রবিবার, ১০ আগস্ট, ২০২৫

ফেসবুক


ইউটিউব


টিকটক

Rupali Bangladesh

ইনস্টাগ্রাম

Rupali Bangladesh

এক্স

Rupali Bangladesh


লিংকডইন

Rupali Bangladesh

পিন্টারেস্ট

Rupali Bangladesh

গুগল নিউজ

Rupali Bangladesh


হোয়াটস অ্যাপ

Rupali Bangladesh

টেলিগ্রাম

Rupali Bangladesh

মেসেঞ্জার গ্রুপ

Rupali Bangladesh


মোহাম্মদ নাঈম মিজি

প্রকাশিত: আগস্ট ১০, ২০২৫, ০১:৩৯ এএম

মিয়ানমার: ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজিক গ্রাউন্ড

মোহাম্মদ নাঈম মিজি

প্রকাশিত: আগস্ট ১০, ২০২৫, ০১:৩৯ এএম

মিয়ানমার: ইন্দো-প্যাসিফিক স্ট্র্যাটেজিক গ্রাউন্ড

নিক্সন শক, অয়েল শক ও পেট্রো-ডলার চুক্তির মতো বিশ্বরাজনীতির ওয়াটারশেড মোমেন্ট প্রত্যক্ষ করেছিল গত শতকের বিশ্ব। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকেই যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তারের নৃত্য শুরু করে।

অর্থনৈতিক ও সামরিক দুভাবেই অবশেষে নিজেদের আধিপত্য বিস্তারে পূর্ণ সফলতা অর্জন করে। তবে তার জন্য বেশ কৌশলী ও যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিতে হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রকে। কীভাবে গোল্ড রিজার্ভ সংকট কাটিয়ে ওঠে, পেট্রো-ডলার চুক্তি করে ডলারকে বৈশ্বিক মুদ্রায় পরিণত করে বিশ্ব অর্থনীতির পরিচালক বনে যায়। তেলের স্বর্গ মধ্যপ্রাচ্য থেকে কয়েক হাজার মাইল দূরে থেকেও পেরিফ্যারাল কন্ট্রোলের মাধ্যমে বৈশ্বিক তেলের নিয়ন্ত্রণ শুরু করে। কিন্তু বিশ্ব পরিবর্তনশীল সেই সঙ্গে পরিবর্তন হয় ভূ-রাজনীতির গতিবিধি। বিশ্বরাজনীতিতে তেলের গুরুত্ব আগের মতো বহাল থাকলেও বর্তমানে তার কৌশলগত অংশীদার মঞ্চে উপস্থিত। রেয়ার আর্থ মিনারেল।      

