দুর্গাপূজা, এক অনন্য ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক উৎসব, দক্ষিণ এশিয়ার সমাজজীবনে কেবলমাত্র একটি ধর্মীয় আচারানুষ্ঠান নয়; বরং এটি বহুবর্ণিল সামষ্টিক ঐতিহ্যের প্রতীক, সহাবস্থানের মহা-অভ্যাস এবং ইতিহাস-সঞ্জাত বাঙালি সংস্কৃতির মৌল ভিত্তি। শত শত বছর ধরে এই উৎসব কেবল হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ও অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষও এই উৎসবের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সম্পৃক্ত থেকেছে। এটি শুধু ধর্মীয় অনুশীলনের অংশ নয়, বরং এটি একটি সামাজিক বন্ধন, যেখানে প্রতিটি মানুষ তাদের সাংস্কৃতিক পরিচয়, সামাজিক দায়িত্ব ও সহনশীলতার প্রতিফলন পায়। প্রতিটি পূজাম-প, প্রতিটি আরতি, প্রতিটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সমাজে মিলনমেলার আবহ সৃষ্টি হয়। কিন্তু এই আনন্দমুখর পরিসর এখন এক নতুন ধরনের বিপন্নতায় আক্রান্তÑপ্রযুক্তির অদৃশ্য আগ্রাসন, বিশেষ করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (অৎঃরভরপরধষ ওহঃবষষরমবহপব বা এআই)-নির্ভর ভুয়া তথ্য, ডিপফেক ছবি ও ভিডিও এবং অনিয়ন্ত্রিত গুজবের সুনামি।
আধুনিক সভ্যতায় তথ্যপ্রবাহের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা যাদের হাতে, তারাই সমাজের মনস্তত্ত্বকে প্রভাবিত করতে সক্ষম। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, অ্যালগরিদমিক কাঠামো এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অগ্রযাত্রা মানুষের চিন্তা, আবেগ ও আচরণকে অভূতপূর্বভাবে প্রভাবিত করছে। যে যুগে সত্য-মিথ্যার সীমানা ছিল স্পষ্ট, সেই যুগ পেরিয়ে আমরা এসেছি এমন এক সময়ে, যেখানে একটি ভিডিও বা ছবি সত্য নাকি প্রযুক্তি-সৃষ্ট বিভ্রমÑতা নির্ণয় করা কঠিন হয়ে পড়েছে। দুর্গাপূজার মতো আবেগপ্রবণ উৎসব এ ধরনের প্রযুক্তি-নির্ভর গুজবের জন্য সবচেয়ে স্পর্শকাতর ক্ষেত্র।
মনোবিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে উৎসবকেন্দ্রিক সময়কে বলা যায় আবেগীয় উত্তেজনার ঋতু। এই সময়ে মানুষ স্বাভাবিক জীবনের চেয়ে বেশি আবেগী, অধিক সংবেদনশীল এবং সামাজিকভাবে বেশি যুক্ত। দুর্গাপূজা বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে এক গভীর পবিত্রতার প্রতীক। প্রতিমা, পূজাম-প, আরাধনা, আরতি, অঞ্জলিÑসবকিছুই মানুষের ভেতরে সৃষ্টি করে এক অদ্ভুত আত্মিক উচ্ছ্বাস। এই উচ্ছ্বাসের মাঝেই নিহিত থাকে ভঙ্গুরতা। কারণ, এই সময় যে কোনো নেতিবাচক খবর, গুজব কিংবা অবমাননাকর চিত্র মানুষের আবেগে তীব্র অভিঘাত সৃষ্টি করে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, উৎসবকালীন সময়ে গুজব ও উসকানিমূলক কর্মকা- তুলনামূলক বেশি প্রভাব ফেলে।
