ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে উত্তাপ বাড়ছে। কিন্তু এ উত্তাপ এখন গণতান্ত্রিক প্রতিযোগিতার উত্তাপ নয় বরং সহিংসতা, সংঘর্ষ ও প্রাণহানির বিভীষিকায় পরিণত হচ্ছে। নির্বাচনের আগমুহূর্তে বিএনপির প্রার্থী ঘোষণার পর দেশজুড়ে যে সহিংসতার ঢেউ উঠেছে, তা কেবল উদ্বেগজনক নয়, গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়েও গুরুতর প্রশ্ন তোলে।
চট্টগ্রামে নির্বাচনি প্রচারণায় গুলিতে একজন নিহত এবং প্রার্থীসহ কয়েকজন আহত হওয়ার ঘটনাটি এই সংকটের ভয়াবহ রূপ প্রকাশ করেছে। কুমিল্লা, ময়মনসিংহ, গাইবান্ধা, পটুয়াখালী, ফরিদপুরসহ প্রায় প্রতিটি অঞ্চলে মনোনয়ন বঞ্চনা ও দলীয় কোন্দলকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ, ধাওয়া-পাল্টাধাওয়া, এমনকি অগ্নিসংযোগের ঘটনাও ঘটছে। রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা যেন পরিণত হচ্ছে ব্যক্তিগত আধিপত্য বিস্তার ও প্রতিহিংসার মঞ্চে।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস বলছে, প্রায় প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনই কোনো না কোনোভাবে সহিংসতার রঙে রঞ্জিত হয়েছে। রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা, পারস্পরিক অবিশ্বাস, অপরাধীদের প্রশ্রয় এবং আইনের শৈথিল্য এই সহিংসতার মূল কারণ। স্থানীয় পর্যায়ে ক্ষমতার দখল ও আর্থিক সুবিধা অর্জনের লড়াই অনেক সময় নির্বাচনি উত্তেজনাকে রক্তাক্ত করে তোলে। দুঃখজনক হলো, রাজনৈতিক দলগুলো এখনো এই চক্র থেকে মুক্ত হওয়ার কোনো বাস্তব প্রয়াস দেখাতে পারেনি।
মানবাধিকার সংস্থাগুলোর তথ্যমতে, কেবল অক্টোবর মাসেই দেশে রাজনৈতিক সহিংসতার প্রায় ৫০টি ঘটনা ঘটেছে, যেখানে প্রাণহানি ও শতাধিক আহতের খবর পাওয়া গেছে। এর প্রতিটি ঘটনাই আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, গণতন্ত্র কেবল ভোটের আয়োজন নয়। এটি নাগরিক নিরাপত্তা, সহনশীলতা ও রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিষয়।
এ অবস্থায় দায়িত্ব এড়ানোর সুযোগ কোনো পক্ষেরই নেই। রাজনৈতিক দলগুলোকে অবশ্যই তাদের কর্মীদের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে হবে। প্রার্থী বাছাই বা প্রচার যে পর্যায়েই হোক, মতভেদ যেন সহিংসতায় রূপ না নেয়, সে বিষয়ে দলের উচ্চপর্যায় থেকে স্পষ্ট নির্দেশনা থাকতে হবে। একই সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নিরপেক্ষ ও দৃঢ়ভাবে দায়িত্ব পালন করতে হবে। যে কোনো সহিংসতার ঘটনায় দোষীদের দ্রুত আইনের আওতায় আনা ছাড়া এ সংস্কৃতি বন্ধ করা সম্ভব নয়।
জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে নতুন আশাবাদ জাগিয়েছিল, সেটি টিকিয়ে রাখা এখন রাজনৈতিক নেতৃত্বের পরীক্ষার সময়। ফ্যাসিবাদের পতনের পরও যদি আমরা সহিংসতার পুরোনো বৃত্তে বন্দি থাকি, তবে তা হবে জাতির জন্য চরম ব্যর্থতা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, পুরোনো রাজনৈতিক সংস্কৃতি একদিনে বদলানো সম্ভব না ঠিকই, তবে জুলাই পরবর্তী বাস্তবতায় দলগুলোর দায়িত্ব ছিল ভিন্ন বার্তা দেওয়ার। এদিকে রাজনৈতিক দলগুলোও নিজেদের দায় এড়িয়ে যাচ্ছে না। তবে তাদের দাবি, সরকারকেই শক্ত হাতে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ ও লেভেল প্লেইং ফিল্ড নিশ্চিত করতে হবে।
বাংলাদেশের জনগণ আর সংঘাত চায় না, তারা চায় শান্তিপূর্ণ, অংশগ্রহণমূলক ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন। রাজনৈতিক দলগুলো যদি সত্যিই গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে, তবে তারা সহিংসতার রাজনীতি পরিহার করে পারস্পরিক সহনশীলতা, সংলাপ ও ন্যায্য প্রতিযোগিতার পথ বেছে নেবে।
আমাদের মনে রাখতে হবে, নির্বাচন মানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা, প্রতিহিংসা নয়। আর প্রতিদ্বন্দ্বিতা কখনোই হাতাহাতি, অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর বা খুনের উৎসব হতে পারে না। গণতান্ত্রিক জীবনের নীতিমালা হলো আইন ও মতবিরোধ নিষ্পত্তির শান্তিপূর্ণ উপায়। এ নীতি রক্ষা করতে না পারলে নির্বাচন হবে প্রশ্নবিদ্ধ এবং দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ফের পুরোনো রূপে শোষণ ও প্রতিহিংসার দিকে ঝুঁকবে।
নির্বাচন একটি দেশের সর্বজনীন অভিব্যক্তি। সেটিকে বিপন্ন করা মানে দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে অস্থিরতায় ফেলে দেওয়া। তাই সকল রাজনৈতিক দল, প্রশাসন ও নাগরিক সমাজকে নির্বাচন ঘিরে সকল নৈরাজ্য বন্ধে কঠোর হতে হবে। নির্বাচনকে শক্তিশালী গণতন্ত্রে পরিণত করতে এবং সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা ফিরিয়ে আনতে এর কোনো বিকল্প নেই। বর্তমান রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ রাখা বড় চ্যালেঞ্জ। তাই আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সব বাহিনী সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।
আমাদের প্রত্যাশা থাকবে, সরকার আসন্ন নির্বাচন ঘিরে সকল নৈরাজ্য ও সহিংসতা কঠোর হাতে দমন করতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। সেই সঙ্গে জনগণের প্রত্যাশিত একটি শান্তিপূর্ণ, সুশৃঙ্খল ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সাধারণ জনগণকে উপহার দেওয়ার জন্য সব রকম প্রস্তুতি গ্রহণ করবে।

