বুধবার, ২৩ জুলাই, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


জুয়েল হাসান

প্রকাশিত: জুলাই ২৩, ২০২৫, ০১:৩৫ এএম

বিমান বিধ্বস্ত! মানবতার অশ্রু ও প্রযুক্তির প্রশ্ন

জুয়েল হাসান

প্রকাশিত: জুলাই ২৩, ২০২৫, ০১:৩৫ এএম

বিমান বিধ্বস্ত! মানবতার অশ্রু ও প্রযুক্তির প্রশ্ন

নদীর ওপারে ভোরের প্রথম সূর্যটা লাজুক শিশুর মতো উঁকি দিচ্ছিল। পাখিরা ডানায় ভর করে গাইছিল দিনের জাগরণ সংগীত। দূর থেকে মাইকিং শোনা যাচ্ছিল, কারো শীতলপ্রভা মৃত্যু সংবাদ। হঠাৎ একটি শব্দ, অদৃশ্য আঁধার যেন ছায়া ফেলে দেয় ওই নদীতীরে। ঘুম ভাঙে শহরের, উদ্বেগে জাগে গ্রাম। খবর আসে, বিমান বিধ্বস্ত। যাত্রীদের কেউ আর ফিরবে না। কেউ পুড়ে অঙ্গার, কেউ নিখোঁজ। শূন্যতা যেন আকাশ থেকে নামিয়ে আনা হয় মানবজাতির বুকে। এ যেন গল্প নয়, এ এক করুণ বাস্তবতা, যেটি লিখে যায় মৃত্যুর নীলচিঠি।

হঠাৎ আকাশ ফাটিয়ে নেমে এলো বিভীষিকা-গত সোমবার, বেলা ১১টার দিকে, রাজধানীর উত্তরার অন্যতম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের আকাশচুম্বী নীরবতায় ঘটে যায় এক হৃদয়বিদারক ঘটনা। বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একটি এফ-৭ বিজিআই প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান, যেটি কুর্মিটোলা বিমান ঘাঁটি থেকে উড্ডয়ন করেছিল, যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে আচমকা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বিধ্বস্ত হয় হায়দার হল ভবনের ওপর। পাইলট ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মো. তৌকির ইসলাম শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত চেষ্টা করেছিলেন জনবহুল এলাকা এড়িয়ে নিরাপদে অবতরণ করতে। কিন্তু সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। আগুন ছড়িয়ে পড়ে চারপাশে, বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ মুহূর্তেই রূপ নেয় এক বিভীষিকাময় অগ্নিকু-ে। ঘটনায় নিহত হন ২৫ জন, যাদের মধ্যে রয়েছেন পাইলটসহ শিক্ষার্থী, শিক্ষক এবং কর্মচারী। আহত হয়েছেন অন্তত ১৭১ জন, যাদের মধ্যে প্রায় ১৬০ জন অগ্নিদগ্ধ, এবং অধিকাংশের অবস্থা আশঙ্কাজনক। ক্ষতিগ্রস্তদের জরুরি ভিত্তিতে পাঠানো হয় ঢাকা মেডিকেল, সিএমএইচ, বার্ন ইউনিট ও কুয়েত মৈত্রী হাসপাতালসহ একাধিক হাসপাতালে। এ যেন এক দুঃস্বপ্ন, যেটি বাস্তবে ফিরে ফিরে আসে, পুড়ে যাওয়া খাতা, কাচ ভাঙার শব্দ, শিশুর কান্না আর বেঁচে থাকা কিছু অভিভাবকের আর্তনাদ। যে শিক্ষাঙ্গনে নির্মিত হওয়ার কথা ছিল ভবিষ্যৎ, সেখানে ছড়িয়ে পড়ে মৃত্যু আর শোকের ছায়া। এই ঘটনায় শুধু একটি অভাবনীয় বিপর্যয়ই ঘটেনি, বরং শিক্ষার ক্ষেত্রেই রচিত হলো এক অন্ধকার অধ্যায়, ছাত্রছাত্রীদের হাসি ও ভবিষ্যতের আলো দ্রুত ম্লান হয়ে গেল আগুনের ছাইয়ের আবৃত স্মৃতিতে।

