ঢাকা শহরের আকাশের নিচে প্রতিদিন কোটি মানুষ জীবিকার সন্ধানে পথে নামে। কেউ অফিসে, কেউ দোকানে, কেউ স্কুলে, কেউ বা নিছক জীবনের তাগিদে রাস্তায় হাঁটে। কিন্তু এই শহরে রাস্তায় হাঁটা মানেই যেন মৃত্যুকে আলিঙ্গন করা। কারণ এই শহরে যেকোনো মুহূর্তে, যেকোনো জায়গায়, কোনো পূর্বাভাস ছাড়াই মানুষের জীবনপ্রদীপ নিভে যেতে পারে। ফার্মগেট এলাকায় মেট্রোরেলের বিয়ারিং প্যাড খুলে পড়ে আবুল কালামের মৃত্যু সেই ভয়াবহ সত্যটিকেই নির্মমভাবে প্রকাশ করেছে। তিনি ছিলেন একজন সাধারণ পথচারী; তার ঘরে ছিল পরিবার, ছিল পরিকল্পনা, ছিল আগামী দিনের স্বপ্ন। কিন্তু রাষ্ট্রের অবহেলা তার জীবন থামিয়ে দিল মুহূর্তেই। পরিবারে রঙিন স্বপ্ন এখন শুধুই ধুলোপড়া স্মৃতি। স্ত্রী ফিরে পাবে না স্বামীকে, সন্তানের বাবা ডাকে আর সাড়া দেবে না কেউ।
মেট্রোরেল দেশে আধুনিকতার প্রতীক, প্রগতি ও সময় সাশ্রয়ের অঙ্গীকার। কিন্তু তার ওপর নির্মিত সুরক্ষা ব্যবস্থার প্রশ্নও সমান গুরুত্বপূর্ণ। যে যন্ত্রাংশের ওপর হাজারো মানুষের জীবন নির্ভর করে, সেটি যদি রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ওপর থেকে খুলে পড়ে একটি প্রাণ নিষ্প্রাণ করে দেয়, তাহলে এটিকে কি আর দুর্ঘটনা বলা যায়? এটি স্পষ্ট অবহেলা, কর্তব্যচ্যুতি এবং দায়িত্বহীনতার ফল। যে অব্যবস্থাপনা, নজরদারির ঘাটতি একজন নিরপরাধ মানুষের জীবন কেড়ে নিল, তার দায় কি শুধু প্রযুক্তিগত ভুল? না, এর দায় আরও গভীর। এর দায় রাষ্ট্রের, এর দায় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের, এর দায় সেই উন্নয়ন ব্যবস্থার যেখানে ‘চোখে দেখা সৌন্দর্য’কেই নিরাপত্তার চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা হৃদয়বিদারক। আহত দেহ, চারদিকে রক্ত, স্তব্ধতা, আতঙ্ক এ দৃশ্য কি প্রতিদিনের অপরিচিত? না। কিন্তু মাঝে মধ্যেই আমাদের সামনে এ রকম দৃশ্য দেখতে পাই। ফ্লাইওভারের গার্ডার ভেঙে পড়া, রাস্তার পাশের ভবনের দেয়াল ধসে পথচারীর মৃত্যু, নির্মাণাধীন সাইটে লোহার রড পড়ে মাথা ফেটে যাওয়া। প্রতিবারই তদন্ত কমিটি হয়, সংবাদ সম্মেলন হয়, ক্ষতিপূরণ ঘোষণা হয়; তারপর সব শান্ত। দায়িদের বিচার নেই, গাফিলতির সংশোধন নেই এবং কিছুদিন পর আরেকটি মৃত্যু আবার নতুন করে প্রমাণ করেÑ আমরা কিছুই শিখিনি।
আবুল কালামের পরিবার এখন অসীম শোক ও অনিশ্চয়তার মধ্যে। তার স্ত্রী পিয়ার কান্না যেন শুধু একজন স্ত্রীর কান্না নয়Ñ এটি রাষ্ট্রের প্রতি প্রশ্ন, সমাজের প্রতি চিৎকার, আমাদের জীবনের মূল্য কি এতটাই কম? চার ও তিন বছর বয়সি দুই শিশুর ভবিষ্যৎ এখন কীভাবে এগোবে? তাদের চোখে মুখে যে হাজারো প্রশ্ন তার উত্তর কি রাষ্ট্র দিতে পারবে? দুই শিশুর ভবিষ্যতের শূন্যতা কি রাষ্ট্রীয় ক্ষতিপূরণে মুছবে? বিধবা পিয়ার বুকফাটা আর্তনাদ কি কোনো ঘোষণায় শান্ত হবে?
আবুল কালামের মৃত্যু এক নিষ্ঠুর বাস্তবতাকেই ফের সামনে এনে দাঁড় করিয়েছে। এটি অনাকাঙ্খিত দুর্ঘটনা নয়; এটি অবহেলা, দায়িত্বহীনতা এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থার চরম ব্যর্থতার ফল। যে শহরে বাসিন্দারা ফুটপাত দিয়ে হাঁটতেও নিরাপদ নয়, সে শহর কীভাবে উন্নয়নের গল্প বলে?
মেট্রোরেল আমাদের আধুনিক নগর ব্যবস্থার প্রতীক, দ্রুতগতির শহরের স্বপ্ন। কিন্তু সেই স্বপ্নের আড়ালে যদি থেকে যায় নির্মাণ ত্রুটি, রক্ষণাবেক্ষণের ঘাটতি, নিরাপত্তার অভাব তবে তা মানুষের জীবননাশের অস্ত্রেই পরিণত হয়। এটা আবারও প্রমাণিত হলো। বিয়ারিং প্যাড কোনো খেলনা নয়; এটি মেট্রো রেললাইনের একটি গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্রাংশ, যা নিয়মিত পরিদর্শন ও পর্যবেক্ষণ ছাড়া কখনোই খুলে পড়ার কথা নয়। তাহলে এটি কীভাবে ঘটল? প্রশ্নটির উত্তর জরুরি এবং এ প্রশ্নের উত্তর শুধু পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি দিয়ে মিলবে না। প্রয়োজন প্রকৃত দায়িদের শনাক্ত করে কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করা।
রাষ্ট্রের প্রথম দায়িত্ব নাগরিকের জীবন রক্ষা করা। যে উন্নয়নের মাঝে মৃত্যু লুকিয়ে থাকে, সেই উন্নয়ন অসম্পূর্ণ, অস্বাস্থ্যকর এবং অমানবিকও বটে। এ মৃত্যুর দায় এড়ানো যাবে না। এ মৃত্যু শুধু কালামের নয়Ñ এ মৃত্যু আমাদের সবার নিরাপত্তা বোধের, আমাদের রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব বোধের।
আমরা মনে করি, রাষ্ট্রের উচিত, প্রতিটি নাগরিকের জীবনের নিশ্চয়তা প্রদান করতে আরও দায়িত্বশীয় ভূমিকা পালন করা। কেননা জীবনের নিশ্চয়তা নিতে না পারলে রাষ্ট্র অস্তিত্ব সংকটে পড়ে এবং পরিণত হয় ব্যর্থ রাষ্ট্রে।