বাংলাদেশ তথা এ ভূখ-ের ইতিহাসে গুজবনির্ভর সহিংসতা নতুন কিছু নয়। পাকিস্তান আমল থেকে শুরু করে স্বাধীন বাংলাদেশ পর্যন্ত বহুবার দেখা গেছে, কোনো একটি ভিত্তিহীন খবরের কারণে গ্রামজুড়ে আগুন লেগে গেছে, নিরীহ মানুষের বাড়িঘর ভস্মীভূত হয়েছে, প্রতিমা ভাঙচুর হয়েছে। এক দশক আগেও একটি ফেসবুক পোস্টকে কেন্দ্র করে রামুতে বৌদ্ধবিহার ধ্বংস করা হয়েছিল। একইভাবে কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, দিনাজপুরসহ দেশের নানা স্থানে দুর্গাপূজার সময় সামান্য উসকানিকে কেন্দ্র করে বড় ধরনের সহিংসতা সংঘটিত হয়েছে। গুজবকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ভিত দুর্বল করাÑ এ এক সুপরিকল্পিত কৌশল।
এখন সেই পুরোনো কৌশল নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে যুক্ত হয়ে বহুগুণ ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে। অতীতে যেখানে গুজব ছড়াতে সপ্তাহ বা মাস লেগে যেত, আজকের দিনে একটি এআই-নির্ভর ভিডিও বা ছবি মাত্র কয়েক ঘণ্টায় কোটি মানুষের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। প্রযুক্তি যেমন গতিশীল হয়েছে, তেমনি মানুষের আবেগ ও সমালোচনামূলক চিন্তাশীলতা আজ অধিকাংশ সময় প্রযুক্তির ছায়াতলে সীমিত হয়ে পড়েছে। প্রতিটি অ্যালগরিদম মানুষের সংবেদনশীলতা ও আগ্রহ অনুযায়ী খবর প্রদর্শন করে, যা প্রযুক্তির মাধ্যমে গুজবকে দ্রুত ‘ভাইরাল’ করে তোলে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মূলত মানুষের মতো সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বিশ্লেষণ ক্ষমতা প্রদর্শনকারী যন্ত্রপ্রযুক্তি। এর একটি বিশেষ দিক হলোÑডিপ লার্নিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে অত্যন্ত বাস্তবসম্মত ছবি, অডিও ও ভিডিও তৈরি করা। এই প্রযুক্তিকে ডিপফেক বলা হয়। যখন কোনো ব্যক্তি বা ঘটনার ভুয়া ভিডিও তৈরি হয়, তখন তা সত্য-মিথ্যার সীমারেখাকে ভেঙে দেয়। উদাহরণস্বরূপ, যদি একটি ডিপফেক ভিডিওতে দেখা যায় যে কোনো ব্যক্তি পূজাম-পে অবমাননাকর আচরণ করছে, তবে সেটি মুহূর্তেই মানুষের আবেগে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে। যদিও ভিডিওটি সম্পূর্ণ ভুয়া, তবুও তা বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়।
এআই-নির্ভর ভুয়া কনটেন্ট এত দ্রুত ছড়ায় কারণ, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অ্যালগরিদম স্বাভাবিকভাবেই আবেগঘন বিষয়কে অগ্রাধিকার দেয়। ফলে, ভাইরাল হওয়ার গতি বেড়ে যায়। অন্যদিকে, সত্য যাচাইয়ের প্রক্রিয়া সময়সাপেক্ষ। এই সময়ের ব্যবধানেই সহিংসতা সংঘটিত হয়। গুজব-প্রসূত সহিংসতার সবচেয়ে ভয়ঙ্কর দিক হলো, এটি সামাজিক আস্থা ও পারস্পরিক বিশ্বাসকে ভেঙে দেয়। বাংলাদেশে