বিশ্বায়নের এ যুগে বিমান শুধু একটা যান নয়, এটি এক বিস্ময়। মানুষ যেখানে ঘোড়া কিংবা পালকি ব্যবহার করত, এখন সে পাখির মতো উড়ে যায় মহাদেশ পেরিয়ে। মাটির মানুষ এখন আকাশের মানুষ। কয়েক ঘণ্টায় পৌঁছে যায় দূরতম গন্তব্যে। উনিশ শতকের রাইট ভাইদের স্বপ্ন এখন কোটি কোটি যাত্রীর দৈনন্দিন প্রয়োজন। আধুনিক বোয়িং, এয়ারবাস, কিংবা বাংলাদেশের নিজস্ব ‘ড্যাশ-৮’ মডেলের বিমান আজকের প্রযুক্তির আশ্চর্য উদ্ভাবন। কিন্তু প্রশ্ন জাগে, এই বিস্ময়কর প্রযুক্তিই যখন বিপর্যয়ে রূপ নেয়?

বিমান বিধ্বস্ত, দুর্ভাগ্যের এক অন্ধকার অধ্যায়-বিমান বিধ্বস্ত মানে শুধু একটি যান্ত্রিক দুর্ঘটনা নয়। এটি একটি পরিবারের নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া, শত শত স্বপ্নের মুহূর্তেই থেমে যাওয়া, জীবনের চলার পথে হঠাৎ অন্ধকার নামা। প্রতিবার বিধ্বস্তের ঘটনায় চোখে ভেসে ওঠে কান্নার রোল, পুড়ে যাওয়া জীবাশ্ম, ধোঁয়ার কু-লী আর কালো বাক্সের অভিশপ্ত গল্প। বাংলাদেশে যেমন- ২০১৮ সালের ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের নেপালের কাঠমান্ডুতে বিধ্বস্ত হওয়া বিমানটি আজও সবার হৃদয়ে চিরস্থায়ী দাগ রেখে গেছে। ৭১ জন আরোহীর মধ্যে ৫১ জন প্রাণ হারান। কেউ ছিল ডাক্তার, কেউ ছিল ছাত্র, কেউ ছিল বাবা-মা, বিধ্বস্ত আকাশ সেসব প্রশ্ন রাখে না।

কারণের গভীর বিশ্লেষণ-দায় কার? বিমান বিধ্বস্তের কারণ বিভিন্ন রকম হতে পারে যান্ত্রিক ত্রুটি, বৈরি আবহাওয়া, পাইলটের ভুল সিদ্ধান্ত, এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলের বিভ্রাট, অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি কিংবা রক্ষণাবেক্ষণের ঘাটতি। অধিকাংশ সময় তদন্তে দেখা যায়, বিধ্বস্ত হওয়ার আগে থেকেই কিছু অস্বাভাবিকতা লক্ষ্য করা গিয়েছিল। কিন্তু সে সংকেত উপেক্ষা করা হয়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পাইলট বারবার চেষ্টা করেও নামতে পারেন না, আর শেষ অবধি বিমানটি আছড়ে পড়ে পাহাড়ে, নদীতে, কিংবা রানওয়ের পাশের জলাভূমিতে। ঘটনার কেন্দ্রবিন্দুতে দাঁড়িয়ে এখন আমরা একটি মৌলিক প্রশ্নের মুখোমুখি, এটা কি প্রযুক্তির অপরিমেয় ক্ষমতার নিদর্শন, নাকি মানুষের হাতেই সৃষ্ট এক ভয়ঙ্কর নিয়ন্ত্রণহীন বিস্ফোরণ? আধুনিক প্রযুক্তি যেমন আকাশ ছোঁয়ার স্বপ্ন দেখায়, তেমনি একটিমাত্র ত্রুটি কিংবা অবহেলায় সেই স্বপ্ন মুহূর্তেই দুঃস্বপ্নে রূপ নেয়। সেই মুহূর্তটি যদি হয় আকাশে উড়ন্ত এক বিমানের ভেতরে, তবে ভয়াবহতার মাত্রা কল্পনাতীত।

