ঢাকা সোমবার, ২৭ অক্টোবর, ২০২৫

গ্যাসের সন্ধান অব্যাহত থাকুক

রূপালী ডেস্ক
প্রকাশিত: অক্টোবর ২৭, ২০২৫, ০১:৫১ এএম

বাংলাদেশের জ্বালানি খাত বহু বছর ধরেই নানা চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে। বিদ্যুৎ, শিল্প, কৃষি ও গৃহস্থালি ব্যাবহারের প্রধান জ্বালানি উৎস প্রাকৃতিক গ্যাসের ঘাটতি এখন আর নতুন খবর নয়। অথচ এক সময় দেশের গ্যাসক্ষেত্রগুলোই ছিল অর্থনীতির প্রাণশক্তি, যা দিয়ে চলত শিল্পকারখানা থেকে শুরু করে বিদ্যুৎ উৎপাদন। কিন্তু ক্রমবর্ধমান চাহিদা ও সীমিত অনুসন্ধান কার্যক্রমের কারণে সেই স্বয়ংসম্পূর্ণতা এখন অতীত। আজ আমাদের প্রতি বছর হাজার হাজার কোটি টাকার এলএনজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) আমদানি করতে হচ্ছে। এই আমদানিনির্ভরতা যেমন বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ সৃষ্টি করছে, তেমনি জ্বালানি নিরাপত্তাকেও অনিশ্চয়তার মুখে ফেলছে।

এই বাস্তবতায় সম্প্রতি দেশীয় গ্যাসক্ষেত্রগুলোতে নতুন করে অনুসন্ধান, খনন ও সংস্কার কার্যক্রম শুরু হওয়াটা এক বড় আশার আলো। হবিগঞ্জের বাহুবল উপজেলার রশিদপুর গ্যাসক্ষেত্রের ৩ নম্বর কূপে সংস্কার কাজের পর নতুন গ্যাসের সন্ধান পাওয়া গেছে, যা দেশীয় গ্যাস উৎপাদনের সম্ভাবনাকে আবারও উজ্জীবিত করেছে। সফলভাবে কাজ সম্পন্ন হলে এ কূপ থেকেই দৈনিক আরও ১০-১৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস জাতীয় গ্রিডে যোগ হবে।

এটি নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি। কারণ, সম্প্রতি দেশের প্রায় সব প্রধান গ্যাসক্ষেত্রের উৎপাদন ধীরে ধীরে হ্রাস পাচ্ছে। নতুন কূপ থেকে গ্যাস পাওয়া মানে শুধু জ্বালানি সরবরাহ বৃদ্ধি নয় বরং এটি দেশের অর্থনীতির ওপর চাপ কমানো, শিল্প খাতে স্থিতিশীলতা আনা ও আমদানিনির্ভরতা হ্রাস করার একটি কার্যকর উপায়।

অন্তর্বর্তী সরকার ২০২৫-২০২৮ সাল পর্যন্ত সময়ে ১০০টি কূপে অনুসন্ধান, উন্নয়ন ও সংস্কার করার যে বৃহৎ পরিকল্পনা নিয়েছে, সেটি বাংলাদেশের জ্বালানি ইতিহাসে এক মাইলফলক হতে পারে। এই ১০০টি কূপের মধ্যে ৬৯টি নতুন কূপ খনন করা হবে, আর ৩১টিতে চলবে সংস্কার কার্যক্রম।

এই উদ্যোগ যদি সময়মতো ও দক্ষভাবে বাস্তবায়িত হয়, তাহলে আগামী তিন থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে দেশীয় গ্যাস উৎপাদন অন্তত ২০-২৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো সম্ভব হতে পারে। এতে প্রতি বছর কয়েক বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় হবে এবং দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা আরও মজবুত হবে।

তবে শুধু পরিকল্পনা ও ঘোষণায় থেমে গেলে হবে না। অতীত অভিজ্ঞতা বলছে, পূর্ববর্তী সরকারও ২০২২-২৫ মেয়াদে ৪৬টি কূপ খনন ও সংস্কারের ঘোষণা দিয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে এর সুফল পাওয়া যায়নি। এর পেছনে ছিল প্রশাসনিক জটিলতা, স্বজনপ্রীতি, অনভিজ্ঞতা ও সময়ক্ষেপণ। ফলাফল দেশে গ্যাস সংকট আরও বেড়েছে, শিল্পক্ষেত্রে উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে, বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলোতে গ্যাস সরবরাহ কমে গেছে।

তাই বর্তমান সরকারের উচিত অতীতের ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়ে পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়নে কঠোর নজরদারি, স্বচ্ছতা ও দক্ষতা নিশ্চিত করা।

একইসঙ্গে প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বৃদ্ধিও জরুরি। আমাদের নিজস্ব অনুসন্ধান সংস্থা বাপেক্স দীর্ঘদিন ধরেই অর্থ ও যন্ত্রপাতির সংকটে ভুগছে। অথচ এই সংস্থাটিই দেশের জ্বালানি খাতের মেরুদ- হতে পারত, যদি পর্যাপ্ত বিনিয়োগ ও আধুনিক প্রযুক্তি সহায়তা দেওয়া হতো।

গ্যাস অনুসন্ধানের পাশাপাশি পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করাও জরুরি। অনিয়ন্ত্রিত খনন বা দুর্বল ব্যবস্থাপনা পরিবেশে ক্ষতি ডেকে আনতে পারে। তাই প্রতিটি কূপ খনন ও সংস্কারের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক মান বজায় রাখতে হবে, এবং পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন বাধ্যতামূলকভাবে সম্পন্ন করতে হবে।

বর্তমানে দেশে প্রতিদিন প্রায় ৮৬৩ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন হচ্ছে রাষ্ট্রীয় তিন কোম্পানি বাপেক্স, বিজিএফসিএল ও এসজিএফএলের মাধ্যমে। বাকি অংশ সরবরাহ করছে বিদেশি প্রতিষ্ঠান শেভরন এবং আমদানি করা এলএনজি। অথচ আমাদের দৈনিক চাহিদা প্রায় দ্বিগুণ। তাই দেশীয় গ্যাসক্ষেত্রগুলোর উৎপাদন বাড়ানো ছাড়া বিকল্প নেই।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বারবারই বলেছেন, দেশে এখনো বহু অনাবিষ্কৃত গ্যাসক্ষেত্র রয়েছে, বিশেষ করে সিলেট, ভোলা, সুনামগঞ্জ, চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে। সেখানে অনুসন্ধান জোরদার করা গেলে নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কারের সম্ভাবনা প্রবল।

জ্বালানি খাত শুধু অর্থনীতির ভিত্তি নয়, এটি জাতীয় নিরাপত্তার সঙ্গেও সম্পর্কিত। তাই দেশীয় সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যাবহার, দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়ন ও গবেষণা-উদ্ভাবনে বিনিয়োগ বাড়ানো এখন সময়ের দাবি।

আমরা মনে করি, বাংলাদেশকে জ্বালানি খাতে আত্মনির্ভর হতে হলে গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে হবে, এবং সেই সঙ্গে মানবসম্পদ ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বাড়ানোরও কোনো বিকল্প নেই। আমদানিনির্ভরতার দুষ্টচক্র থেকে বেরিয়ে আসতে হলে এখনই প্রয়োজন শক্ত পরিকল্পনা ও  দক্ষ বাস্তবায়নের।