হিন্দু সম্প্রদায় একটি সংখ্যালঘু গোষ্ঠী। প্রতিবার যখন দুর্গাপূজার সময় তাদের ওপর আক্রমণ হয়, তখন তারা নিজেদের নিরাপত্তাহীন মনে করে। রাষ্ট্রের প্রতি আস্থাও ক্ষুণœ হয়। এর ফলে সামাজিক মেরুকরণ বৃদ্ধি পায়, রাজনৈতিক উত্তেজনা বাড়ে, এমনকি আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও দেশের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতা মূলত নির্ভর করে সামাজিক আস্থার ওপর। যখন নাগরিকরা মনে করেন তারা সমানভাবে নিরাপদ, তখনই রাষ্ট্র শান্তিপূর্ণ থাকে। কিন্তু গুজব যদি নিয়মিতভাবে কোনো একটি গোষ্ঠীকে টার্গেট করে, তবে রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে।
প্রযুক্তি মূলত নিরপেক্ষ নয়। এটি মানুষের হাতে তৈরি একটি কাঠামো, যেখানে মানুষের পক্ষপাত, উদ্দেশ্য ও নৈতিক সংকটও লুকিয়ে থাকে। যখন এআই প্রযুক্তি গুজব তৈরির জন্য ব্যবহৃত হয়, তখন এটি সমাজের ভেতরে বিদ্যমান বিভাজনকে বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। এখানে প্রশ্ন আসেÑনৈতিকতার। প্রযুক্তি-নির্ভর সভ্যতা কি মানুষের জন্য আশীর্বাদ, নাকি অভিশাপ? এর উত্তর নির্ভর করে আমরা প্রযুক্তিকে কীভাবে ব্যবহার করি তার উপর।
এখানে পোস্ট-ট্রুথ ধারণাটিও প্রাসঙ্গিক। পোস্ট-ট্রুথ যুগে সত্য আর মিথ্যার মধ্যে সীমারেখা অস্পষ্ট হয়ে গেছে। মানুষ তাদের পছন্দসই আবেগের সঙ্গে মিলে যায় এমন তথ্যকেই বিশ্বাস করে। দুর্গাপূজার সময় একটি মিথ্যা ছবি যদি মানুষের ধর্মীয় আবেগকে তীব্রভাবে আঘাত করে, তবে তারা তা যাচাই না করেই বিশ্বাস করে। এটাই গুজবের মূল শক্তি।
বাংলাদেশে তথ্যপ্রযুক্তি আইন ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বিদ্যমান থাকলেও গুজব-প্রতিরোধের ক্ষেত্রে তা যথেষ্ট কার্যকর নয়। কারণ, আইন প্রয়োগ প্রায়শই ঘটনার পর হয়, অথচ গুজব প্রতিরোধের জন্য প্রয়োজন ঘটনার পূর্বেই ব্যবস্থা নেওয়া। এ জন্য রাষ্ট্রকে বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করতে হবে, যেখানে প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সামাজিক কর্মীরা একসঙ্গে কাজ করবে। একই সঙ্গে জনগণকে তথ্য যাচাইয়ের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।
মিডিয়া হলো সমাজের আয়না। কিন্তু যদি মিডিয়া অযাচিতভাবে গুজবকে প্রচার করে, তবে সমাজের ক্ষতি বহুগুণ বেড়ে যায়। গণমাধ্যমকে দায়িত্বশীল হতে হবে। প্রতিটি খবর প্রচারের আগে বহুমুখী উৎস থেকে যাচাই করতে হবে। একই সঙ্গে মিডিয়াকে গুজব প্রতিরোধে সচেতনতা তৈরির জন্য বিশেষ ক্যাম্পেইন চালাতে হবে।
আইন, রাষ্ট্র কিংবা মিডিয়া একা কিছু করতে পারবে না, যদি না নাগরিকরা সচেতন হয়। প্রত্যেক নাগরিকের দায়িত্ব হলো, কোনো সন্দেহজনক ছবি বা ভিডিও শেয়ার করার আগে তা যাচাই করা। পরিবার, বন্ধু, প্রতিবেশীÑসবার মধ্যে সচেতনতা ছড়িয়ে দিতে হবে। পাশাপাশি আমাদের সমাজে ধর্মীয় সহনশীলতা ও মানবিক সহাবস্থানকে আরও দৃঢ় করতে হবে।
