বি. রায় চৌধুরীকে (ভূপেন্দ্র কুমার রায় চৌধুরী) প্রজন্মের প্রতিনিধিদের কজন চেনে- এই প্রশ্নটি যেমন আক্ষেপের, তেমনি এই প্রশ্নের মধ্যে অগ্র প্রজন্মের ব্যর্থতার খতিয়ানও যে রয়েছে, বলা ভালো তা বিচ্ছিন্ন কোনো বিষয় নয়। কীর্তিমানদের নিয়ে আলোচনা-লেখা কিংবা নানামুখী কর্মকা- শুধু তাদের মহৎ কর্ম, জীবন দর্শন এবং অবিনশ্বর কীর্তির ওপর আলোকপাত করাই উদ্দেশ্য নয়, বরং এ থেকে কীভাবে প্রজন্ম শাণিত হতে পারে সেই লক্ষ্যটা উপলক্ষ্য না হলেই মঙ্গল। এ ধরনের লেখা-আলোচনা কিংবা কর্মকা-ে যদিও মুখ্যত উপস্থাপন করা হয় কীর্তিমানদের শারীরিক মৃত্যু হলেও তাদের কাজ ও কর্মের মাধ্যমে তারা মানুষের মনে চিরঞ্জীব হয়ে থাকেন। কিন্তু এর যে প্রভা তা প্রজন্মকে আলোকিত হওয়ার পথ দেখায় বহুভাবে এই সত্য অনস্বীকার্য। বি. রায় চৌধুরী তেমনই অনুসরণযোগ্য এক ব্যক্তিত্ব। ‘কীর্তিমানের মৃত্যু নেই’Ñ এই বাক্যটি শুধু একটি প্রবাদ নয়, এটি একজন মানুষের জীবনের চরম সার্থকতা বোঝায়। যে মানুষ তার কর্ম, মেধা, ত্যাগ আর মহান কাজের মাধ্যমে সমাজে, জাতিতে কিংবা মানবতার কল্যাণে অবদান রাখেন, তার দেহ হয়তো একদিন বিলীন যায়, কিন্তু তার নাম চিরকাল বেঁচে থাকে মানুষের হৃদয়ে। ইতিহাস বারবার প্রমাণ করে, সত্যিকারের কীর্তিমানদের কখনোই মৃত্যু হয় না, তারা হয়ে ওঠেন প্রজন্মের অনুপ্রেরণা। এই প্রেরণা অনেক ভারবাহী এবং নিশ্চয় খুব গুরুত্বপূর্ণ।
বীর বি. রায় চৌধুরী ১৯১২ সালে ব্রিটিশ ভারতের অবিভক্ত বাংলার হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং উপজেলার রঘুচৌধুরীপাড়ায় জন্মগ্রহণ করে ক্রমান্বয়ে বেড়ে উঠে অবিভক্ত বাংলায় তার কীর্তির আলো ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেন কর্মকীর্তির মধ্যে দিয়ে। তিনি অল্প বয়সেই খেলাধুলা এবং রাজনীতি উভয় ক্ষেত্রেই তার উপস্থিতি জানান দিতে থাকেন। ছাত্রাবস্থায় তিনি স্বদেশি আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হয়ে পড়েন। হবিগঞ্জ জেলা সদরের উচ্চ বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণিতে পড়ার সময় তখন হবিগঞ্জ সফরের সময় তিনি নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুর সংবর্ধনা আয়োজনে ব্যাপক ভূমিকা রেখে আরেকটি আলোকিত অধ্যায়ের সঙ্গে নিজের নাম যুক্ত করেন। একই বছর হবিগঞ্জ মহকুমা ট্রেজারি অফিসের সামনে স্বদেশি পতাকা উত্তোলন করার সময় তিনি এবং তার তিন বন্ধুকে গ্রেপ্তার করেন তৎকালীন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। এক সংক্ষিপ্ত বিচারে হবিগঞ্জের তৎকালীন মহকুমা কর্মকর্তা তাদের ১৫ মাসের কারাদ- দেন এবং এরপর তাদের আসামের শিলচর কারাগারে পাঠানো হয়। করামুক্তির পর বি. রায় চৌধুরী হবিগঞ্জ বৃন্দাবন সরকারি কলেজে ভর্তি হন এবং প্রতিষ্ঠা করেন টাউন ক্লাব নাম একটি ক্রীড়া সংগঠন।
