ঢাকা রবিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২৫

যাত্রী খরায় উদ্বোধনী যাত্রা বাতিল পিএস মাহসুদের

হাসিবুল ইসলাম, বরিশাল
প্রকাশিত: নভেম্বর ২৩, ২০২৫, ০২:৪৩ এএম

নবরূপে যাত্রা শুরু করেও যাত্রী খরায় ঢাকা থেকে বরিশালের উদ্দেশে আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু করতে পারেনি ২০০ বছরের পুরোনো প্যাডেলচালিত স্টিমার পিএস মাহসুদ। গত শুক্রবার ঢাকা থেকে যাত্রী নিয়ে বরিশাল আসার কথা ছিল। কিন্তু যাত্রীর অভাবে উদ্বোধনী যাত্রা করতে পারেনি বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশন (বিআইডব্লিউটিসি)-এর জাহাজটি। নতুন করে আগামী ২৮ নভেম্বর যাত্রার দিন নির্ধারণ করা হয়েছে।

শুক্রবারের যাত্রাকে ঘিরে দক্ষিণাঞ্চলের নৌপথে নতুন দ্বার উন্মোচনের কথা বলে আসছিল বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ করপোরেশন (বিআইডব্লিউটিসি)। কিন্তু সংস্থাটির এই প্রত্যাশা মোটেও পূরণ হয়নি, বরং যাত্রীসংকটে বড় ধরনের একটি ধাক্কা খেতে হয়েছে। লোকসানের আশঙ্কায় আনুষ্ঠানিকভাবে ফিরতি যাত্রার উদ্বোধনের দিনই ঘোষণা দিয়ে জাহাজটি বন্ধ রাখতে বাধ্য হয় বিআইডব্লিউটিসি।

এই জাহাজটি সার্ভিসে এলে যে যাত্রীসংকট দেখা দেবে এবং লোকসান গুনতে হবেÑএমন একটি প্রতিবেদন ইতিপূর্বে প্রকাশ করেছিল দৈনিক রূপালী বাংলাদেশ। গত ১১ অক্টোবর ‘ঐতিহ্য ধরে রাখতে গেলে গুনতে হবে লোকসান’Ñ এই শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদটিতে পদ্মা সেতুর প্রভাব এবং বরিশাল-ঢাকা নৌ রুটে বর্তমান বাস্তবতা তুলে ধরা হয়েছিল। এই বিষয়টি পর্যবেক্ষক মহলকে বিশেষ করে বরিশালের লঞ্চ মালিকদের ভাবিয়ে তুললেও বিআইডব্লিউটিসি কর্তৃপক্ষ পিএস মাহসুদকে নতুন রূপে যাত্রীসেবায় নিয়ে আসতে অনড় ছিল।

বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, ২০০ বছরের পুরোনো জাহাজ পিএস মাহসুদ প্রায় ১৯২৮ সালে যাত্রী পরিবহনে নামানো হয়। বরিশাল-ঝালকাঠি-পিরোজপুর হয়ে খুলনা পর্যন্ত প্রতিদিন এই স্টিমারটি যাত্রীসেবা দিতে গিয়ে বিভিন্ন সময়ে মাঝনদীতে বিকল হয়ে থাকার বহু উদাহরণ রয়েছে। ২০২৩ সালে আওয়ামী লীগের শাসনামলে বিআইডব্লিউটিসি আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়ে জাহাজটিতে যাত্রীসেবা বন্ধ করে দেয়। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নৌ উপদেষ্টা বরিশালের সন্তান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) সাখাওয়াত হোসেন এই ঐতিহ্য ধরে রাখার উদ্যোগ নেন। নতুনভাবে জাহাজটির যাত্রা শুরুর জন্য ৭০ লাখ টাকা ব্যয়ে সংস্কার করে জাহাজটির কাঠামো ও ঐতিহাসিক নকশা অক্ষুণœ রেখে নবরূপ দেওয়া হয়।

কয়েক মাস ধরে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে শুক্রবার আনুষ্ঠানিকভাবে নৌ রুটে এলেও যাত্রীসংকটে পিএস মাহসুদের যাত্রা বাতিল হওয়ার ঘটনা বিআইডব্লিউটিসি কর্মকর্তাদের হতাশ করে। তবে এতে বিষয়টি নিয়ে মোটেও বিচলিত নন বরিশাল-ঢাকা নৌ রুটের লঞ্চ মালিকেরা। একাধিক লঞ্চ মালিক রূপালী বাংলাদেশকে জানান, ২০২২ সালের ২৫ জুন পদ্মা সেতু চালুর পর থেকে লঞ্চ মালিকেরা কেউ স্বস্তিতে নেই। যাত্রীসংকটে রোটেশন করে প্রতিদিন ২-৩টি লঞ্চ চালালে তাতেও লোকসান গুনতে হচ্ছে। বরিশাল-ঢাকা নৌরুটের পূর্বের সেই জৌলুস হ্রাস পাওয়ায় অনেক মালিক লঞ্চ ভাঙারি হিসেবে বিক্রি করে দিয়েছেন।