দুর্গাপূজা কেবল একটি ধর্মীয় উৎসব নয়, বরং এটি সামাজিক সম্প্রীতি ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতীক। এ উৎসবকে কেন্দ্র করে এআই-নির্ভর গুজব ছড়ানো কেবল ধর্মীয় অবমাননা নয়, বরং এটি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্যও ভয়াবহ হুমকি। আমাদের মনে রাখতে হবে, প্রযুক্তি যেমন সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে, তেমনি সমাধানের পথও দেখাতে পারে। সঠিক ব্যবহার, সামাজিক সচেতনতা ও নৈতিক দৃঢ়তার মাধ্যমে আমরা এ সংকট মোকাবিলা করতে পারি।
আজকের প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে বড় প্রয়োজন হলোÑউৎসবের আবেগকে গুজবের বিষাক্ত আগ্রাসন থেকে রক্ষা করা। যদি আমরা তা করতে ব্যর্থ হই, তবে সামাজিক সম্প্রীতির যে ভঙ্গুর সেতু আমরা যুগ যুগ ধরে নির্মাণ করেছি, তা মুহূর্তেই ভেঙে পড়তে পারে। কিন্তু যদি আমরা সবাই মিলে সতর্ক হই, তবে এআই-গুজব যতই শক্তিশালী হোক না কেন, আমাদের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ তার সমস্ত শক্তিকে ব্যর্থ করে দিতে সক্ষম হবে।
এই প্রতিরোধের জন্য দরকার সামাজিক সচেতনতা, ধর্মীয় সহনশীলতার চর্চা, প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার এবং নৈতিক দৃঢ়তা। প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্ব হলো তথ্য যাচাই করা, অসত্য প্রচার প্রতিরোধ করা এবং সামাজিক সম্প্রীতির ভিত্তি মজবুত করা। গণমাধ্যম, রাষ্ট্র ও নাগরিকরা মিলিত হয়ে যখন সতর্ক থাকব, তখন কোনো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা প্রযুক্তি-নির্ভর গুজব আমাদের ঐতিহ্য ও সমাজকে বিনষ্ট করতে পারবে না।
দুর্গাপূজা আমাদের শিখিয়েছে একতার শক্তি, মানবিক সহাবস্থান এবং সংস্কৃতির মর্যাদা রক্ষার মহত্ত্ব। তাই এ উৎসব কেবল আনন্দ ও ভক্তির সময় নয়, বরং এটি আমাদের সামাজিক দায়িত্ব, সচেতনতা এবং নৈতিকতা প্রমাণের এক অগ্নিপরীক্ষা। আমরা যদি সজাগ থাকি, একত্রিত থাকি এবং প্রযুক্তিকে যথাযথভাবে ব্যবহার করি, তবে এই অগ্নিপরীক্ষা কেবল আমাদের সংস্কৃতির শক্তি ও সহনশীলতাকে আরও দৃঢ় করবে, এবং আগামী প্রজন্মের জন্য একটি স্থিতিশীল, সহনশীল ও যুক্তিশীল সমাজের প্রতীক হয়ে থাকবে।
দুর্গাপূজা, এআই গুজব এবং সামাজিক সম্প্রীতির এই অগ্নিপরীক্ষা আমাদের শিখিয়েছেÑঐক্য, সতর্কতা এবং নৈতিক দায়িত্ববোধই হচ্ছে আধুনিক যুগে সমাজ রক্ষার সর্বোত্তম অস্ত্র। আমরা যদি এই পাঠ মেনে চলি, তবে আমাদের ঐতিহ্য, সহনশীলতা এবং সামাজিক সম্প্রীতি চিরদিন অক্ষুণœ থাকবে।
এস এম হাসানুজ্জামান, কলামিস্ট, ও গবেষক