ঢাকা মঙ্গলবার, ১১ নভেম্বর, ২০২৫

প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শারীরিক ও সংগীত শিক্ষক নিতে বাধা কেন?

এ এন রাশেদা
প্রকাশিত: নভেম্বর ১১, ২০২৫, ০১:৪৩ এএম

সেই পাকিস্তানি শাসনামলে ১৯৫৭ সালে দ্বিতীয় শ্রেণিতে রংপুর গার্লস স্কুলে ভর্তি হয়েছিলাম। পরবর্তীতে তা সরকারি হয়েছে। বড় মাঠ ছিল। খেলাধুলার অন্ত ছিল না। ব্লু-বার্ড, গার্লস গাইড ছিল। ঠিক সাড়ে ৯টায় অ্যাসেম্বলিতে পিটি করানো হতো। তারপর জাতীয় সংগীত ‘পাক সার জমিন সাদবাদ’Ñ আইয়ুব খান ক্ষমতায় আসার পরেÑ এই গান দেওয়া হয়েছিল। তার আগে কবি গোলাম মোস্তফার রচিত গান ছিল। অ্যাসেম্বলিতে থাকা বাধ্যতামূলক ছিল, তাই সময়মতো স্কুলের বড় গেট বন্ধ হয়ে যেত। আর টিফিন পিরিয়ডে বিশাল মাঠজুড়ে চলত খেলাধুলা। গার্লস গাইড, ব্লু-বার্ডের নানা অনুশীলন। এসব নিয়মকানুন সব স্কুলেই পালিত হতো। আর এই ক্রিয়াকা- চালানোর জন্য শারীরিক শিক্ষার শিক্ষয়ত্রী দৌলতন নেসা আপা ছিলেন আমাদের স্কুলে।

গত ২৮ আগস্ট প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় বলেছে, কয়েকটি রাজনৈতিক দল ও ধর্মভিত্তিক সংগঠনের বিরোধিতার মুখে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। তাহলে বিরোধিতার কারণটি কি ছিল? তা ছিল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শারীরিক শিক্ষা ও সংগীত বিষয়ে সহকারী শিক্ষকের পদ প্রবর্তন। পত্রিকার খবরে দেখা যাচ্ছে, ‘গত ২৮ আগস্ট জারি করা প্রজ্ঞাপনে প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের মূল বিধিমালায় চারটি পদ ছিল। প্রধান শিক্ষক, সহকারী শিক্ষক, সহকারী শিক্ষক (শারীরিক শিক্ষক) এবং সহকারী শিক্ষক (সংগীত)। সংশোধিত বিধিমালায় এখন শুধু প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষক পদ রাখা হয়েছেÑ প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় ২ নভেম্বর ২০২৫ সংশোধিত এই প্রজ্ঞাপন জারি করেছে।

ক্ষমতার রদবদলে বহুবার বহুনীতি বদলে ফেলা হয়। ভালো নীতি বদলাতে সময় লাগে না। তাই কয়েকটি ধর্মভিত্তিক সংগঠনের বিরোধিতার সঙ্গে সঙ্গেই তা কার্যকরী করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল সরকার। অথচ শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের লক্ষ্যেই সুস্থ দেশীয় সংস্কৃতি চর্চাকে উৎসাহিত করতে এই শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত ২০২০ সালে নিয়েছিল বিগত সরকার। আর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এই দুই বিষয়ে ২ হাজার ৫৮৩ জন করে ৫ হাজার ১৬৬টি শিক্ষকের পদ অনুমোদন করে ২৮ আগস্ট নতুন নিয়োগ বিধির প্রজ্ঞাপন জারি করেছিল প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়। এমনিতে মন্ত্রণালয়ের কাজ অনেক ধীর গতিতে চলেÑ হিসাব-নিকাশসহ অধিকাংশ আমলার পশ্চাৎপদ মনোভাবের কারণে এবং অনেক ক্ষেত্রে সরকারকে হেয় করার জন্য তা করা হয়। সে জন্যই হয়তো ২০২০ সালের সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে পাঁচ বছর সময় লাগল। এমন অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়।

১৯৭১-এ বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে অনেক ভালো উদ্যোগ বাধাগ্রস্ত হয়েছে। যেমন ১৯৭৩ সালে শিক্ষাবিষয়ক ড. খুদা কমিশন রিপোর্ট সম্পর্কে জনৈক আমলা বঙ্গন্ধুকে নাকি বলেছিলেনÑ ‘এই রিপোর্ট কার্যকরী করতে গেলে বাংলাদেশ ধ্বংস হয়ে যাবে। অন্য কোনো কাজই করা যাবে না।’ আমলার এই বক্তব্যে বঙ্গবন্ধু বোধহয় এই কমিশনের রিপোর্ট নিয়ে কোনো আলাপই করেননি। অথচ ছাত্র সমাজ ও তৎকালীন ডাকসু এবং অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে অনেক মিটিং-মিছিল করা হয়েছিল।

১৯৯৫ সালে বিএনপি ও জামায়াত সরকার আর এক নীতি চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল। তার নাম ছিল ‘একমুখী শিক্ষা নীতি।’ ‘সর্বজনীন বিজ্ঞানভিত্তিক একমুখী শিক্ষার’ জন্য দীর্ঘদিন ছাত্রসমাজ আন্দোলন করে যাচ্ছিল এবং খুদা কমিশনেও তদ্রƒপ সুপারিশ ছিল। কিন্তু ১৯৯৫ সালে মাধ্যমিক পর্যায়ের এই ‘একমুখী শিক্ষাক্রম’-এর ধারা বিজ্ঞানভিত্তিক ছিল না। তা পরিষ্কারভাবে ছিল মাদ্রাসামুখী এবং এ-ধারা ধনীক শ্রেণির ও-লেভেল এবং ক্যাডেট স্কুলের জন্য প্রযোজ্য ছিল নাÑ তাই এর অন্তর্নিহিত ভাব বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা না। আর এই কথিত একমুখী শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে ছাত্রসমাজ আন্দোলন শুরু করেছিল এবং কোনো কোনো শিক্ষক সংগঠনও করেছিল। অবশ্য সরকারের বিদায়ের সঙ্গে সেই চিন্তা বাস্তবায়িত হয়নি। এবার নতুন করে তারা যে সক্রিয় এ কথা বুঝতে বেশি জ্ঞানী হওয়ার প্রয়োজন পড়ে না।

