ঢাকা শুক্রবার, ২১ নভেম্বর, ২০২৫

গণমাধ্যমকে টিকিয়ে রাখতে সংস্কার জরুরি

শিব্বির আহমেদ রানা
প্রকাশিত: নভেম্বর ২১, ২০২৫, ০১:৪৮ এএম

দেশের গণমাধ্যম আজ এক গভীর সংকটের মুখোমুখি। স্বাধীন, দায়িত্বশীল ও সত্যনিষ্ঠ সাংবাদিকতা যেখানে রাষ্ট্র ও সমাজের শক্ত ভিত্তি হওয়ার কথা, সেখানে এখন এক শ্রেণির অপেশাদার, সুযোগসন্ধানী ও অসাধু ব্যক্তির দৌরাত্ম্যে পুরো খাতটি আস্থাহীনতার খাদে পড়ে গেছে। গণমাধ্যমের দ্রুত বিস্তার ঘটলেও বিশ্বাসযোগ্যতার চরম অবক্ষয় বেড়েছে এটাই আজকের কঠিন বাস্তবতা। একটি স্মার্টফোন হাতে পেলেই সাংবাদিক হওয়ার প্রবণতা এমন ভয়াবহ রূপ নিয়েছে যে, সংবাদ নামের পণ্য এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কপি-পেস্ট আর গুজবের মিশেলে ছড়িয়ে পড়ছে। কোনো নৈতিকতা নেই, নেই তথ্য যাচাই, নেই পেশাগত শৃঙ্খলাÑ আছে কেবল প্রচারলিপি, ভুয়া পরিচয় আর অর্থোপার্জনের পথ খোঁজার তৎপরতা। এর ফলে সাংবাদিকতার মহৎ পেশা কলুষিত হচ্ছে, আর প্রকৃত সংবাদকর্মীদের শ্রম, গবেষণা ও মূল্যায়ন অবহেলিত হচ্ছে প্রতিনিয়ত।

সবচেয়ে উদ্বেগজনক বিষয় হলোÑ চাঁদাবাজ, প্রতারক, দালাল ও নি¤œমানের স্বার্থসংশ্লিষ্ট মানুষজন ‘সাংবাদিক’ পরিচয়কে এখন সহজ ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে। থানায় প্রভাব খাটানো, ভূমি অফিসে দালালি, সাধারণ মানুষকে ভয় দেখানো- এসব অপরাধমূলক কর্মকা-ের আড়ালে প্রেস কার্ড ঝুলিয়ে ঘোরাফেরা করছে অসংখ্য ব্যক্তি। গলা ভর্তি বাংলা উচ্চারণ করতে না পারলেও হাতে মাইক, বগলে ক্যামেরা, আর ইউটিউব বা ফেসবুকের নামে বানানো ভুয়া ‘চ্যানেল’- এরা গণমাধ্যমের পুরো কাঠামোকেই ব্যঙ্গ করে তুলেছে। মিডিয়াঙ্গনকে নিয়ে যাচ্ছে ফানি জগতে। যে সময়ে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা, সামাজিক অসন্তোষ ও অর্থনৈতিক বৈষম্য তীব্র; যে সময়ে মানুষ সিদ্ধান্ত নিতে নির্ভরযোগ্য তথ্য খোঁজে। সেই সময়ে গণমাধ্যমের ভূমিকা আরও শক্তিশালী হওয়া প্রয়োজন ছিল। কিন্তু তার পরিবর্তে বিভ্রান্তিকর শিরোনাম, উদ্দেশ্যমূলক ভিডিও, অর্ধসত্য কিংবা মিথ্যা সংবাদ পরিবেশন একটি বড় অংশের গণমাধ্যমকে অবিশ্বাসের জায়গায় ঠেলে দিয়েছে। এই আস্থাহীনতা যদি রোধ না করা যায়, ভবিষ্যতে গণমাধ্যমের অস্তিত্বই হুমকির মুখে পড়বে।