উত্তরাতে আছড়ে পড়া বস্তুটি যদি সামরিক প্রযুক্তির অংশ হয়, ড্রোন, যুদ্ধবিমান বা বিশেষ গোয়েন্দা যন্ত্র, তবে প্রশ্ন উঠবে, এত নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও কীভাবে এটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে জনবহুল এলাকায় এসে পড়ল? যদি এটি সামরিক মহড়ার কোনো গোপন অংশ হয়ে থাকে, তবে সাধারণ জনগণের জান-মালের সুরক্ষা কোথায়? আবার, যদি এটি একটি অসফল পরীক্ষামূলক প্রযুক্তি হয়, তাহলে তার পেছনে থাকা দায়িত্বশীল সংস্থাগুলোর ওপরও তীব্র প্রশ্নবাণ নিক্ষিপ্ত হওয়া স্বাভাবিক। কারণ, প্রযুক্তি শুধুই বিস্ময় নয়, নিয়ন্ত্রণের ঘাটতি থাকলে সেটি হয়ে উঠতে পারে সর্বনাশের কারণ। মানবসভ্যতা বহুবার অভিজ্ঞতা থেকে শিখেছে যে, প্রযুক্তির অন্ধ বিস্তার বিপর্যয় ডেকে আনে, যদি তাতে সতর্কতা ও মানবিক দায়িত্ববোধের ভারসাম্য না থাকে। এই ঘটনার মাধ্যমে আমরা যেন এক প্রযুক্তিগত আয়নায় নিজেদের প্রতিচ্ছবি দেখতে পাচ্ছি, যেখানে উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে ঝুঁকিও বেড়েছে। কাজেই সময় এসেছে প্রশ্ন তোলার, এবং উত্তর খোঁজার। এটি কি কেবল একটি দুর্ঘটনা? নাকি আমরা কোনো বড় ধরনের নিরাপত্তাজনিত ভুলের মধ্যে ঢুকে পড়েছি? প্রযুক্তি তখনই কল্যাণকর, যখন তা নিয়ন্ত্রিত, স্বচ্ছ এবং জবাবদিহিতার আওতায় থাকে। না হলে একদিন এই বিস্ময়ই হয়ে উঠতে পারে ভবিষ্যতের আতঙ্ক।

যাত্রীদের জীবনের মূল্য কতটুকু? প্রতিটি যাত্রী শুধু একক ব্যক্তি নয়, একেকটি পরিবার, ভবিষ্যৎ, ভালোবাসার কেন্দ্রবিন্দু। যাদের অনুপস্থিতি বদলে দেয় ইতিহাস, বদলে দেয় ব্যক্তিজীবনের মানচিত্র। একজন বাবার মৃত্যুর মানে সন্তানের শিক্ষাজীবন থেমে যাওয়া। একজন চিকিৎসকের মৃত্যুর মানে হাজারো রোগীর চিকিৎসা অনিশ্চিত। এমনকি একজন পাইলটের ক্ষতি মানে নিরাপত্তা হারানোর ঝুঁকি। বিমান দুর্ঘটনা যেন মৃত্যু নয় মৃত্যুর আগে হাজারো প্রশ্ন রেখে যাওয়া। এদের পরিবারগুলো বছরের পর বছর ক্ষতিপূরণ, বিচার, স্বীকৃতির জন্য অপেক্ষা করে অক্লান্তভাবে।
মানসিক ট্রমা-বেঁচে ফেরা যাত্রীদের জীবন- যারা অলৌকিকভাবে বেঁচে যান, তাদের জীবন আর আগের মতো থাকে না। ধোঁয়ার গন্ধ, বিকট আওয়াজ, মাটিতে পড়ে থাকা শরীর, এসব স্মৃতি রাত জাগায়, ঘুম কেড়ে নেয়, ভেঙে দেয় আত্মবিশ্বাস। অনেকেই জীবনের দিকে ফিরে তাকান না, চলে যান একান্ত নিঃসঙ্গতার খোপে। বিমানকে মনে হয় শত্রু, আকাশকে মনে হয় মৃত্যুর ঠিকানা।