মিয়ানমার, চীনের কাছে ২১ শতকের মহাশক্তি থেকে এক কৌশলগত বিন্দু হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে যদিও সামরিক মহাশক্তির দৌড়ে বেশ পিছিয়ে আছে দেশটি। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও ভূ-রাজনৈতিক কৌশল বাস্তবায়নে মিয়ানমার চায়নার অংশীদার। চীনের ইউনান প্রদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে একটি দীর্ঘ স্থলসীমান্ত রয়েছে এ সীমান্তে নিরাপত্তা নিশ্চিত রাখা চীনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কারণ: এখানে মাঝে মাঝে জাতিগত সংঘর্ষ হয় (যেমন- কাচিন, শান রাজ্যে) এবং চীন চাইছে এ অঞ্চল দিয়ে অবাধ বাণিজ্য চালু রাখতে। চীনের কাছে তিন কারণে মিয়ানমার গুরুত্বপূর্ণ ১. জ্বালানি সংগ্রহ ও নিরাপত্তা ইস্যু ২. সীমান্ত নিরাপত্তা ৩. ভারত মহাসাগরের প্রবেশদ্বার। বর্তমানে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে রেয়ার আর্থ মিনারেল। প্রথম দুটি ইস্যু মিয়ানমারকে আঞ্চলিক রাজনীতির মধ্যে সীমাবদ্ধ করে রাখলেও ভারত মহাসাগরের প্রবেশদ্বার ও রেয়ার আর্থ মিনারেলের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের টনক নড়ে, ফলে মিয়ানমার বিশ্বরাজনীতির জটিল মঞ্চের কেন্দ্রে আসে। আর এ নীতির স্বাভাবিক স্বভাবের কারণে প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোয় মিয়ানমার উত্তেজনার স্পার্ক ছড়াচ্ছে এবং ছড়াবে। স্মার্টফোন থেকে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রের স্টিলথ বিমান তৈরিতে রেয়ার আর্থ মিনারেল হচ্ছে কাঁচামাল। আর বৈশ্বিক বিরল খনিজের ৯০ শতাংশের বেশি জোগান একাই দিয়ে থাকে চায়না। তবে বর্তমানে নিজেদের ভূমি রক্ষা ও পরিবেশদূষণ রক্ষায় নিজেদের বিরল খনিজ থেকে সাপ্লাই কিছুটা সীমিত করেছে দেশটি। তার পরিবর্তে অন্যান্য দেশের খনিজ দিয়ে বিশ্বের চাহিদা মেটাচ্ছে। সহজ কথায়, আগে অন্যের ঝুড়ি খালি করি তারপর নিজের ঝুড়িতে হাত দেব। চীনের জন্য মিয়ানমার এক সোনার হরিণ। মিয়ানমারের মাধ্যমে যেমন বিরল খনিজের ব্যবসা জমজমাট একই সঙ্গে বঙ্গোপসাগরে প্রবেশও সুবিধাজনক। চীন বর্তমানে তেল ও গ্যাস আমদানি করার জন্য ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়ার মধ্যে মালাক্কা প্রণালি ব্যবহার করে, যা চীনের জ্বালানি আমদানির ‘লাইফ লাইন’ কিন্তু এই ‘ইন্দো-প্যাসিফিকে’ যুক্তরাষ্ট্রের সি-কন্ট্রোল বহাল, যা সংকটকালীন মুহূর্তে চীনের জন্য এক বিরাট হুমকি। তাই এই হুমকি মোকাবিলা থেকে শুরু করে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর ভূ-রাজনীতিতে প্রবেশ ও বঙ্গোপসাগরে, ভারত মহাসাগরে ভারতের সতিন রূপে আবির্ভাব হতে মিয়ানমার চীনের কাছে এক সোনার ডিম পারা হাঁস। কিন্তু লঙ্কাকা- ঘটে যখন চীন ‘ব্রেড উইথ বাটার’-এর বদলে ‘ব্রেড উইথ রেয়ার আর্থ মিনারেল’ খাচ্ছে, যা নিজের ভূমি না হয়ে মিয়ানমারের ভূমি হওয়ায় যুক্তরাষ্ট্রও ইঁদুর দৌড় শুরু করেছে। চায়না, ভারত, থাইল্যান্ড অর্থাৎ দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে মিয়ানমার কৌশলগত সেতুবন্ধনকারী দেশ হিসেবে পরিচিত। ইয়াংগন বন্দর চীনের জন্য কৌশলগত তাৎপর্য অনেক। সুয়েজ খালের মতো মিয়ানমার মালাক্কার সর্বোত্তম বিকল্প প্রবেশদ্বার। সুয়েজ খালের মতো বিবেচনা করলে মিয়ানমারের গুরুত্ব অনুমেয়। চীন, ভারত উভয়ের জন্যই মিয়ানমার গুরুত্বপূর্ণ। চীন নিরাপদ ও সংক্ষিপ্ত নৌ-রুটের জন্য মিয়ানমারে ‘চায়না-মিয়ানমার অর্থনৈতিক করিডোর’ করতে আগ্রহী। এই অবস্থায় সেন্টমার্টিন মার্কিন সামরিক ঘাঁটি কিংবা বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে মিয়ানমারে ‘মানবিক করিডর’ বাস্তবায়ন করা হবে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য পালটা কৌশলগত অবস্থান।  

ফেব্রুয়ারি ২০২১ সালে সেনা অভ্যুত্থানের পর মিয়ানমারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করার মধ্যেই নিজেদের সম্পৃক্ততা সীমাবদ্ধ রাখে। শুরুর দিকে মিয়ানমারের দিকে তেমন একটা দৃষ্টি না দিলেও যখনই রেয়ার আর্থ মিনারেলের প্রসঙ্গ সামনে আসে তখনই কোনো আনুষ্ঠানিকতা বা সংবাদ সম্মেলন ছাড়াই মিয়ানমারের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয় যুক্তরাষ্ট্র। এরই মধ্যে জান্তা সরকারের ঘনিষ্ঠ কিছু ব্যবসায়ীর ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করেছে। গণতান্ত্রিক সরকারকে অপসারণ করে সেনা শাসন জারি করা জান্তা বাহিনীর ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতির বিপরীত কিন্তু প্রসঙ্গ যখন ন্যাশনাল ইন্টারেস্ট এবং ভূ-রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী চায়নার নিশ্চুপে মাখন খাওয়া নিয়ে তখন নীতি যেন এক প্রকার গলার কাঁটা। বিশ্লেষকের মতে, যুক্তরাষ্ট্রের পদক্ষেপ চায়নার জন্য আরও সুযোগ করে দিচ্ছে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে প্রবেশের জন্য। আদতে যুক্তরাষ্ট্র একা মিয়ানমারে চায়নার বিপরীতে কতটুকু সুবিধা করতে পারবে, তা চিন্তার খোরাক জোগায় কারণ যুক্তরাষ্ট্র সেনা অভ্যুত্থানের পর থেকে শুধু গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের বুলি আওড়াচ্ছে কিন্তু কার্যত কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। কিন্তু চীন শুরু থেকে নিজেদের ন্যাশনাল ইন্টারেস্ট ও সিকিউরিটির কথা আমলে নিয়ে জান্তা বাহিনী ও সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখছে।

পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চীনের কাছে রেয়ার আর্থ মিনারেলের রিজার্ভ আছে ৪৪ মিলিয়ন টন, রাশিয়া ৩.৮ মিলিয়ন টন, ব্রাজিল ২১ মিলিয়ন টন, সাউথ আফ্রিকায় ৭.৯ মিলিয়ন টন। বলা বাহুল্য, ভারতকে বাদ দিয়েই ব্রিকসের সদস্য চার দেশের মোট রিজার্ভের পরিমাণ ৭৬.৭ মিলিয়ন টন। ভারতের অবস্থান নিয়ে সংশয় বিদ্যমান কারণ ভারত যেমন একদিকে ব্রিকসের অন্যতম প্রধান সদস্য তেমনি এ অঞ্চলে চায়নার প্রভাব ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত মিত্রের ভূমিকা পালন করছে। তাই ভারতের ৬.৯ মিলিয়ন টন রেয়ার আর্থ মিনারেলের রিজার্ভ আদতে কার জন্য সুবিধাজনক হবে, তা নিশ্চিত বলার জো নেই। মিয়ানমারের রিজার্ভ রেয়ার আর্থ মিনারেলের পরিমাণ কতটুকু তার সঠিক তথ্য জানা না গেলেও ২০১৭ সাল থেকে দেশটি এ পর্যন্ত দুই লাখ ৯০ হাজার টন বা ৪.২ বিলিয়ন ডলার সমপরিমাণ রেয়ার আর্থ মেটাল রপ্তানি করেছে চীনে। ২০২৪ সালেই বৈশ্বিক রেয়ার আর্থ মিনারেলের বাজার মূল্য ছিলও ১২.৪৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এবং ওগঅজঈ গ্রুপের মতে, এ বাজার মূল্য ২০৩৩ সালে এই আট বছরে বার্ষিক ১২.৮৩ শতাংশ হারে তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়ে ৩৭.৩৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছাবে। উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, শুধু ২০২৪ সালেই বৈশ্বিক জোগানের ৫৮.৩ শতাংশ চীনের দখলে ছিল। ফলে চীনের ভেতর উত্তেজনা বা চীনের সঙ্গে উত্তেজনা সৃষ্টি হলে বৈশ্বিক বাজারের জোগানে ঘাটটি হবে ফলে দাম বৃদ্ধি পাবে, যা চীনের জন্য উপকারী বটে কিন্তু অয়েল শক যেমন পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল, তেমনি রেয়ার আর্থ মিনারেল শক বা জঊঙ ংযড়পশ সৃষ্টি হতে পারে। জ্বালানি নির্ভরতা কমিয়ে ক্লিন এনার্জির দিকে ঝুঁকছে বিশ্ব সেই সঙ্গে ইভি, উইন্ড টারবাইন, সোলার প্যানেল, ব্যাটারি ও মোটর সিস্টেমে, অটোমোবাইলে রেয়ার আর্থ মিনারেলের ব্যাপক চাহিদা। এবং যা সময়ের সঙ্গে সমানুপাতিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। কিন্তু সেই হিসাবে যুক্তরাষ্ট্র ও মিত্র দেশের মোট মজুদের পরিমাণ ১৭ মিলিয়ন টনের কাছাকাছি এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত ডেটাবেস অনুযায়ী।

২০১২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা দপ্তরের ‘ঝঃৎধঃবমরপ এঁরফধহপব’ নীতিপত্রে ঘোষণা করা হয়, যুক্তরাষ্ট্র তার বৈশ্বিক দৃষ্টি ‘এশিয়া-প্যাসিফিক’ অঞ্চলের দিকে সরিয়ে নিচ্ছে, যাকে বলা হয় অংরধ চরাড়ঃ ঝঃৎধঃবমু। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র ইইউ তিনটি কারণে মিয়ানমারের প্রতি আগ্রহী- ১. চীনের আঞ্চলিক আগ্রাসন প্রতিহত করতে ২. সন্ত্রাসবিরোধী জোট সম্প্রসারণ ও সামরিক কৌশলগত ঘাঁটি তৈরি ৩. মিয়ানমারের বিশাল খনিজ সম্পদ ও ভৌগোলিক অবস্থান অর্থনৈতিক ও সামরিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের সামনে এখন দুইটা প্রধান লক্ষ্য এক. রেয়ার আর্থ মিনারেলের যথেষ্ট মজুদ রাখা যাতে বৈশ্বিক জোগানে ঘাটতি হলেও নিজেদের ঘাটতি পূরণ করা যায় যেমনি জ্বালানি বাজারে দেখা যায়। দুই. ভারত মহাসাগরে চীনের প্রবেশে বাধা সৃষ্টি করে নিরাপদ নৌ-রুট তৈরি না করতে দেওয়া। কিন্তু বর্তমানে ট্রাম্পের ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির কারণে এই লক্ষ্যে হয়তোবা ইইউকে যুক্ত করা হবে না। কিন্তু এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র একা খুব বেশি সুবিধা করতে পারবে না, তা অনুমেয় কোয়াডকে সঙ্গে নিয়ে দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় ও ভারত মহাসাগরে নিজেদের প্রভাব বৃদ্ধির দিকে নজর দেবে ট্রাম্পের নেতৃত্বাধীন যুক্তরাষ্ট্র।

মোহাম্মদ নাঈম মিজি শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

Shera Lather
Link copied!