ঢাকা সোমবার, ২১ জুলাই, ২০২৫

স্বাস্থ্যসেবায় জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা হোক

রূপালী ডেস্ক
প্রকাশিত: জুলাই ২১, ২০২৫, ০৪:২৮ এএম

স্বাস্থ্যসেবা মানুষের অন্যতম মৌলিক অধিকার। কিন্তু বাংলাদেশে সেই অধিকার প্রতিনিয়ত উপেক্ষিত হচ্ছে, অবহেলিত হচ্ছে। বছরের পর বছর ধরে জনস্বাস্থ্য খাতের যে দুরবস্থা, দুর্নীতি ও অযোগ্যতার চিত্র আমরা দেখে আসছি, তা এখন আর গোপন কিছু নয়। প্রশ্ন উঠছে এভাবে আর কতকাল চলবে?

রূপালী বাংলাদেশের বিশেষ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের ভয়াবহ চিত্র। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ওষুধশিল্পে বিপ্লব ঘটিয়েছেন ফার্মাসিস্টরা। দেশ এখন বছরে ৯৮ শতাংশ দেশীয় চাহিদা মিটিয়ে বিশ্বের ১৬০টির বেশি দেশে ওষুধ রপ্তানি করছে। অথচ দেশের রোগীরা সেই দক্ষতার সুফল পাচ্ছেন না। কারণ চিকিৎসাব্যবস্থায় ফার্মাসিস্টদের যুক্ত করা হয়নি। সারা দেশে ৬৫৪টি সরকারি হাসপাতাল রয়েছে। যেখানে শয্যা সংখ্যা ৫১ হাজার ৩১৬টি। কিন্তু এসব হাসপাতালে একজনও গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট নেই। অথচ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী, প্রতি ২৫ শয্যার জন্য একজন করে গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট থাকা বাধ্যতামূলক।

কিন্তু বাস্তবে সেই নির্দেশনা উপেক্ষিতই থেকে গেছে। ফলে দেশের ওষুধ ব্যবস্থাপনায় দেখা দিয়েছে মারাত্মক সংকট, যা রোগীর সুরক্ষা ও চিকিৎসা ব্যবস্থার মানকে প্রশ্নবিদ্ধ করছে। নির্ধারিত ফার্মাসিস্ট না থাকায় হাসপাতালগুলোয় ওষুধ বিতরণ কার্যক্রম পরিচালনা করছেন নার্স বা ওয়ার্ডবয়রা। এতে করে ওষুধের ভুল প্রয়োগে রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত হচ্ছে। শুধু তাই নয়, দক্ষতার অভাবে অপ্রয়োজনীয়ভাবে ওয়ার্ডবয়রা নিজেদের ফায়দার জন্য মজুত করছে জরুরি বিভিন্ন ওষুধ। দিনের পর দিন এগুলো মজুত রাখার কারণে মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে বা নষ্ট হয়ে যাওয়ার মতো ঘটনাও ঘটছে। নষ্ট হচ্ছে রাষ্ট্রের কোটি কোটি টাকা। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারি হাসপাতালগুলোতে বরাদ্দকৃত ওষুধের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় ফার্মাসিস্ট পদ তৈরি এখন সময়ের দাবি। 

সংশ্লিষ্টদের দাবি, সরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসকের অভাব, শয্যাসংকট বা ওষুধ ঘাটতির মতো সমস্যা প্রায়ই আলোচনায় আসে। কিন্তু আরেকটি নীরব সংকট দীর্ঘদিন ধরেই উপেক্ষিত, এটি হলো ফার্মাসিস্টের অনুপস্থিতি। প্রায় প্রতিটি জেলা-উপজেলা হাসপাতালেই রোগীদের ওষুধ দেওয়া হয় কোনো প্রশিক্ষিত ফার্মাসিস্ট ছাড়াই। অথচ আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থায় ফার্মাসিস্ট ছাড়া একটি হাসপাতাল কল্পনাও করা যায় না।

বর্তমানে দেশের অধিকাংশ সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে একজন প্রকৃত ফার্মাসিস্ট পাওয়া ভাগ্যের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ওষুধ বিতরণের মতো একটি সংবেদনশীল দায়িত্ব পালন করছেন নার্স কিংবা ওয়ার্ডবয়রা, যাদের এ বিষয়ে কোনো প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ নেই। ফলে সঠিক ডোজ, উপযুক্ত ওষুধ ও ওষুধের পারস্পরিক ক্রিয়া সম্পর্কে না জানার কারণে রোগীরা অনেক সময় ভয়ানক ঝুঁকির মুখে পড়ছেন।  প্রায়ই দেখা যায়, ভুল ওষুধ প্রয়োগের কারণে শিশুসহ রোগীর মৃত্যু হয়েছে, অথচ দায় নিতে কেউ প্রস্তুত নয়।

এই সমস্যার পাশাপাশি রয়েছে চিকিৎসক সংকট। অনেক উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়মিত চিকিৎসক অনুপস্থিত, আবার কোনো কোনো জায়গায় একজন চিকিৎসককেই পুরো হাসপাতালের দায়িত্ব সামলাতে হয়। তাতে করে প্রতিদিন শত শত রোগীকে ঠিকভাবে দেখা তো সম্ভব নয়ই, বরং এতে রোগীর সঠিক রোগ নির্ণয়ও বাধাগ্রস্ত হয়।
আরেকটি বড় সমস্যা হলো বেড সংকট। রাজধানীর বিভিন্ন সরকারি হাসপাতাল তো বটেই, জেলা-উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোতেও শয্যার চেয়ে রোগীর সংখ্যা বহুগুণ বেশি। ফলে রোগীরা মেঝেতে, বারান্দায়, কখনো কখনো হাসপাতালের বাইরে রাস্তায় চিকিৎসা নিতে বাধ্য হন। স্বজনের কাঁধে স্যালাইন ঝুলিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেও সেবা মেলে না অনেক সময়।

সরকার প্রতিবছর বাজেট ঘোষণায় স্বাস্থ্য খাতকে গুরুত্ব দেওয়ার কথা বললেও বাস্তবতায় তার প্রতিফলন খুবই দুর্বল। চিকিৎসাব্যবস্থাকে আধুনিকায়ন করতে হলে শুধু বিল্ডিং নির্মাণ করলেই হবে না, প্রয়োজন দক্ষ জনবল, সুশৃঙ্খল প্রশাসন ও কার্যকর তদারকি। আমরা মনে করি, চিকিৎসার সঙ্গে মানুষের জীবন জড়িত। আমাদের স্বাস্থ্য খাতে চলমান যে সমস্যা রয়েছে তার সমাধান অসম্ভব নয়। প্রয়োজন সদিচ্ছা, সুশাসন, কার্যকর পদক্ষেপ এবং জনস্বাস্থ্যব্যবস্থাকে কেন্দ্রীভূত করে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ।  আমাদের প্রত্যাশা থাকবে, সরকার স্বাস্থ্যসেবায় দক্ষতা অনুযায়ী লোকবল নিয়োগ ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করে স্বাস্থ্য খাতকে আস্থার ও নির্ভরতার জায়গায় নিয়ে যাবে।