বিমান বিধ্বস্তের আন্তর্জাতিক চিত্র ও শিক্ষা-বিশ্বে একাধিক বিধ্বস্ত ঘটনা মানুষের মনে ভয় ও সচেতনতা উভয়ই এনেছে: মালয়েশিয়া এয়ার লাইনস ফ্লাইট ৩৭০:২০১৪ সালে পুরো বিমান নিখোঁজ, আজও সন্ধান মেলেনি। বিশ্ববাসীর কাছে এটি এক রহস্য। এয়ার ইন্ডিয়া এক্সপ্রেস (২০২০) : ভারতের কোঝিকোড়ে রানওয়ে ছাড়িয়ে গিয়ে বিমানটি বিধ্বস্ত হয়। জার্মানউয়িংস (২০১৫) : যেখানে পাইলট ইচ্ছাকৃতভাবে বিমানটি পাহাড়ে ধাক্কা দিয়ে আত্মহত্যা করেন। এই ঘটনাগুলো আমাদের শিখিয়েছে- বিমানের প্রযুক্তি যত আধুনিকই হোক, মানবিক, মনস্তাত্ত্বিক ও নীতিগত নিরাপত্তার অভাব থাকলে বিপর্যয় অনিবার্য।

নিরাপত্তা নিশ্চিতে করণীয়, বিমানের নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ নিশ্চিত করা, পাইলট ও কর্মীদের মানসিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা,  আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার-এআই, অটো স্টাবলাইজার, অ্যাডভান্স কমিউনিকেশন সিসটেম, বিচার ও জবাবদিহিতার আওতায় আনা, বিশ্বমানের তদন্ত দল গঠন ও দুর্ঘটনার পর ট্রান্সপারেন্ট রিপোর্ট প্রকাশ, যাত্রীদের বিমানে ওঠার আগে সচেতনতা বৃদ্ধি, সঠিক সিট-বেল্ট ব্যবহারের অনুশীলন।

আকাশে ভরসার ছায়া চাই, বিমানের এক একটি গর্জন যেমন আশার প্রতীক, তেমনি প্রতিটি বিধ্বস্ত খবর হয়ে ওঠে নিঃশব্দ কান্নার উৎস। মানুষ তার সহজ গন্তব্যের জন্য আকাশে ভরসা রাখতে চায়। কিন্তু সে ভরসার ওপর যদি অদক্ষতা, অবহেলা আর স্বার্থের ছায়া পড়ে- তবে বিপর্যয় অবধারিত। সাহিত্য আমাদের বলে-প্রতিটি মৃত্যুর পেছনে থাকে অসমাপ্ত গল্প। আর সাংবাদিকতা বলে- প্রতিটি দুর্ঘটনার পেছনে থাকে উপেক্ষিত সতর্কবার্তা। আজকের এই লেখাটি শুধু একটি লেখা নয়, এটি যেন এক আহ্বান। যাতে আর কোনো মা বিমানবন্দরে অপেক্ষা না করেন। যাতে আকাশে উড়তে গিয়ে মানুষ ফেরত আসে বেঁচে, সসম্মানে। আকাশে ওড়ার স্বপ্ন যেন মৃত্যুর দুঃস্বপ্নে রূপ না নেয়। প্রযুক্তির সঙ্গে মানবিকতা, নিয়মের সঙ্গে জবাবদিহি, এই দুইয়ের সংমিশ্রণে তৈরি হোক এক নিরাপদ আকাশ।

রূপালী বাংলাদেশ

Shera Lather
Link copied!