রাজনৈতিক আন্দোলন, স্বদেশি চেতনা আর ফুটবলের প্রতি নিখাদ ভালোবাসা তার জীবন অধ্যায়কে শুধু আলোকিত-বিকশিতই করেনি একই সঙ্গে তিনি তৈরি করেছিলেন তার চেতনার অনুসারী এক ঝাঁক তরুণকেও, যাদের ভূমিকা স্বদেশি আন্দোলন আর ক্রীড়া জগতে আরেকটি নব অধ্যায় তৈরি করেছিল। কলেজে থাকাকালীন বি. রায় চৌধুরী হবিগঞ্জ টাউন ক্লাব এবং নওজোয়ান ক্লাবের সঙ্গে ফুটবল খেলা শুরু করেন এবং একপর্যায়ে জগন্নাথ কলেজের অধ্যক্ষ রায় বাহাদুর সত্যেন্দ্রনাথ ভদ্র তাকে ঢাকায় ফুটবল ট্রায়ালের জন্য আমন্ত্রণ জানান। পরিবারের দ্বিধা সত্ত্বেও তিনি ঢাকায় চলে আসেন এবং জগন্নাথ কলেজ ফুটবল দলের হয়ে সফলভাবে ট্রায়াল দেন এবং কলেজে বিনামূল্যে ভর্তির অনুমতি পান। তিনি ১৯৩৪ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা পাস করেন এবং একই বছর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিল্ডে কলেজ দলের অধিনায়কত্ব করেন। তার পারফরম্যান্সে মুগ্ধ হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য আর. সি. মজুমদার তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে অনুপ্রেরণা যোগান। অবশেষে সেখানে তার অন্তর্ভুক্তি ঘটে এবং বিশ্ববিদ্যালয় দলের হয়ে ফুটবল খেলার পাশাপাশি তিনি জগন্নাথ হলের অ্যাথলেটিক্স সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। তার খ্যাতির সীমানা ক্রমেই আরও ছড়াতে থাকে।
দেহের মৃত্যু হয়, কর্মের নয়- এই কথাটি বহুল প্রচলিত এবং এর পক্ষে অনেক নজিরও আছে । একজন কীর্তিমান নিজের কর্মে অমরতা অর্জন করেন, সময় তাকে মুছে ফেলতে পারে না। কীর্তিমানরা নশ্বর পৃথিবীতে তাদের কাজের অক্ষয় স্বাক্ষর রেখে যান, যা কালের স্রোতে কখনো মলিন হয় না। কীর্তিই তাদের বাঁচিয়ে রাখে মানুষের মাঝে। কীর্তিমান মানুষ শুধু একটি জীবন নন, বরং তারা একটি জীবন্ত ইতিহাস। তাদের জীবনকথা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে জ্ঞানের ভান্ডার হয়ে থাকে। যে জীবন অন্যের জন্য উৎসর্গীকৃত, যে জীবন মহৎ কর্মে পরিপূর্ণ, সেই জীবনের সমাপ্তি নেই। কীর্তিমানেরাই তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। কীর্তিমানরা তাদের কাজের মাধ্যমে সময়ের সীমানা অতিক্রম করে যান। তাদের অবদান ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে নতুন দিগন্তের সন্ধান দেয়। হাজারো মানুষের মাঝে থেকেও কেউ কেউ কীর্তি দিয়ে নিজেকে অনন্য করে তোলেন, আর তাদের মৃত্যু কখনো হয় নাÑ তারা অদৃশ্যভাবে থাকেন চারপাশে। বি. রায় চৌধুরী তেমনই একজন।
তার জীবনপঞ্জি সাক্ষ্য দেয়, ১৯৩০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে যখন আসামের শিলচরে প্রথম বিভাগ ফুটবল শুরু হয় তখন এ অঞ্চলের সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা এবং হবিগঞ্জের ক্লাবগুলো লীগে যোগ দেয়। এর ফলে তিনি এবং তার ছোট ভাই শচীন রায় চৌধুরী নিয়মিত ঢাকা থেকে অংশগ্রহণের জন্য শিলচর যেতেন। ১৯৩৭ সালে তিনি সফরকারী ইসলিংটন করিন্থিয়ান্সের বিরুদ্ধে ঢাকা স্পোর্টিং অ্যাসোসিয়েশন একাদশ (ডিএসএ একাদশ) এর প্রতিনিধিত্ব করেন। ডিএসএ মাঠে অনুষ্ঠিত ওই প্রথম প্রদর্শনী ম্যাচে তিনি বাম-উইংয়ে খেলেন, যেখানে পাখি সেন ডিএসএ একাদশের হয়ে একটি আশ্চর্যজনক জয়ে একমাত্র গোলটি করেন। তিনি দ্বিতীয় প্রদর্শনী ম্যাচেও খেলেন।
