কোটা সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে গত বছরের এই দিনে সিলেট জুড়ে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছিল। বিশেষ করে পুলিশের গুলিতে নিহত সাংবাদিক এটিএম তুরাবের ময়না তদন্ত, জানাজা ও দাফনকে কেন্দ্র করে ছিল উত্তেজনা। বিক্ষোভ কর্মসূচির প্রস্তুতি ছিল, তবে শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। কারফিউ, সেনা মোতায়েন, ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন থাকার ফলে সাধারণ মানুষের মাঝে এক ধরনের আতঙ্ক কাজ করছিল। তা সত্ত্বেও বিভিন্ন সড়কে ব্যারিকেড দিয়ে বিক্ষিপ্তভাবে কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি পালন করে শিক্ষার্থীরা।
এদিকে, রাতে নগরের হাউজিং এস্টেট এলাকা থাকা জামায়াতের কেন্দ্রীয় নেতাসহ পাঁচ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। কারফিউ থাকলেও পর্যাপ্ত দোকানপাট খোলা ছিল। দুপুর ১২টা থেকে বেলা দুইটা পর্যন্ত কারফিউ শিথিল করা হলে নগরের বিভিন্ন বাজারে লোক সমাগম বাড়ে। তবে সকাল থেকে সিলেটে কোন বিক্ষোভ কর্মসূচি ছিল না।
আগের দিন (১৯ জুলাই) পুলিশের গুলিতে নিহত সাংবাদিক এটিএম তুরাবের মরদেহ এইদিন সকালে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ময়না তদন্ত করা হয়। ময়না তদন্তের আগে সুরতহাল প্রতিবেদনে পুলিশ গুলির ঘটনা এড়িয়ে যায়। এ নিয়ে ওসমানী মেডিকেল হাসপাতালে সাংবাদিকদের সঙ্গে পুলিশের উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় হয়। পরে, গুলির বিষয়টি নিশ্চিত করে ময়না তদন্ত করা হয়। সাংবাদিক তুরাবের শরীরে ৯৮টি ছররা গুলির চিহ্ন থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করে ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগের চিকিৎসক। ময়না তদন্ত শেষে তুরাবের মরদেহ বেলা দুইটায় নগরের মানিকপীরটিলা কবরস্থান সংলগ্ন প্রাঙ্গণে জানাজার জন্য নিয়ে আসা হলে এক হৃদয় বিদারক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। সহকর্মীদের উপস্থিতিতে ভারী হয়ে উঠে পরিবেশ। জানাজায় সিলেটের কয়েক শতাধিক সংবাদকর্মী অংশ নেন। এই সময় কারফিউ না থাকায় জানাজায় এসেছিলেন স্থানীয় রাজনৈতিক দলের নেতারা। জানাজার আগে ও পরে মানিকপীর রোড ও কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে দুইটি পৃথক বিক্ষোভ কর্মসূচির প্রস্তুতি চলছিল। একটি ছিল সাধারণ মানুষের, অপরটি সিলেটের সর্বস্তরের সাংবাদিকদের। তবে, প্রশাসনের কড়াকড়ি ও জানাজা শেষ হতেই কারফিউ পুনরায় শুরু হওয়ায় সাংবাদিকরা সেটি স্থগিত করেন। পরে, তুরাবের মরদেহ নেওয়া হয় নিজ প্রতিষ্ঠান সিলেট প্রেসক্লাব প্রাঙ্গণে। সেখানে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে উপস্থিত সংক্ষিপ্ত সমাবেশ ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। তারপর দাফনের জন্য গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যায় তার পরিবারের সদস্য ও সহকর্মীরা। মরদেহ নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে খবর পাওয়া যায় তার গ্রামের বাড়ি বিয়ানীবাজার পৌরসভায় মাইকিংয়ে পুলিশের আপত্তির বিষয়টি। পরে, ঊর্ধ্বতন মহলের হস্তক্ষেপে সেটি সমাধান হয়। বিকেলে পৌরসভার ফতেহপুর গ্রামে আবারও জানাজা শেষে তাকে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।
দুপুর ২টা থেকে আবারও কারফিউ শুরু হলে প্রথমবারের মতো সেনাবাহিনীর সদস্যদের টহল দিতে দেখা যায়। পুলিশও গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় টহল জোরদার করে। এর মধ্যে সিলেট-জকিগঞ্জ সড়কের কুচাই এলাকায় সাধারণ শিক্ষার্থীরা পিকেটিং করছিল। তারা সাধারণ শিক্ষার্থী পরিচয়ে কমপ্লিট শাটডাউন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছিল। বিকেলে সিলেট নগরের বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষোভের জন্য লোকসমাগমের চেষ্টা থাকলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ও সেনাবাহিনীর টহলের কারণে তা সফল হয়নি।
এই রাতে নগরের বিভিন্ন জায়গায় চিরুনি অভিযান শুরু করে পুলিশ। বিভিন্ন বাসায় ও মেসে অভিযান চালিয়ে আন্দোলনে জড়িত শিক্ষার্থীদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা করে। রাতে সিলেট নগরের হাউজিং এস্টেট এলাকার একটি বাসায় অভিযান চালিয়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের, সিলেট মহানগর আমির ফখরুল ইসলামসহ অন্তত পাঁচ জন নেতাকে আটক করে পুলিশ। সন্ধ্যার পর থেকে সিলেট নগরে ভুতুড়ে ও আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি হয়।