এ প্রেক্ষাপটে দেশবাসীর দৃষ্টি এখন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের দিকে। জাতির উদ্দেশ্যে তার ভাষণে গণমাধ্যম সংস্কার নিয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা আসবে এটাই দেশের প্রত্যাশা। কারণ গণমাধ্যমের বর্তমান সংকট শুধু পেশাগত নয়; এটি রাষ্ট্রের স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রার সঙ্গেও সরাসরি সম্পর্কিত।

এখনই যে পদক্ষেপগুলো জরুরি-

ক) যোগ্যতা নির্ধারণ : সার্টিফিকেশন বাধ্যতামূলক করা ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা ও পেশাগত প্রশিক্ষণ ছাড়া সাংবাদিক পরিচয় পাওয়া যাবে নাÑ এ নীতি অবিলম্বে কার্যকর করতে হবে।

খ) নিবন্ধন কাঠামো ঠিক করা : অনলাইন প্ল্যাটফর্মের নিবন্ধন কঠোর করা। ফেসবুক-টিভি, ইউটিউব নিউজসহ ডিজিটাল মাধ্যমে ‘সংবাদ’ পরিবেশনের জন্য কঠোর লাইসেন্সিং ব্যবস্থা জরুরি।

গ) কেন্দ্রীয় সাংবাদিক ডেটাবেস : রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে নিবন্ধিত সাংবাদিকদের তথ্য সমৃদ্ধ ডেটাবেস গড়ে তুললে ভুয়া পরিচয় ব্যবহার কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। অপসাংবাদিকতার সয়লাব ক্ষীণ হবে।

ঘ) অপসাংবাদিকতার বিরুদ্ধে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল : সাংবাদিকতার নাম দিয়ে চাঁদাবাজি, মিথ্যা পরিচয়, অপতৎপরতা ও ভুয়া সংবাদ ছড়ানোর বিরুদ্ধে দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন জরুরি।

ঙ) গণমাধ্যম মালিকদের জবাবদিহি নিশ্চিত করা : মালিকানার প্রভাব সংবাদ পরিবেশনে যাতে ব্যাঘাত না ঘটায় এ বিষয়ে কঠোর নীতি প্রয়োজন।

চ) সাংবাদিক সুরক্ষা নিশ্চিত করা : মাঠপর্যায়ের সাংবাদিকদের সুরক্ষা ও পেশাগত মর্যাদা প্রকৃত সাংবাদিকদের নিরাপত্তা, বেতন, প্রশিক্ষণ ও সম্মান নিশ্চিত না করলে এ পেশা ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়বে।

ধ্রুব সত্য হচ্ছে, আজ প্রকৃত সাংবাদিকরা পেশা ছেড়ে চলে যাচ্ছেন; তাদের জায়গা দখল করছে ভুঁইফোড়, প্রশিক্ষণহীন, দায়িত্বজ্ঞানহীন এক বিশৃঙ্খল গোষ্ঠী। এ প্রবণতা অব্যাহত থাকলে তথ্যভিত্তিক রাষ্ট্রকাঠামো ধ্বংসের মুখে পড়বে। এতে গণতন্ত্র ও সমাজ উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা অবশ্যই রক্ষা করতে হবে; কিন্তু সেই স্বাধীনতা কখনোই দায়িত্বহীনতার আশ্রয় হতে পারে না। স্বাধীনতা যখন অপব্যবহারের ঢাল হয়ে দাঁড়ায়, তখন তা পুরো পেশাকে অশুদ্ধ করে ফেলে।

গণমাধ্যমে শুদ্ধি অভিযান শুরু করার এটাই সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। ড. ইউনূসের সরকার এ কাজটির প্রতি গুরুত্ব দিলে দেশ, জাতি উপকৃত হবে। একটি সমৃদ্ধ ও দাযিত্বশীল মিডিয়াঙ্গন তৈরি হবে। সত্যের শক্তি সবসময় টিকে থাকে। এখন প্রয়োজন শক্ত নীতি, দৃঢ় অবস্থান, এবং পেশার প্রতি সর্বোচ্চ সম্মান।

শিব্বির আহমেদ রানা
কলামিস্ট ও গণমাধ্যমকর্মী