প্রত্যেক শিশুর প্রথম শ্বাস একটি অলৌকিক ঘটনা, কিন্তু সেই অলৌকিকতাকে রক্ষা করতে শুধু হাসপাতালের যতœই যথেষ্ট নয়। এ বছরের ওয়ার্ল্ড ওয়ান হেলথ ডে-এর প্রতিপাদ্য ‘সুস্থ সূচনা, আশাব্যঞ্জক ভবিষ্যৎ’ আমাদের মনে করিয়ে দেয়, মাতৃ ও নবজাতকের স্বাস্থ্য কেবল চিকিৎসা ব্যবস্থার ওপর নির্ভরশীল নয়, এটি মানুষের, প্রাণীর ও পরিবেশের সার্বিক সুস্থতার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
বাংলাদেশে অধিকাংশ পরিবার প্রাণীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে বসবাস করে, একই জমি ও পানির ওপর নির্ভরশীল এবং দ্রুত পরিবর্তনশীল পরিবেশগত ঝুঁকির মুখে রয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে ‘ওয়ান হেলথ’ বা ‘এক হেলথ’ দৃষ্টিভঙ্গি প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে একটি সুস্থ ও টেকসই ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার পথ দেখায়।
গত কয়েক দশকে বাংলাদেশ মাতৃ ও নবজাতকের মৃত্যুহার কমাতে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে। শক্তিশালী স্বাস্থ্যব্যবস্থা, কমিউনিটি মিডওয়াইফ, এবং উন্নত চিকিৎসা-সেবার মাধ্যমে অসংখ্য প্রাণ রক্ষা পেয়েছে। তবুও অনেক মৃত্যু এখনো প্রতিরোধযোগ্য। সংক্রমণ, নিরাপদ পানির অভাব, অপুষ্টি, অপর্যাপ্ত স্যানিটেশন ও দূষণ আমাদের অগ্রগতিকে বাধাগ্রস্ত করছে। এসব সমস্যা মানব, প্রাণী ও পরিবেশগত স্বাস্থ্যের মিলনবিন্দুতে অবস্থান করে, আর সেখানেই এক হেলথ দৃষ্টিভঙ্গির গুরুত্ব সর্বাধিক।
ধরা যাক, গ্রামের এক গর্ভবতী নারী। তার পরিবার বাড়ির পাশে মুরগি ও ছাগল পালন করে, রান্না ও ধোয়ার কাজে নদীর পানি ব্যবহার করে, আর রান্না হয় ধোঁয়াযুক্ত চুলায়। ফলে তিনি প্রাণী থেকে আসা জীবাণু, দূষিত বাতাস ও অস্বাস্থ্যকর পানির সংস্পর্শে থাকেন। এগুলো তার এবং গর্ভস্থ শিশুর জন্য সংক্রমণ, প্রিম্যাচিউর জন্ম বা কম ওজনের শিশুর ঝুঁকি বাড়ায়। তার সুস্থতার জন্য কেবল চিকিৎসা নয়, দরকার নিরাপদ পানি, পরিচ্ছন্ন পরিবেশ, প্রাণীর সঠিক যতœ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও ধোঁয়ামুক্ত রান্না যা সম্ভব চিকিৎসক, প্রাণীচিকিৎসক, প্রকৌশলী, কৃষিবিদ ও স্থানীয় নেতৃত্বের সম্মিলিত প্রচেষ্টায়। এই পারস্পরিক সম্পর্কই এক হেলথ ধারণার ভিত্তি।
বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা স্পষ্টভাবে দেখায় যে প্রাণীর স্বাস্থ্য মানুষের স্বাস্থ্যের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। নিপাহ ভাইরাস, এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা, অ্যানথ্রাক্স ও র্যাবিসসহ একাধিক জুনোটিক রোগ বারবার জনস্বাস্থ্য সংকট সৃষ্টি করেছে। ২০০১ সালে শনাক্ত নিপাহ ভাইরাস প্রায় প্রতিবছরই ফিরে আসে, এবং মুরগির মধ্যে এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জার প্রাদুর্ভাব জনস্বাস্থ্য ও অর্থনীতিকে সমানভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে। প্রতিটি প্রাদুর্ভাব চিকিৎসা ব্যবস্থার ওপর চাপ সৃষ্টি করে, বিশেষ করে মা ও শিশুস্বাস্থ্যসেবায়। প্রাণীর রোগ প্রতিরোধ তাই মানুষের সুরক্ষার প্রথম ধাপ।
আরেকটি ক্রমবর্ধমান হুমকি হলো অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্ট্যান্স (অগজ)। প্রাণী ও পোলট্রিতে অতিরিক্ত অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের ফলে প্রতিরোধী ব্যাকটেরিয়া খাদ্য, পানি ও পরিবেশের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ছে। এর ফলে সাধারণ সংক্রমণও এখন অনেক কঠিন হয়ে উঠছে। এএমআর মোকাবিলায় আন্তঃখাত সহযোগিতা জরুরি। কৃষকেরা যেন প্রাণীচিকিৎসকের পরামর্শে দায়িত্বশীলভাবে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করেন, সেই সহায়তা দিতে হবে। টিকাদান, ভালো বায়োসিকিউরিটি ও খামারে পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখলে অ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োজন অনেকাংশে কমে যায়। দায়িত্বশীল ব্যবস্থাপনা কেবল প্রাণী নয়, মানবজীবন রক্ষাকারী ওষুধগুলোকেও কার্যকর রাখে।