সারা বিশ্ব যখন শিশু-কিশোর বয়স থেকে তাদের স্বাস্থ্য সুগঠিত এবং সুরক্ষার জন্য নানা রকম শারীরিক কর্মকা- এবং সৃজনশীলতা বৃদ্ধির জন্য নানামুখী সাংস্কৃতিক কর্মকা-ের ওপর জোর দিচ্ছে, তখন আমাদের উল্টো দিকে যাওয়ার জন্য কিছু ধর্মীয় দলের বিরুদ্ধাচারণ করছে এবং ‘সুনিপুণ’ বুদ্ধিতে গঠিত এই সরকারÑ তা কার্যকর করার উদ্যোগ নিয়েছে। পরিতাপের বিষয় তো একটি না অনেক। আশি, নব্বইয়ের দশক থেকেই সারা দেশে জেলা, গ্রাম সকল পর্যায়ে বিজ্ঞানের শিক্ষক নেই। অংকের, ইংরেজির শিক্ষক নেই। আবার সাংস্কৃতিক কর্মকা- পরিচালিত করার শিক্ষকও নেই। এ অবস্থায় এসব প্রতিষ্ঠান থেকে যেসব শিক্ষার্থী বেরিয়ে আসছেÑ তাদের মান নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই আলোচনা চলছে। কিন্তু পরিত্রাণের পথ তো একটাইÑ তা হলো শিক্ষক নিয়োগ, শিক্ষকের সম্মানজনক বেতন এবং এ পেশার মানোন্নয়ন। শিক্ষকের বেতন-ভাতা যে নিম্নমানের তা তো কিছুদিন পরপরই তারা প্রেসক্লাবের সামনে এসে জানিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। স্বাধীনতার ৫৩ বছরে তারা হয়তো হাজার বার জানিয়েছে। যা হোক বর্তমানে যে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছেÑ তা থেকে উত্তরণ ঘটাতে হবে। সারা বিশ্বের আমরা উদাহণ দেইÑ সেসব দেশে শিক্ষার্থীরা স্কুলে নেচে গেয়ে নানা আনন্দময় কর্মসূচির মাধ্যমে শিক্ষাগ্রহণ করে। সুইডেন, নরওয়ে, চীন, রাশিয়া, ভিয়েতনাম, জাপান, জার্মান, কিউবাসহ অনেক দেশের উন্নত শিক্ষা ব্যবস্থার কথা বলতে পারি; সেখানে স্বাস্থ্য ও সং¯ৃ‹তির বিকাশের জন্য সাংস্কৃতিক কর্মকা-কে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে কীভাবে ধরা হয়? আমাদের পাশের দেশ ভুটানেও শিক্ষার্থীদের আনন্দের সঙ্গে পড়ানো হয়। সেখানে শিক্ষকের বেতনসহ শিক্ষার মানও উন্নত। তাহলে আমরা সেখানে তা করছি না কেন? আমাদের শিক্ষার্থীদের যেমন শারীরিক শিক্ষার প্রয়োজন তেমনি প্রয়োজন সাংস্কৃতিক কর্মকা- পরিচালনা। তা যেমন শুধু পাঠ্যবই দিয়ে সম্ভবপর না, তেমনি শুধু ধর্মগ্রন্থ পড়িয়েও সম্ভবপর হবে না। তাই যদি হতো তাহলে মাদ্রাসায় তো এত লজ্জাজনক ঘটনা ঘটত নাÑ প্রায় প্রতিদিন পত্রিকার পাতায় সেসব ঘটনা প্রকাশিত হয়।

আমাদের দেশ আজ শুধু অর্থনৈতিকভাবে ভঙ্গুর না। সাংস্কৃতিক মানেও ভঙ্গুর, তা ফেসবুকের শত শত কমেন্ট এবং নতুন রাজনীতিতে আসা ব্যক্তিদের আচরণ, বক্তৃতা বিবৃতিতে পরিস্ফুট। শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক মানে আমরা আজ শূন্যের কোঠায়। তা শুধু স্কুলে না, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত ব্যাপৃত।

১৯৩৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে দেওয়া রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষণের সামান্য একটু অংশ উদ্ধৃত করে শেষ করতে চাই। তিনি বলেছিলেন, ‘ভোজ্য জিনিসে ভান্ডার ভরে উঠল, রান্না ঘরে হাঁড়ি চড়েছে, তবু ভোজ বলে না তাকে। আঙিনায় পাত পড়ল কত, ডাকা হয়েছে কতজনকে, সেই হিসাবেই ভোজের মর্যাদা। আমরা যে ‘এডুকেশন’ শব্দটা আবৃত্তি করে মনে মনে খুশি থাকিÑ সেটাতে ভাড়ার ঘরের চেহারা আছে, কিন্তু বাইরে তাকিয়ে দেখি ধু-ধু করছে আঙিনা।’

আজ এতটা বছর পরেও কি আমরা সেই ধু-ধু মাঠ দেখছি না। সেই শিক্ষার ক্ষেত্রেই? আমরা গামলার পানি ফেলতে গিয়ে শিশুসহই ফেলে দিয়েছি।