা, গ্যাস ও জ্বালানি তেলের ভর্তুকি ধীরে ধীরে কমিয়ে আনতে হবে যাতে শিল্প-কারখানা, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও আবাসিক খাত দ্রুততম সময়ে সাশ্রয়ী নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহারে উৎসাহিত হয়। সব শিল্প-কারখানা ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে ৩০ শতাংশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে ৪০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার বাধ্যতামূলক করতে হবে। শিল্প খাতে নবায়নযোগ্য জ্বালানি প্রবর্তনের জন্য সহজ শর্তে ঋণ ও কর রেয়াতের সুবিধা দিতে হবে। ৪. কয়লা, গ্যাস ও তেলভিত্তিক (জীবাশ্ম জ্বালানি) নতুন কোনো বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের অনুমোদন দেওয়া যাবে না। পুরোনো ও অকার্যকর বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বন্ধ করে নবায়নযোগ্য জ্বালানির বিদ্যুৎকেন্দ্র দিয়ে প্রতিস্থাপন করতে হবে। এসব বিদ্যুৎকেন্দ্রে কর্মরত শ্রমিকদের বিকল্প কর্মসংস্থান তৈরির আগাম উদ্যোগ নিতে হবে। যেসব বিদ্যুৎকেন্দ্র পূর্ণ ক্ষমতায় চলতে অক্ষম সেগুলোর ‘ক্যাপাসিটি চার্জ’ বাতিল করতে হবে। ৫. নতুন কোনো এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের অনুমোদন দেওয়া যাবে না। পুরোনো ও অকার্যকর গ্যাস বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বন্ধ করে সার কারখানায় গ্যাস সরবরাহ বাড়াতে হবে। শিল্প-কারখানার জ্বালানি হিসেবে গ্যাসের বদলে বিদ্যুৎ ব্যবহারকে উৎসাহিত করতে হবে। গ্যাসের লিকেজ ও চোরাই লাইন বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে এবং গ্যাসের অপচয় রোধ করার উদ্দেশ্যে সব খাতে মিটার প্রবর্তন করতে হবে। ৬. ২০৩০ সালের মধ্যে ৩০ শতাংশ, ২০৪১ সালের মধ্যে ৪০ শতাংশ এবং ২০৫০ সালের মধ্যে শতভাগ নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার নিশ্চিত করার বিষয়টি সকল নীতিমালা, খাতভিত্তিক পরিকল্পনা ও পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় অন্তর্ভূক্ত করতে হবে। জাতীয় বাজেটে বিদ্যুৎ খাতের কমপক্ষে ৪০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানির জন্য বরাদ্দ করতে হবে। সৌরবিদ্যুতের প্যানেল ও ইনভার্টারসহ অন্যান্য যন্ত্রাংশের ওপর থেকে ভ্যাট, আমদানি কর ও অন্যান্য কর শূন্যে নামিয়ে আনতে হবে। ৭. দেশের জ্বালানি ব্যবহার ও দূষণের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ উৎস হলো পরিবহন খাত। দ্রুততম সময়ের মধ্যে এ খাতের সবুজায়নের উদ্দেশ্যে বৈদ্যুতিক যানবাহনের (ইভি) আমদানি শুল্ক ও অন্যান্য কর ইঞ্জিনচালিত যানবাহনের তুলনায় কমপক্ষে ৭৫ শতাংশ কমাতে হবে। এছাড়া উন্নতমানের ব্যাটারির (লিথিয়াম আয়ন ফসফেট ইত্যাদি) আমদানি কর শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে হবে। ৮. জাতীয় গ্রিডের আধুনিকায়ন করে স্মার্ট গ্রিডে রূপান্তরের উদ্দেশ্যে স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি বিনিয়োগ পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। ‘সূর্যবাড়ি’ কর্মসূচির আওতায় পারিবারিক ছাদভিত্তিক ও কৃষিভিত্তিক ও সেচকাজের সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পে (৩ কিলোওয়াট পর্যন্ত) নির্মাণ ব্যয়ের কমপক্ষে ২৫ শতাংশ ভর্তুকি এবং ৭০ শতাংশ পর্যন্ত সহজ শর্তে স্বল্পসুদের ঋণের ব্যবস্থা করতে হবে। নারী, আদিবাসী, কৃষক, শ্রমজীবী, জেলে ও দরিদ্রদের জন্য ভর্তুকির পরিমাণ আরও ১০ শতাংশ বৃদ্ধি করতে হবে। ৯. জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো, যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর, সমাজসেবা অধিদপ্তর ও মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের উদ্যোগে বেকার তরুণ-তরুণী, বিশেষত নারী, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী, আদিবাসী ও শ্রমজীবীদের নবায়নযোগ্য জ্বালানিবিষয়ক স্বল্পমেয়াদি প্রশিক্ষণ ও সহজ ব্যাংকঋণ দেওয়ার এ খাতে নতুন ২০ লাখ কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে। ১০. ‘উন্নততর প্রযুক্তি’র নামে জ্বালানি হিসেবে অ্যামোনিয়া, কার্বন ক্যাপচার ও সংরক্ষণ (সিসিএস), তরল হাইড্রোজেন, পারমাণবিক বিদ্যুৎ ও বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎসহ সব ধরনের ব্যয়বহুল ও এখনো অপ্রমাণিত প্রযুক্তি ব্যবহারের পরিকল্পনা থেকে সরে আসতে হবে। নগরবর্জ্য কমানো, বর্জ্য শ্রেণিবিন্যাস করে পুনর্ব্যবহার ও জৈব সার উৎপাদনের মাধ্যমে ‘সার্কুলার সবুজ অর্থনীতি’ বাস্তবায়ন করতে হবে। ১১. জ্বালানিনীতি, নবায়নযোগ্য জ্বালানিনীতি এবং জ্বালানি ও বিদ্যুৎ মহাপরিকল্পনাসহ সকল প্রকার নীতি ও পরিকল্পনায় নারী, আদিবাসী, কৃষক, শ্রমজীবী, জেলে ও দরিদ্রদের অংশগ্রহণ ও অধিকারের সুস্পষ্ট উল্লেখ থাকতে হবে। নির্মিত জ্বালানি অবকাঠামো ও বিদ্যুৎকেন্দ্রের মুনাফা থেকে স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে হিস্যা দিতে হবে। এ ছাড়া, জ্বালানি ও বিদ্যুৎকেন্দ্র ব্যবস্থাপনায় স্থানীয় জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। ১২. কৃষিজমি সুরক্ষার উদ্দেশ্যে জ্বালানি ও বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে জমি অধিগ্রহণ নিষিদ্ধ করতে হবে। এর বদলে জমির দীর্ঘমেয়াদি ইজারা পদ্ধতি চালু করতে হবে যাতে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক প্রতিবছর বর্ধিত হারে ভাড়া গ্রহণ করতে পারে। এ ছাড়া একই জমির বিবিধ ব্যবহার নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে কৃষিবিদ্যুৎ, ভাসমান সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পে বিশেষ প্রণোদনা দিতে হবে।
এ সময় নাগরিকপক্ষ আশা প্রকাশ করেন, আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সকল রাজনৈতিক দল ও জোট জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের সবুজ রূপান্তরের মধ্য দিয়ে খাতটিকে সাধারণ মানুষের জন্য সাশ্রয়ী করা, প্রান্তিক জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা, জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলার লক্ষ্যে এই দাবিগুলো নির্বাচনি ইশতেহারে অন্তর্ভুক্ত করে বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দেবে।