পরিবেশগত বিষয়গুলোও সমান গুরুত্বপূর্ণ। পৃথিবীর অন্যতম জলবায়ু-ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে বাংলাদেশে ঘন ঘন বন্যা, ঘূর্ণিঝড় ও তাপমাত্রা বৃদ্ধি জীবিকা নষ্ট করছে, পানির উৎস দূষিত করছে এবং জলবাহিত ও বাহকজাত রোগ ছড়িয়ে দিচ্ছে। এতে মানুষ ও প্রাণী উভয়েরই খাদ্য নিরাপত্তা ও পুষ্টি হুমকির মুখে পড়ছে। শহরাঞ্চলের দূষণ ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা পরিস্থিতি আরও জটিল করছে। তাই জলাভূমি সংরক্ষণ, নিরাপদ পানীয় জল, পরিচ্ছন্ন বাজার ও সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা শুধু পরিবেশ নয়, জাতীয় স্বাস্থ্য নিরাপত্তার জন্য অপরিহার্য।
এক স্বাস্থ্য বাস্তবায়নের জন্য দরকার আন্তঃখাত সমন্বয়। স্বাস্থ্য, প্রাণিসম্পদ, কৃষি, পরিবেশ ও পানি খাতকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে, তথ্য ভাগাভাগি ও যৌথ পর্যবেক্ষণ জোরদার করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, যদি পশুদের মধ্যে কোনো অস্বাভাবিক অসুস্থতা দেখা দেয়, তাহলে সেই তথ্য দ্রুত জনস্বাস্থ্য বিভাগে পৌঁছানো উচিত, যাতে আগেই পদক্ষেপ নেওয়া যায়। পাশাপাশি কমিউনিটি হেলথ ও ভেটেরিনারি কর্মীরা একত্রে পরিবারগুলোর মধ্যে স্বাস্থ্য, পরিচ্ছন্নতা ও প্রাণী পরিচর্যা বিষয়ে সচেতনতা গড়ে তুলতে পারেন।
বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানগুলো এমন পেশাজীবী তৈরি করতে পারে, যারা মানব ও প্রাণীস্বাস্থ্যের সমন্বিত জ্ঞান রাখে। একইভাবে, কৃষকবান্ধব অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবস্থাপনা ও পরিবেশবান্ধব উদ্যোগ যেমন পরিচ্ছন্ন চুলা, নিরাপদ স্যানিটেশন ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, সম্প্রদায়ের সামগ্রিক স্বাস্থ্য উন্নত করতে পারে।
এক স্বাস্থ্যের শক্তি নিহিত আছে সহযোগিতায়। প্রাণী সুস্থ থাকলে প্রাদুর্ভাব কমে; পরিবেশ পরিচ্ছন্ন থাকলে মানুষ উন্নত জীবনযাপন করে; ওষুধ সঠিকভাবে ব্যবহার করলে তা দীর্ঘদিন কার্যকর থাকে। প্রতিটি খাতের সফলতা অন্যের সাফল্যের ওপর নির্ভরশীল।
বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই এক স্বাস্থ্য নীতিমালা গ্রহণের দিকে এগোচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর ও পরিবেশ অধিদপ্তরের মধ্যে সমন্বিত প্রচেষ্টা বাড়ছে। তবে টেকসই অগ্রগতির জন্য প্রয়োজন নিরবচ্ছিন্ন অর্থায়ন, স্থানীয় অংশগ্রহণ ও স্বচ্ছ সমন্বয়।
ব্যক্তিগত পর্যায়ে এক স্বাস্থ্য মানে হলো নিরাপদ পানি, নিরাপদ খাদ্য, সুস্থ প্রাণী ও ভারসাম্যপূর্ণ পরিবেশ, যা মা ও শিশুর টিকে থাকা ও বিকাশের মূলভিত্তি। জাতীয় নীতি ও সম্প্রদায়ভিত্তিক কর্মকা-ে এক স্বাস্থ্যকে একীভূত করলে স্বাস্থ্য আর কেবল একটি খাতের দায়িত্ব থাকবে না, বরং এটি হবে জাতির সম্মিলিত অঙ্গীকার।
সহযোগিতা, উদ্ভাবন ও দায়বদ্ধতার মাধ্যমে বাংলাদেশ নিশ্চিত করতে পারে যে, সুস্থ সূচনা সত্যিই আশাব্যঞ্জক ভবিষ্যৎ বয়ে আনবে, মানুষ, প্রাণী ও আমাদের সবার ভাগ করা পৃথিবীর জন্য।
প্রফেসর ড. মো. আহসানুল হক (রোকন)
পরিচালক, ওয়ান হেলথ ইনস্টিটিউট, সিভাসু

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন