ঢাকা কাঁপছে, কিন্তু প্রশাসন নড়ছে না। গত কয়েক দিনের লাগাতার ভূমিকম্প এ শহরের ভঙ্গুর বাস্তবতাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বহু বছর ধরে যে সতর্কবার্তা দিচ্ছেন, তার প্রতিটি বাক্য যেন বাস্তবে রূপ নিতে শুরু করেছে। অথচ ৫৬৮ কোটি টাকার আরবান রেজিলিয়েন্স প্রকল্প, যা ঢাকার ভূমিকম্প-সহনশীলতা গড়ে তোলার মূল কর্মপরিকল্পনা হিসেবে নেওয়া হয়েছিল, সেটিই আজ আটকে আছে প্রশাসনিক জটিলতা, অদক্ষতা ও অদূরদর্শিতার বলয়ে।
রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বৃহত্তর এলাকায় বারবার ভূমিকম্পের কম্পন আমাদের সামনে যে কঠোর সত্য তুলে ধরছে তা হলো, সময় আর হাতে নেই। বড় ধসের আগাম সংকেত আমরা প্রতিনিয়ত পাচ্ছি, কিন্তু প্রস্তুতি এখনো কাগজে-কলমেই আটকে আছে। সরকারের উদাসীনতা, রাজউকের শিথিল ভূমিকা এবং দীর্ঘ প্রশাসনিক জটিলতায় বিপুল ব্যয়ের আরবান রেজিলিয়েন্স প্রকল্পটি আজ কার্যত অচল। এমনকি ৬০ কোটি টাকার আধুনিক যন্ত্রপাতি ও দক্ষ ৮২ জন জনবলও ব্যবহারহীন অবস্থায় পড়ে আছে। যা শুধু অব্যবস্থাপনা নয়, এটি এক ধরনের বিপর্যয়-ডেকে-আনার উদাসীনতা।
বিশ্বব্যাংকসহ আন্তর্জাতিক সংস্থার অর্থায়নে ২০১৫ সালে শুরু হওয়া ৫৬৮ কোটি টাকার প্রকল্পটির উদ্দেশ্য ছিল ঢাকার ভবন নিরাপত্তা বৃদ্ধি, ভূমিকম্প-সহনশীল অবকাঠামো গড়ে তোলা, জরুরি উদ্ধার সক্ষমতা তৈরি, এবং ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা প্রণয়ন। কিন্তু প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হলেও আউটপুটগুলো প্রক্রিয়াজাত হয়নি, যন্ত্রপাতি কার্যকর করা হয়নি এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিশ্চিত করা হয়নি। এমনকি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত স্বতন্ত্র ‘স্ট্রাকচারাল রিস্ক অ্যান্ড রেজিলিয়েন্স ইনস্টিটিউট’ গঠন, মন্ত্রণালয়ের নথিপত্রেই বছরের পর বছর আটকে আছে।
এই সময়ে যখন বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন যে, মাত্র ৬.৯ মাত্রার ভূমিকম্পে ঢাকার ৪০ শতাংশ ভবন ধসে যেতে পারে এবং প্রাণহানির সংখ্যা ছাড়াতে পারে কয়েক লাখ। তখন সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর এই অবহেলা অমার্জনীয়। চলতি সপ্তাহে সাড়ে ৩১ ঘণ্টায় তিনবার ভূমিকম্পের কম্পন এই ভয়াবহতার বাস্তব ইঙ্গিত দিয়েছে। তবুও বড় সিদ্ধান্ত আসছে না, জরুরি উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।
জরিপ বলছে, ঢাকার ৬৫ শতাংশ ভবন ঝুঁকিপূর্ণ। ধানমন্ডি, মতিঝিল, রামপুরা, মিরপুরসহ আরও এলাকার বিপুলসংখ্যক ভবন নকশাবহির্ভূত বা অনুমোদনহীন। বালুভর্তি অরক্ষিত জমিতে তৈরি ভবনগুলোর অবস্থা আরও ভয়াবহ। যে ভবনগুলোকে আগেই সংস্কার করার সুপারিশ ছিল। এরমধ্যে হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি ভবনও রয়েছে যা এখনো চরম ঝুঁকিতে।
দুর্যোগ পূর্বাভাস দিয়ে আসে না, কিন্তু প্রস্তুতি থাকা কিংবা না থাকা এটি আমাদের সিদ্ধান্তের ওপরই নির্ভর করে। পৃথিবীর বহু দেশে ভূমিকম্প কোনো দুর্যোগ সৃষ্টি করে না, কারণ তারা পরিকল্পিত নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। কিন্তু বাংলাদেশে পরিকল্পনার ব্যর্থতা, অনিয়ন্ত্রিত নগরায়ণ ও নিয়ন্ত্রণ সংস্থাগুলোর দুর্বলতা একটি মাঝারি ভূমিকম্পকেও ভয়াবহ দুর্যোগে রূপ দিতে পারে।
ঢাকার অগণিত অনুমোদনহীন ভবন, নকশাবহির্ভূত বহুতল, দুর্বল ভিত্তি, বালুভরাট জমিতে নির্মাণ সব মিলিয়ে শহরটি যেন একটি অস্থির দেয়ালে দাঁড়িয়ে থাকা কোটি মানুষের সমাহার। এমন বিপদের মুখে দাঁড়িয়ে সরকারের দায়িত্বহীনতা শুধু হতাশাজনক নয়, এটি অপরাধের শামিল।
সিদ্ধান্তহীনতা আজ জীবনসংকটে রূপ নিয়েছে। স্বাধীন রেজিলিয়েন্স ইনস্টিটিউট দ্রুত গঠন, প্রকল্প জনবলকে কাজে লাগানো, যন্ত্রপাতি ব্যবহারের উদ্যোগ, ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা প্রকাশ ও জরুরি সংস্কার এসব পদক্ষেপ অবিলম্বে নিতে হবে। ভূমিকম্প সতর্কবার্তা দিয়ে আসে না ঠিকই কিন্তু আমাদের সতর্ক হওয়ার সময় বহু বছর আগেই ফুরিয়ে গেছে।
আমরা মনে করি, প্রশাসনের এই দীর্ঘ ঘুম ভাঙতে হবে। ঢাকার প্রাণ বাঁচাতে এখনই পদক্ষেপ দরকার। শুধু কাগজে নয়, বাস্তবায়ন জরুরি। নইলে একদিন ধ্বংসস্তূপের ওপর দাঁড়িয়ে আমরা শুধু আক্ষেপের বুলি আওরাব আর বলব, জীবন বাঁচাতে এত বিলম্ব কেন হলো?
ভূমিকম্পের ঝুঁকি কোনো ধারণাগত আশঙ্কা নয়। এটি বাস্তব, সন্নিকটে এবং সম্ভাব্যভাবে ভয়াবহ। তাই প্রশাসনিক জটিলতা দূর করে জীবনরক্ষার এই প্রকল্পকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে হবে কেননা জনগণের জীবনের নিরাপত্তার চেয়ে বড় অগ্রাধিকার রাষ্ট্রের আর কিছু নেই।

সর্বশেষ খবর পেতে রুপালী বাংলাদেশের গুগল নিউজ চ্যানেল ফলো করুন
আপনার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে মতামত লিখুন