১৯৩৮ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.কম পাস করেন এবং কলকাতাভিত্তিক ইস্ট বেঙ্গল ক্লাবের হয়ে খেলার আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন। ১৯৩৯ সালে তিনি চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী মোহনবাগান এসি-তে যোগ দেন এবং রাজনীতি ও ক্রীড়াঙ্গন থেকে অবসর নেওয়ার আগে পরবর্তী চার বছর ক্লাবে কাটিয়েছিলেন। একপর্যায়ে আনুষ্ঠানিকভাবে ফুটবল থেকে অবসর নিয়ে তিনি পুনরায় স্বদেশি আন্দোলনে যোগ দেন এবং সিলেটে তার প্রচেষ্টাকে কেন্দ্রীভূত করেন। মধ্যে তিনি শিলচরের দ্য এশিয়াটিক ব্যাংকে ম্যানেজার হিসেবে কাজ করেন এবং কয়েক বছর শিলচর ইন্ডিয়া ক্লাবের সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পড়ে এ ক্লাবের আজীবন সদস্যপদ লাভ করেন। তিনি মোহনবাগান এসির সম্মানসূচক সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৪৬ সালে বি. রায় চৌধুরী আসাম ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদকের দায়িত্বও পালন করেন। দেশ বিভাগের পর তিনি হবিগঞ্জের বানিয়াচং-এ তার পৈতৃক ভিটায় ফিরে আসেন সেখানেই প্রয়াণের আগ পর্যন্ত বসবাস করেন। ৮০ বছর বয়সে ১৯৯২ সালের ২১ নভেম্বর নিজ বাড়িতে শেষ নিশ^াস ত্যাগ করেন। স্বদেশি আন্দোলনের একজন বীর ও বিশিষ্ট ফুটবলার হিসেবে তিনি মৃত্যু পর্যন্ত ভারত সরকারের কাছ থেকে সম্মানসূচক ভাতা পান। ১৯৭৩ সালে ভারতে ব্রিটিশবিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামীদের একটি মহাসম্মেলনে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তাকে তামার মুকুট দিয়ে সম্মানিত করেন।
তিনি তার কর্মকীর্তিতে দেদীপ্যমান কিন্তু বর্তমান প্রজন্মের অনেকের কাছেই তার বীরত্বগাথা অজানা। তার মতো কীর্তিমানের জীবন অধ্যায় প্রজন্মের কাছে বহুল পঠিত হওয়ার উদোগ-আয়োজন নেওয়ার দায়-দায়িত্ব ছিল যাদের তারা এ ব্যাপারে কোনো ভূমিকাই পালন করেননি। তবে সময় ফুরিয়ে যায়নি। হবিগঞ্জ জেলা ও বানিয়াচং উপজেলা প্রশাসন এ ব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা নিলে প্রজন্মের চেতনা সমৃদ্ধ ও বিকাশের পাশাপাশি ইতিহাসের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা হবে। আমরা জানি, যে জাতি তাদের কীর্তিমানদের সম্মানিত করে, যথাযথ্যভাবে উপস্থাপন করে সেই জাতির উত্তর প্রজন্ম নিজেদের বিকাশে সেই পথ অনুসরণের মসৃণ পথের সন্ধান পায়। যার যেটুকু প্রাপ্য তাকে সেটুকু দেওয়া সমাজের নৈতিক দায়িত্ব। তার প্রয়াণ দিবসে বিনম্র শ্রদ্ধায় তাকে স্মরণ করি।
দেবব্রত চক্রবর্তী বিষ্ণু
সাংবাদিক, কলামিস্ট, কবি ও বিশ্লেষক

