ঢাকা মঙ্গলবার, ১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

ময়লার বিনিময়ে খাবার

অন্যরকম ডেস্ক
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৬, ২০২৫, ০১:৩১ এএম

ভারতের কিছু শহরে এক নতুন ধরনের সামাজিক উদ্যোগ ছড়িয়ে পড়েছে। যেখানে গারবেজ ক্যাফে নামক রেস্টুরেন্টে দেখা যাচ্ছে খাবারের মূল্য টাকায় নয়, প্লাস্টিক বর্জ্যে পরিশোধ করতে হয়। বিবিসির তথ্যমতে, এই অভিনব উদ্যোগের লক্ষ্য একদিকে অভাবীদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করা, অন্যদিকে শহরের প্লাস্টিক দূষণ কমানো। ছত্তিশগড়ের আম্বিকাপুর শহরে এই উদ্যোগ প্রথম শুরু হয়। প্রথম গারবেজ ক্যাফের দরজায় ঢুকলেই ঘ্রাণে ভেসে আসে গরম সমুচা ও রান্না করা খাবারের সুখবর। কাঠের বেঞ্চে বসে কেউ আলাপ করছেন, কেউ শান্তভাবে ভাত-ডাল-তরকারি-রুটি আর সালাদ উপভোগ করছেন। খাবার কেনার জন্য এখানে কোনো টাকা লাগে না। তবে, প্রতিস্থাপন হিসাবে জমা দিতে হয় প্লাস্টিক বর্জ্য।

পুরোনো প্লাস্টিকের ব্যাগ, বোতল বা খাবারের মোড়কই এখানের মূল্য। উদাহরণস্বরূপ, এক কেজি প্লাস্টিক জমা দিলে মিলছে পূর্ণাঙ্গ দুপুরের খাবার, আর আধা কেজি দিলে সকালের নাস্তায় সমুচা বা বড়া। ক্যাফের দায়িত্বে আছেন বিনোদ কুমার পাটেল। স্থানীয় বাসিন্দাদের জন্য এটি বিপ্লবের মতো কাজ করেছে। রাশমি ম-ল প্রতিদিন প্লাস্টিক সংগ্রহে বের হন। আগে তিনি প্রতি কেজি প্লাস্টিক বিক্রি করতেন মাত্র ১০ রুপিতে। এখন সেই প্লাস্টিক দিয়ে তিনি পরিবারের জন্য খাবার আনতে পারেন। রাশমি বলেন, ‘এই ক্যাফে আমাদের জীবনে বড় পরিবর্তন এনেছে। আমরা প্লাস্টিক জমা দিয়ে খাবারের নিশ্চয়তা পাচ্ছি।’ 

ক্যাফ চালুর পর প্রতিদিন গড়ে ২০ জন মানুষ এখানে খাবার পান। পাশাপাশি শহরের প্লাস্টিক বর্জ্যও উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে। শহরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় দায়িত্বে থাকা ঋতেশ সাইনি জানান, ২০১৯ সাল থেকে এই ক্যাফে প্রায় ২৩ টন প্লাস্টিক সংগ্রহ করেছে। ২০১৯ সালে শহরে বছরে যেখানে ৫.৪ টন প্লাস্টিক ডাম্পিং গ্রাউন্ডে যেত, ২০২৪ সালের পর তা নেমে এসেছে ২ টনে। আম্বিকাপুর প্রতিদিন প্রায় ৪৫ টন কঠিন বর্জ্য উৎপাদন করে। আগে শহরের বাইরে ১৬ একর জায়গায় বিশাল ডাম্পিং গ্রাউন্ড ছিল। ২০১৬ সালে সেই ডাম্পিং গ্রাউন্ড আধুনিকায়ন করা হয়।

সংগ্রহ করা প্লাস্টিক পুনর্ব্যবহারে ব্যবহার করা হয় রাস্তা, সিমেন্ট শিল্প বা রিসাইক্লারদের কাছে বিক্রি করা হয়। ভেজা বর্জ্য কম্পোস্টে পরিণত হয়। সামান্য বর্জ্য সিমেন্ট কারখানায় জ্বালানি হিসেবে পাঠানো হয়। এই উদ্যোগের কারণে আম্বিকাপুর পরিচিতি পেয়েছে ‘জিরো ল্যান্ডফিল সিটি’ হিসেবে। শহরে এখন ২০টি স্থানীয় বর্জ্য সংগ্রহকেন্দ্র রয়েছে। প্রতিদিন ৩০-৩৫ জন মানুষ এই কেন্দ্রে প্লাস্টিক জমা দেন।

এখানে কাজ করছেন ৪৮০ জন নারী, যাদের বলা হয় ‘স্বচ্ছতা দিদি’। তারা ঘরে ঘরে গিয়ে বর্জ্য সংগ্রহ করেন এবং মাসে গড়ে ৮-১০ হাজার রুপি উপার্জন করেন। এই ডোর-টু-ডোর সংগ্রহ পদ্ধতি এতটাই সফল হয়েছে যে, ছত্তিশগড় রাজ্যের ৪৮টি ওয়ার্ডে এটি চালু করা হয়েছে। সরকার বলছে, এর লক্ষ্য শুধুমাত্র আম্বিকাপুর নয়, বরং আরও মাঝারি শহরের জন্য কার্যকরী, পরিবেশবান্ধব ও আর্থিকভাবে টেকসই মডেল তৈরি করা।

ভারতের অন্যান্য জায়গাতেও অনুরূপ উদ্যোগ চালু হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের শিলিগুড়িতে ২০১৯ সালে প্লাস্টিকের বিনিময়ে খাবারের প্রকল্প চালু হয়েছে। তেলেঙ্গানার মুলুগুতে এক কেজি প্লাস্টিক জমা দিলে সমান ওজনের চাল দেওয়া হয়। কর্ণাটকের মাইসুরুতে ২০২৪ সালে চালু হয়েছে ব্যবস্থা, যেখানে ৫০০ গ্রাম প্লাস্টিক দিলে ফ্রি ব্রেকফাস্ট, আর ১ কেজি দিলে পূর্ণাঙ্গ মিল পাওয়া যায়। উত্তর প্রদেশে এমনই উদ্যোগে নারীদের জন্য স্যানিটারি ন্যাপকিনও সরবরাহ করা হচ্ছে। এসব উদ্যোগ দেখাচ্ছে, কীভাবে সামাজিক সমস্যার সঙ্গে পরিবেশের দায়ও মেলানো সম্ভব। প্লাস্টিক দূষণ কমানো এবং ক্ষুধার সমস্যা সমাধান, দুই উদ্দেশ্যই একসঙ্গে বাস্তবায়ন করা যায়। ভারতের ‘গারবেজ ক্যাফে’ ঠিক তেমনই একটি উদাহরণ, যেখানে মানুষের উপকার, পরিবেশ সচেতনতা এবং টেকসই জীবনধারা একসঙ্গে চলে।