এমন দুরবস্থার মধ্যে বিআইডব্লিউটিসি ২০০ বছরের ঐতিহ্য ধরে রাখতে প্যাডেলচালিত নৌযান পিএস মাহসুদ বরিশাল-ঢাকা নৌ রুটে নিয়ে আসার ঘোষণা দেয়। জাহাজটি সপ্তাহে দুই দিন শুক্র-শনিবার চালানোর সিদ্ধান্ত নেয় কর্তৃপক্ষ। গতকাল ফিরতি যাত্রার উদ্বোধনী দিনে মাত্র ৬ জন যাত্রী টিকিট বুকিং করলেও পরবর্তী সময়ে সেগুলো প্রত্যাহার করে নেন। ফলে যাত্রা শুরুর দিনে একজন যাত্রীও পায়নি পিএস মাহসুদ, যা বিআইডব্লিউটিসির কর্মকর্তাদের কাছে হতাশাজনক বলে জানা গেছে।  

জাহাজটিতে যাত্রী না পাওয়ার নেপথ্য কারণ হিসেবে অনেকে অতিরিক্ত ভাড়ার অভিযোগ করেছেন। সূত্র নিশ্চিত করেছে, ঐতিহ্যবাহী জাহাজটিতে ঢাকা-বরিশাল রুটে প্রথম শ্রেণির (এসি কেবিন) যাত্রী ভাড়া ৬ হাজার ও নন-এসি ৪ হাজার টাকা। সাধারণ চেয়ার যাত্রীদের ভাড়া ২ হাজার ৬০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। অথচ একই ধরনের সুযোগ-সুবিধাসম্পন্ন বেসরকারি লঞ্চে প্রথম শ্রেণির কেবিনভাড়া ২ হাজার টাকা, সিঙ্গেল কেবিন এক হাজার টাকা এবং চেয়ার ৭০০ টাকা। লঞ্চের তুলনায় ভাড়া বেশি হওয়ায় যাত্রীদের স্টিমারমুখী হওয়ার সম্ভাবনা কম বলে মনে করছে অভিজ্ঞ মহল।

যাত্রীসংকটে যাত্রা বাতিলের পরে এমন ভাড়া নির্ধারণের বিষয়টি অস্বীকার করেছে বিআইডব্লিউটিসি। সংস্থাটির মহাব্যবস্থাপক (যাত্রী ও প্রশাসন) গোপাল চন্দ্র মজুমদার সাংবাদিকদের জানান, এখন পর্যন্ত কোনো ভাড়া নির্ধারণ করা হয়নি। ভাড়ার হার কোথা থেকে এলো, তা তিনি জানেন না। তিনি দাবি করেন, ভাড়া নির্ধারণের জন্য নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি কমিটি রয়েছে, এতে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তারা সদস্য আছেন। তারা শিগগিরই আনুষ্ঠানিক সভা করে স্টিমার পিএস মাহসুদের ভাড়া নির্ধারণ করবেন।

এই কর্মকর্তা আরও জানান, শুক্রবার উদ্বোধনী যাত্রায় ঢাকা থেকে বরিশাল যেতে ৬ জন বুকিং দিয়েছিলেন। যাত্রা বাতিলের সিদ্ধান্তের আগেই তারা বুকিং প্রত্যাহার করেন। এ সপ্তাহের মধ্যে ভাড়া নির্ধারণ করে আগামী শুক্রবার পিএস মাহসুদের যাত্রা শুরু হবে।

নৌপথে যাত্রীসংকটের এই চ্যালেঞ্জিং সময়ে ব্যক্তিমালিকানাধীন বিলাসবহুল লঞ্চগুলোর সাথে সরকারি স্টিমার পিএস মাহসুদ সব কিছু সামাল দিয়ে সপ্তাহে দুদিনও টিকে থাকতে পারবে কী না তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে যোগাযোগ করা হলেও কোনো মন্তব্য করতে চাননি বিআইডব্লিউটিসি মহাব্যবস্থাপক (যাত্রী ও প্রশাসন) গোপাল চন্দ্র মজুমদার।