ঢাকা বুধবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

হাওরে অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প বন্ধ করতে হবে

রূপালী ডেস্ক
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ১৭, ২০২৫, ০১:৪১ এএম

সুনামগঞ্জের হাওরাঞ্চল বাংলাদেশের জন্য শুধু একটি ভৌগোলিক অঞ্চল নয়, এটি হলো কৃষকের ভরসা, জাতীয় খাদ্যনিরাপত্তার অন্যতম উৎস এবং প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যের এক অমূল্য ভান্ডার। প্রতিবছর ইরি-বোরো মৌসুমে এখানকার ধান গোটা দেশের চালের যোগান নিশ্চিত করে। অথচ এ হাওরকে রক্ষার দায়িত্ব যাদের হাতে, তারাই এখন হাওরের সর্বনাশের নায়ক হয়ে উঠেছে। নদীভাঙন প্রতিরোধ, বাঁধ নির্মাণ, স্লুইসগেট কিংবা বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পের নামে গড়ে উঠেছে এক ভয়ংকর দুর্নীতির সিন্ডিকেট, যা বছরে শত শত কোটি টাকা গিলে খাচ্ছে।

মঙ্গলবার রূপালী বাংলাদেশের ‘হাওরের ঢেউয়ে ঢেউয়ে লুটের চিহ্ন’ শিরোনামের অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে উঠে আসে সুনামগঞ্জের হাওরের হাজার কোটি টান নয়ছয়ের চাঞ্চল্যকর তথ্য।  

প্রতিবেদনটি বিশ্লিষণ করে দেখা যায়, এখানে  দুর্নীতির ধরন বহুস্তরীয়।  কোথাও একেবারেই প্রয়োজন নেই, তবুও ‘জরুরি প্রকল্প’ ঘোষণা করা হচ্ছে। কোথাও দরকার থাকলেও প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়ে তোলা হয়। বাস্তবে সামান্য কাজ করলেও বিল উঠছে তিন থেকে চারগুণ বেশি। একই জায়গায় বারবার বাঁধ নির্মাণ দেখানো হচ্ছে। নদীর তীরে বালুভর্তি বস্তা ফেলার নামে মাটি ফেলা হচ্ছে। ফলে কয়েক মাস না যেতেই বাঁধ ভেঙে পড়ছে, আবার নতুন করে প্রকল্প গ্রহণ করতে হচ্ছে। এ যেন বাঁধ নয়, হাওরের ওপর ‘দুর্নীতির চক্রবৃত্ত’।

সরকারি কর্মকর্তা, স্থানীয় প্রভাবশালী রাজনীতিক, কিছু ঠিকাদার এবং এমনকি কিছু গণমাধ্যমকর্মী পর্যন্ত এই সিন্ডিকেটের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে রয়েছেন। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী, উপবিভাগীয় প্রকৌশলী, স্থানীয় নেতৃবৃন্দ, সবাই মিলে ভাগাভাগি করে নিচ্ছেন বরাদ্দের অর্থ। তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে এসব অনিয়মের প্রমাণও এসেছে। তবুও কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। সর্বোচ্চ যা হয়েছে, তা হলো- কয়েকজন কর্মকর্তার বদলি বা নামমাত্র বিভাগীয় মামলা। কিন্তু এত বড় দুর্নীতির বিরুদ্ধে ফৌজদারি আইনে মামলা না হলে বা শাস্তির দৃষ্টান্ত না হলে অনিয়মকারীরা কেন থামবে? বরং তারা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠবে।

আমরা মনে করি,  অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প এখনই বন্ধ করা উচিত। প্রকল্প নেওয়ার আগে স্থানীয় জনগণের মতামতকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে হবে। হাওরের মানুষ সবচেয়ে ভালো জানে কোথায় বাঁধ প্রয়োজন, কোথায় অপ্রয়োজনীয়। সেই বাস্তবতাকে উপেক্ষা করে কাগুজে নকশার ভিত্তিতে প্রকল্প নিলে ফল হবে অপচয় ও লুটপাট। পাশাপাশি প্রতিটি প্রকল্পে স্বাধীন ও কার্যকর তদারকি কমিটি থাকতে হবে, যেখানে স্থানীয় কৃষক, সুশীল সমাজ ও গণমাধ্যমের প্রতিনিধিরা থাকবেন। প্রকল্পের ব্যয় প্রাক্কলন স্বচ্ছভাবে করতে হবে। প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র ছাড়া কোনো কাজ দেওয়া যাবে না। একই ব্যক্তিকে বছরের পর বছর প্রকল্প দেওয়ার যে কৌশল চালু আছে, সেটি বন্ধ করতে হবে। আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা যেমন এডিবি যদি অর্থায়ন করে, তবে তাদেরও প্রকল্পের মাঠপর্যায়ের গুণগত মান যাচাইয়ে বাধ্যতামূলক ভূমিকা থাকতে হবে।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, যারা দুর্নীতির সঙ্গে সরাসরি জড়িত, তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে হবে। শুধু বদলি বা সাময়িক বরখাস্ত যথেষ্ট নয়। কোটি কোটি টাকার সরকারি অর্থ লোপাটকারীদের জবাবদিহির বাইরে রাখলে তা হবে রাষ্ট্রীয় সম্পদ ও দেশের সাধারণ মানুষের প্রতি ভয়াবহ অবিচার।

আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, হাওরকে বাঁচানো মানে শুধু একটি ভৌগোলিক এলাকা রক্ষাা নয়, বরং হাজারো মানুষের জীবন-জীবিকা ও দেশের জীববৈচিত্র্য রক্ষা করা। সেই সঙ্গে খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি তো আছেই। তাই হাওরের নামে অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প গ্রহণ, অস্বাভাবিক ব্যয় বৃদ্ধি এবং দুর্নীতির মহোৎসব বন্ধ করতে হবে এখনই। 

আমরা আশা করব, রাষ্ট্রের স্বার্থে, স্থানীয় শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থে এবং হাওরের ভবিষ্যৎ রক্ষায় সরকার কঠোর অবস্থান নেবে। অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পের ফাঁদ পেতে যারা রাষ্ট্রীয় অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে তাদের আইনের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করতে হবে। সেই সঙ্গে অপ্রয়োজনীয় সব প্রকল্প থেকে সরে আসবে। তা না হলে সরকারি অর্থ লোপাটের এই মহাযজ্ঞ দেশকে আরও গভীর সংকটে ঠেলে দেবে।